সুস্থ শিক্ষা ব্যবস্থা কি? - দৈনিকশিক্ষা

সুস্থ শিক্ষা ব্যবস্থা কি?

তামান্না ইসলাম, ক্যালিফোর্নিয়া (যুক্তরাষ্ট্র) থেকে |

বিদেশে আসার আগে সব সময় শুনতাম, বিদেশে বাচ্চাদের পড়ালেখার কোনো চাপ নাই তারা হেসেখেলে মনের আনন্দে দিন কাটায় মনে মনে ভাবতাম, তাহলে এরা জ্ঞান অর্জন করে কীভাবে? এই যে বড় বড় বিজ্ঞানী, প্রফেসর, ডাক্তার, সমাজকর্মীএরা কীভাবে এত কিছু শিখলেন? জ্ঞান বিজ্ঞানে এত উন্নতিই বা কীভাবে করল?
বিদেশে এসেছি দেড় মাসের বাচ্চা নিয়ে। তাঁর তখনো স্কুলে যাওয়ার বা কিছু শেখার মতো বয়স হয়নি। তবে নিজে কিন্তু ইউনিভার্সিটিতে মাস্টার্স করতে গিয়ে অবাক হয়েছি। শিক্ষকদের পড়ানোর ধরন একেবারে আলাদা। অনেক কিছু সুন্দর করে পড়িয়ে তারপরে কোথা থেকে যেন সৃষ্টিছাড়া ছোট্ট একটা প্রশ্ন করেন। সারা দিন মাথাখুটে তার উত্তর পেতে হয়। আমার পরিচিত পড়ালেখার অভিজ্ঞতার সঙ্গে একেবারেই মেলে না। আরও অবাক করা ঘটনা হলো ক্লাসের ছেলেমেয়েগুলো অনেকেই বেশ বুঝে যায় সেই সব প্রশ্নের ধরন। এমনকি কানাডিয়ানরাও। তাহলে ওরা সারাজীবন কিছু না পড়ে এত কিছু বোঝে কীভাবে? আমি গোলকধাঁধায় পড়ে যাই। সেই ধাঁধার উত্তর পেতে আমাকে অনেক বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে

