সুন্দরবন সাভারে এবং ঝরে পড়া ছাত্রীদের কথা - দৈনিকশিক্ষা

সুন্দরবন সাভারে এবং ঝরে পড়া ছাত্রীদের কথা

মাছুম বিল্লাহ |

সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে এসএসসি পরীক্ষা শুরু হতে যাচ্ছে ১৪ নভেম্বর এবং শেষ হবে ২৩ নভেম্বর। পরীক্ষা দিয়ে সার্টিফিকেট নেয়ার আনন্দ আলাদা, যে আনন্দ থেকে শিক্ষার্থীরা গত দু’বছর বঞ্চিত ছিল। সিলেবাস ছোট হোক আর বড় হোক, তারা কিছু একটা করে সার্টিফিকেট পেতে যাচ্ছে, এর মূল্যও আলাদা। শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন শিখন-শেখানো কার্যক্রমের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ। সমস্যা হচ্ছে, শিখন-শেখানো বিষয় নিয়ে আমরা যত না ব্যস্ত, তার চেয়ে বেশি ব্যস্ত মূল্যায়ন নিয়ে। এটি অবশ্য হওয়ারই কথা। কারণ একজন শিক্ষার্থী তার পঠিত বিষয়ের কতটা জেনেছে, তার একটা দালিলিক প্রমাণ থাকা দরকার, যার ওপর ভিত্তি করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, প্রতিষ্ঠানের বাইরে, উচ্চশিক্ষা গ্রহণে, চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে এবং চাকরিতে প্রমোশন পেতে ওই কাগজটিই প্রমাণ হিসেবে কাজ করে। তাই আমরা এই বিষয়টিকেই বেশি গুরুত্ব দিয়ে আসছি। যে কোনও প্রকারেই হোক, সৎ উপায়ে হোক আর অসৎ উপায়েই হোক, ওই কাগজটিতে একটি ভাল গ্রেডিং সবাই পাওয়ার চেষ্টা করে থাকেন। কিন্তু ইদানিং ওই কাগজটি তার মূল্য অনেকটাই হারাতে বসেছে। কারণ কেউ একজন যদি বলে আমি এসএসসি ও এইচএসএসসি দুটো পরীক্ষাতেই জিপিএ-৫ পেয়েছি, তারপরও তাকে উচ্চতর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে পরীক্ষা দিতে হয়। ভাল কোন প্রতিষ্ঠানে চাকরি পেতে হলে তাকে বাজিয়ে দেখা হয়। এতগুলো কথা যে জন্য বলেছি, তার কিছু উদ্দেশ্য আছে।