আমার বাচ্চারা যখন স্কুলে যাওয়া শুরু করল, এমনকি তারও আগে ডে কেয়ারে, সেই দুইতিন বছর বয়স থেকেই দেখি এদের ডিসিপ্লিন শেখায়, নিজের কাজ নিজে করা শেখায়। ওই বয়সী বাচ্চারা বরফে খেলতে যাবে তার আগে নিজের জামা, জুতা, ভারী জ্যাকেট সব নিজে পরবে। খেলার শেষে এসে আবার যথাস্থানে খুলে রাখবে। শিশুরা একটু একটু করে সময়রুটিন এই ব্যাপারগুলো শিখতে থাকে। কোন কাজের পর কোন কাজ করতে হবে, কোন কাজে কতটুকু সময় ব্যয় করা যাবে, তাদের শিশু বয়স থেকেই সেই ট্রেনিং দেওয়া হয়। নিজের খাওয়া নিজেকে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে খেতে হবে।
সময়ের মূল্য, টাইম ম্যানেজমেন্ট, স্বনির্ভরতা, জীবনে সাফল্য অর্জনের জন্য এগুলোর কোনো বিকল্প নেই। সেই সঙ্গে তাদের শেখানো হয় সমাজে একজন মানুষ হিসেবে বাস করতে হলে কী কী গুণাবলি দরকার। সবকিছু অন্যের সঙ্গে সমভাবে ভাগ করে নিতে হবে। মিথ্যা বলা যাবে না, ধাক্কাধাক্কি, মারামারি, বাজে কথা চলবে না। নিজের রাগ মেজাজকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। শেখানো হয় টিমওয়ার্ক দল বেঁধে কাজ করা। এগুলো প্রতিটি জিনিস আজীবন মানুষের কাজে লাগে।
বোঝা গেল জীবনের শিক্ষা শিখছে, কিন্তু কাজের কাজ কি কিছু হয়? অর্থাৎ আমরা যেটাকে শিক্ষা ভাবি, লিখতেশিখতে? গড়গড় করে পড়তে? অঙ্ক, নামতা, ভূগোল? এগুলোও শিখছে, তবে অন্যভাবে, ছোট ছোট ধাপে, খেলাচ্ছলে। একদম ছোট বয়সে প্রচুর কাগজ কাটাকাটি, ছবি আঁকাজোকা করানো হয়। এতে নাকি মোটর স্কিল বাড়ে। চোখকানহাত একসঙ্গে সমন্বয় করতে পারে। ধাপে ধাপে অক্ষর, অক্ষরপরিচয়ের সঙ্গে শব্দ, শব্দগুলো হয় বিজ্ঞান ভূগোলের সঙ্গে সম্পর্কিত, ধাপে ধাপে সংখ্যা, আস্তে আস্তে যোগবিয়োগ কিন্তু সবই প্রচুর ছবি আর খেলনা দিয়ে হাতেকলমে শিক্ষা। মুখস্থের কোনো বালাই নাই।
প্রাইমারি স্কুলগুলোতে মূলত বিষয় থাকে ইংরেজি অঙ্ক। এরপর আস্তে আস্তে আসে বিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, সংগীতবাদ্যযন্ত্র, শরীরচর্চা। পরীক্ষাগুলোতে মুখস্থের কোনো দরকার নেই। এখানে ফার্স্ট, সেকেন্ডের কোনো ধারণা নেই শিশুদের মধ্যে। তাদের ক্লাসের অন্য বাচ্চার নম্বর জিজ্ঞেস করলে তারা ভীষণ বিরক্ত হয়। তাদের সমস্ত চিন্তা নিজে কী করতে ভালোবাসে এবং সেই বিষয়ে আরও বেশি কীভাবে জানা যায়।
বাংলাদেশের শিক্ষার সঙ্গে যেই পার্থক্যগুলো আমি লক্ষ্য করেছি সেগুলো হলো, ইংরেজিকে ভাষা হিসেবে বেশি গুরুত্ব না দিয়ে এটাকে তারা ব্যবহার করে শিশুদের চিন্তা শক্তির বিকাশে। এখানে বাচ্চারা কখনো রচনা মুখস্থ করে না। কিন্তু ছোটবেলা থেকেই শক্ত শক্ত জীবনমুখী বিষয়ে ভাবতে শুরু করে। বাচ্চাদের পূর্ণ স্বাধীনতা থাকা উচিত কিনা, তোমার স্কুলে একটি বাড়তি কম্পিউটার ল্যাব দরকার, প্রধান শিক্ষককে এই বিষয়ে রাজি করাতে চিঠি লেখ, রকম কঠিন বিষয়েও।
দ্বিতীয়ত, ইংরেজি, বিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান কিছুতেই কোনো মুখস্থ নেই। যে বাচ্চা বইগুলো বুঝে পড়বে, ক্লাসের কাজ, বাড়ির কাজ বুঝে করবে সে কনসেপ্টগুলো ধরতে পারবে। তার পরীক্ষা দিতে কোনো অসুবিধা হবে না। আর পরীক্ষায় নম্বরও খুব বেশি নয়।
তৃতীয়ত, অঙ্কের থিওরি মুখস্থর চেয়ে, সেগুলো আসলে কেন কাজ করে সেই গভীরতায় যেতে তাদের উৎসাহ দেওয়া হয়। আর বাস্তব জীবনের বিভিন্ন উদাহরণের মাধ্যমে সেগুলো শেখানো হয়। বইগুলো অত্যন্ত চমৎকার। ছোটবেলা থেকেই এই বাস্তব উদাহরণ নিয়ে ভাবতে ভাবতে তাদের মধ্যে অটোমেটিক এক ধরনের সৃজনশীলতা গড়ে ওঠে।
চতুর্থ, স্কুলের শিক্ষকশিক্ষিকাদের প্রাইভেট পড়ানো বা কোচিংয়ের কোনো নিয়ম নেই। তাই তারা মোটামুটি নিরপেক্ষ কাজে নিবেদিতপ্রাণ।
সর্বশেষে, প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা না থাকার কারণে বাচ্চারা কোনো চাপ অনুভব করে না। তারা আনন্দের সঙ্গে শিক্ষা গ্রহণ করে। এতে করে সত্যিকার মেধাবী আগ্রহী বাচ্চাদের পড়ালেখার প্রতি, নতুন কিছু শেখার প্রতি গভীর আগ্রহ তৈরি হয়। খুব ছোটবেলা থেকেই এদের কম্পিউটারের বিভিন্ন প্রয়োজনীয় ব্যবহার হাতে কলমে শেখানো হয়।
প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষার ধরন মোটামুটি একই ধরনের হলেও ক্লাস সিক্সসেভেনের পর থেকে বাচ্চারা কিছুটা আগ্রহের ওপর নির্ভর করে বিষয় নিতে পারে। পড়ার চাপ বাড়তে থাকে ঠিকই, কিন্তু যেহেতু নিজ আগ্রহে নেওয়া তাই ততটা অনীহা থাকে না। এখানেও বিষয় প্রধানত সেই চারটি। ইংরেজি, অঙ্ক, বিজ্ঞান সমাজবিজ্ঞান। শরীরচর্চা বাধ্যতামূলক। সেইসঙ্গে কেউ ইচ্ছা করলে অন্য কোনো ভাষা নিতে পারে। সংগীত বা বাদ্যযন্ত্র নিতে পারে। অনেক প্রজেক্ট করতে হয় যেগুলোর জন্য, তাদের প্রচুর গবেষণা করে তথ্য সংগ্রহ করতে হয়।
ক্লাস নাইন থেকে অর্থাৎ হাইস্কুলে গিয়ে তারা আরও বেশি আগ্রহের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে বিষয় নিতে পারে। কেউ হয়তো ক্যালকুলাস করবেই না। কেউ বায়োলজি বা কেমিস্ট্রি বা ফিজিকস পড়বেই না। কেউ ইকোনমিকসের ধারে কাছেও নেই। যে যেটায় আগ্রহী সেগুলো ভালো করে পড়বে। প্রতি বছরে ছয়টা করে বিষয় শিখবে নাইন থেকে টুয়েলভ পর্যন্ত। তবে এই শেখাটা অত্যন্ত গভীর উঁচুমানের। ফাঁকি ঝুঁকি দিয়ে, ভাসা ভাসা বুঝে ভালো করা সম্ভব নয়। এই সময়ে বাচ্চারা পরিশ্রম করতে শেখে। ইন্টারনেট ঘেঁটে, মাথা ঘামিয়ে, নিজেরা আলোচনা করে বিষয়ের গভীরে যায়। শিক্ষকেরাও নিত্যনতুন সৃজনশীল কিন্তু বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত প্রশ্ন দিয়ে তাদের চ্যালেঞ্জ করতে থাকে। বই থেকে সরাসরি প্রশ্ন বা মুখস্থ বা সরাসরি সূত্র দিয়ে করার মতো প্রশ্ন থাকে না বললেই চলে।
স্কুলের কোনো লেভেলে কোনো ভর্তি পরীক্ষা ছাড়াই নিজ নিজ এলাকার সরকারি স্কুল যেকোনো বাচ্চাকে নিতে বাধ্য। তাই ভর্তি পরীক্ষার আশঙ্কা থেকে তারা মুক্ত। ছোটবেলা থেকেই প্রেজেন্টেশন, কথা বলা, টিমওয়ার্ক, মুক্তচিন্তার চর্চা এগুলো করিয়ে এদের আত্মবিশ্বাসও থাকে শীর্ষে।
পৃথিবীর সব মানুষ এক নয়। সবার মেধা, আগ্রহ, পারিপার্শ্বিকতা,

শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি: শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি: শিক্ষা মন্ত্রণালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় - dainik shiksha অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় দুর্যোগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছুটিতে বিশেষ কমিটি গঠনে নীতিমালা হবে: শিক্ষামন্ত্রী - dainik shiksha দুর্যোগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছুটিতে বিশেষ কমিটি গঠনে নীতিমালা হবে: শিক্ষামন্ত্রী জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮ মে’র পরীক্ষা স্থগিত - dainik shiksha জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮ মে’র পরীক্ষা স্থগিত হিটস্ট্রোকে সাতক্ষীরায় শিক্ষকের মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে সাতক্ষীরায় শিক্ষকের মৃত্যু হিটস্ট্রোকের লক্ষণ ও করণীয় - dainik shiksha হিটস্ট্রোকের লক্ষণ ও করণীয় দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে চাকরিতে আবেদনের বয়স ৩৫ করতে শিক্ষামন্ত্রীর সুপারিশ - dainik shiksha চাকরিতে আবেদনের বয়স ৩৫ করতে শিক্ষামন্ত্রীর সুপারিশ শিক্ষিকার উত্যক্তকারীকে ধরতে গিয়ে হামলার শিকার পুলিশ - dainik shiksha শিক্ষিকার উত্যক্তকারীকে ধরতে গিয়ে হামলার শিকার পুলিশ সর্বজনীন পেনশনে অন্তর্ভুক্তির প্রতিবাদে ঢাবি শিক্ষক সমিতির কর্মসূচি - dainik shiksha সর্বজনীন পেনশনে অন্তর্ভুক্তির প্রতিবাদে ঢাবি শিক্ষক সমিতির কর্মসূচি please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0038900375366211