আমি দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন লেভেলের (প্রাথমিক ও মাধ্যমিক) শিক্ষার্থীদের সাথে আলাপ করে যে বিষয়গুলো দেখলাম, তাতে মূল্যায়ন নিয়ে আমার বেশ কিছু প্রশ্ন মনে উদয় হয়েছে। আমি শিক্ষার্থীদের বাংলা বই, ইংরেজি বই পড়তে দিয়েছি। একটি ক্লাসে এক দুজন ছাড়া কেউই তাদের শ্রেণির বাংলা কিংবা ইংরেজি বই ভালভাবে পড়তে পারছে না। অনেকে যুক্তাক্ষর পড়তেই পারছে না। তাদের জিজ্ঞেস করেছি, সুন্দরবন রাজশাহীতে না ঢাকায়? কেউ কেউ বলেছে ঢাকায়, কেউ বলেছে রাজশাহীতে। যখন জিজ্ঞেস করলাম, ঢাকায় কোথায়? সাভার না গুলিস্তান? অনেকেই বলেছে সাভার। আবার অন্য ক্লাসে যখন জিজ্ঞেস করেছি, সুন্দরবন কি খুলনায় না বরিশালে? কেউ কেউ বলেছে খুলনায়, কেউ কেউ বলেছে বরিশালে। তার মানে সঠিকভাবে কেউই জানে না। তাদের বই থেকে জিজ্ঞেস করেছি ‘আমি পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ি/ আমি ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ি’ এর ইংরেজি কি? ধরিয়ে দেওয়ার পর তারা বলতে পেরেছে। নিজে পারার পরে যখন জিজ্ঞেস করেছি, আমার ভাই ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে/আমার বোন সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে, তখন আর কেউ পারছে না। তার অর্থ হচ্ছে, তারা কিন্তু পঠিত কোন বিষয় নিজের বাক্যে ব্যবহার করতে পারছে না। অর্থাৎ বাস্তব জীবনে ব্যবহার করতে পারছে না। তাদের মেধা নেই, এ জন্য পারছে না, বিষয়টি তা নয়। শিক্ষকরা সেভাবে শেখাচ্ছেন না। শিক্ষকরা কেন সেভাবে শেখাচ্ছেন না, কারণ ওইভাবে পরীক্ষায় আসে না। প্রশ্ন হচ্ছে তাহলে কী ধরনের মূল্যায়নটা হচ্ছে? আমি যখন তাদের শিখিয়ে দিলাম যে, মাই ব্রাদার রিডস ইন ক্লাস সিক্স, কয়েকবার প্রাকটিস করার পরে তারা পেরেছে। সাধারণ গণিতের ক্ষেত্রে জিজ্ঞেস করলাম। তোমার কাছে ১২৫০ টাকা আছে। এই টাকা নিয়ে বাজারে গিয়ে একটি বই কিনেছ ২০০ টাকা দিয়ে, একটি ক্যালকুলেটর কিনেছ ২৫০ টাকা দিয়ে, একটি খাতা কিনেছ ৩০ টাকা দিয়ে। এখন কি তোমার কাছে টাকা থাকবে? কেউ বলেছে থাকবে, কেউ বলেছে থাকবে না। জিজ্ঞেস করলাম, এটি বের করতে কি আমাদের গুণ করতে হবে, নাকি ভাগ করতে হবে? কেউ বলেছে গুণ করতে হবে, কেউ বলেছে ভাগ করতে হবে। বিয়োগের কথা প্রথম কেউই বলেনি।  বললাম, খাতায় হিসেব করে দেখ। দেখলাম, প্রতি ক্লাসে হয়তো একজন কোনরকম বের করেছে। কিন্তু সেটা বিয়োগের নিয়মানুযায়ী করা হয়নি। সবাই ১,২৫০-এর নিচে লিখেছে ২০০ টাকা, ২৫০ টাকা, ৩০ টাকা। এটি বের করার যে নিয়ম, সেটি তারা আয়ত্ত করতে পারেনি। লাভ-ক্ষতির কথা জিজ্ঞেস করেছি কখন লাভ হয়, কখন ক্ষতি হয়? বের করার উপায় কী? কেউ বলতে পারছে না। অর্থাৎ বেসিক ধারণা তাদের দেওয়া হচ্ছে না। অষ্টম শ্রেণি ও দশম শ্রেণিতে জিজ্ঞেস করেছি, আমাদের ক্লাসে আটান্নজন শিক্ষার্থী আছে, এটি ইংরেজিতে কীভাবে বলা যায়? একজন শিক্ষার্থীও পারেনি। কিন্তু পাবলিক পরীক্ষায় দেখা যাবে ৯৮-৯৯ শতাংশ শিক্ষার্থা ভালভাবে পাস করবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে কী মূল্যায়ন হচ্ছে? মূল্যায়ন বিষয়টি তো তার গুরুত্ব একেবারেই হারিয়ে ফেলেছে। যার বেসিক ধারণা আছে সেও নম্বর পাচ্ছে, যার কোন ধারণা নেই সেও নম্বর পাচ্ছে। এই নম্বর তো তাদের অর্জিত জ্ঞান ও দক্ষতার কথা বলছে না।  

২০১০ খ্রিষ্টাব্দের শিক্ষানীতিতে পঞ্চম শ্রেণিতে সমাপনী পরীক্ষা ও অষ্টম শ্রেণিশেষে জেএসসি পরীক্ষা নেয়া হয়। সরকারের নির্বাহী ক্ষমতাবলে পরীক্ষাদুটো নেওয়া হচ্ছে। করোনার কারণে গতবার এবং এবার এ পরীক্ষাদুটো হচ্ছে না। নির্বাহী ক্ষমতাবলে পরীক্ষাদুটো নেওয়া হচ্ছে কেন? পরীক্ষা না হলে, পরীক্ষার চাপ না থাকলে শিক্ষার্থীরা ক্লাস করতে চায় না, পড়তে চায় না, অভিভাবকগণও পড়াশোনার প্রতি অনীহা প্রকাশ করেন। তারা চান বাচ্চারা চাপে থাকুক। পরীক্ষা না হলে, পড়াশোনার চাপ না থাকলে বেসরকারি পুস্তক প্রকাশকগণ তাদের বই বিক্রি করতে পারেন না। শিক্ষকগণও খুব একটা আগ্রহ পান না। পরীক্ষায় যে কয়টি চ্যাপ্টার, যে কয়টি বিষয় গুরুত্বপূর্র্ণ, সেগুলো বারবার প্রাকটিস করানো হয়। পরীক্ষা না হলে এগুলো করানো হয় না। এটিও বাস্তব চিত্র। তাই সরকার নির্বাহী ক্ষমতাবলে পরীক্ষাদুটো টিকিয়ে রেখেছিল। তার মানে, পরীক্ষা নেওয়ার যুক্তি আছে। কিন্তু শিক্ষার্থীরা পঠিত বিষয় নিজে ব্যবহার করতে জানছে না, কিংবা পারছে না। কারণ পরীক্ষা না হলে তারা কোনও কিছু পড়তে চায় না। এর সমাধান আসলে কী? শিক্ষার্থীদের আনন্দদানের মাধ্যমে পড়াতে পারলে পড়ানো বিষয় তারা নিজের বাক্যে ব্যবহার করতে পারবে। শিক্ষক বিষয়টি টের পেলে বা জেনে গেলেই সেটি মূল্যায়ন। 

এবার এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় ১৪ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে। এতে ১১টি শিক্ষাবোর্ডের অধীনে মোট ২২ লাখ ২৭ হাজার ১১৩ জন শিক্ষার্থী অংশ নিচ্ছে। তাদের মধ্যে নয়টি বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী নিয়মিত পরীক্ষার্থী ১৬ লাখ ৭০ হাজার ৩৮০ জন। আর দু’বছর আগে এসব বোর্ডে নবম শ্রেণিতে রেজিস্ট্র্রেশন করেছিল ১৯ লাখ ৪৮ হাজার ৫৬ জন। বাকি ২ লাখ ৭৭ হাজার ৮৭৬ জনের হদিস নেই। ১১টি বোর্ডের তথ্য যুক্ত হলে এই সংখ্যা আরও বেড়ে যেতে পারে। ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের ৭২ শতাংশই ছাত্রী। অর্থাৎ মোট শিক্ষার্থীর মধ্যে ছাত্রী ১ লাখ ৯৯ হাজার ৮১৪ জন। রাশেদা কে চৌধুরী এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের অনেকেই হয়তো শিশুশ্রমে ভিড়ে গেছে কিংবা বিয়ে হয়েছে। লেখাপড়া ছেড়ে দেওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে অধিকাংশই ছাত্রী, এই খবর কিন্তু উদ্বেগজনক। এসব ছাত্রীকে স্কুলে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।’ 

বাল্যবিয়ের কুফল নিয়ে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে এত আলোচনা- পর্যালোচনার পরেও পড়াশোনা বাদ দিয়ে বাল্যবিয়ে হচ্ছে। এর মূল কারণ দারিদ্র্য হলেও মেয়েদের নিরাপত্তার বিষয়টিও কিন্তু ফেলে দেওয়ার মতো নয়। দরিদ্র ও অসহায় পিতামাতা মেয়ের নিরাপত্তার কথা ভেবে, বখাটেদের হাত থেকে রক্ষার জন্য, রাজনৈতিকভাবে প্রশয় পাওয়া উঠতি বয়সের ছেলেদের টিজিংয়ের হাত থেকে রক্ষার জন্য বাল্যবিয়ের কুফলের কথা জেনেও অনুপযুক্ত পাত্রের হাতে মেয়েকে সমর্পন করছেন। এ নিয়ে কোনও সামাজিক সংগঠন কিংবা কোন বেসরকারি সংস্থা এলাকাভিত্তিক কিছু গবেষণা করে, তার ফল প্রকাশ ও কিছু প্রস্তাবনাও পেশ করে। কিন্তু তাতে তো উঠতি বয়সী ছেলেদের বখাটেপনা কমে না। ভুক্তভোগী পিতার পাশে কেউ দাঁড়ায় না, বরং কোন দুর্ঘটনা ঘটলে মেয়ের ওপরই দোষ চাপানো হয়। রাজনীতির যে দুষ্টরাহু সমগ্র সমাজকে গ্রাস করে ফেলেছে, এ থেকে উত্তরণের উপায় তো খুব সহজ নয়। তবে শিক্ষকদের হাল ছেড়ে দিলে হবে না। রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, ‘এসব শিক্ষার্থীকে, বিশেষ করে নারী শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে ফিরিয়ে আনার সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে। তাদেও প্রণোদনার অংশ হিসেবে উপবৃত্তি দেওয়া হয়। কিন্তু এটা পাওয়ার অপরিহার্য শর্ত তাকে ‘অবিবাহিত’ থাকতে হবে। কিন্তু যে লাখ লাখ ছাত্রী পরীক্ষায় বসছে না, তাদের মধ্যে যে কজনের বিয়ে হয়েছে? আর তাদের যদি স্কুলে দেখতে চাই, তাহলে ‘অবিবাহিত’ থাকার শর্ত তুলে দিতে হবে। নইলে তারা আগ্রহী হবে না।’

এ ব্যাপারে মাউশি অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেন, ‘উপবৃত্তি কার্যক্রম বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট ফান্ড থেকে পরিচালিত হচ্ছে। এ সিদ্ধান্ত তারা নিতে পারে। তবে এটি নিয়ে আলোচনা হতে পারে।’

লেখক : মাছুম বিল্লাহ, শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও গবেষক এবং প্রেসিডেন্ট : ইংলিশ টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইট্যাব)।

 

কিরগিজস্তানে বাংলাদেশি ১২শ’ শিক্ষার্থীর আতঙ্কে দিন কাটছে - dainik shiksha কিরগিজস্তানে বাংলাদেশি ১২শ’ শিক্ষার্থীর আতঙ্কে দিন কাটছে বিলেত সফরে শিক্ষামন্ত্রী - dainik shiksha বিলেত সফরে শিক্ষামন্ত্রী ডলার সংকটে কঠিন হচ্ছে বিদেশে উচ্চশিক্ষা - dainik shiksha ডলার সংকটে কঠিন হচ্ছে বিদেশে উচ্চশিক্ষা সুপাড়ি চুরির সন্দেহে দুই ছাত্রকে নির্যা*তন - dainik shiksha সুপাড়ি চুরির সন্দেহে দুই ছাত্রকে নির্যা*তন ডক্টরেট ডিগ্রি পেলো বিড়াল - dainik shiksha ডক্টরেট ডিগ্রি পেলো বিড়াল নামী স্কুলগুলোর ফলে পিছিয়ে পড়ার নেপথ্যে - dainik shiksha নামী স্কুলগুলোর ফলে পিছিয়ে পড়ার নেপথ্যে কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে এসএসসির খাতা চ্যালেঞ্জের আবেদন যেভাবে - dainik shiksha এসএসসির খাতা চ্যালেঞ্জের আবেদন যেভাবে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.03040599822998