স্কুলে ফিরবে না করোনাকালে কাজে যুক্ত হওয়া অনেক শিক্ষার্থী - দৈনিকশিক্ষা

স্কুলে ফিরবে না করোনাকালে কাজে যুক্ত হওয়া অনেক শিক্ষার্থী

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

করোনার কারণে ১১ মাস ধরে বন্ধ রয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সম্প্রতি সংক্রমণ কমে আসায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। তবে ক্লাসে আগের মতো শিক্ষার্থী হয়তো দেখা যাবে না। আগের বছরগুলোর চেয়ে এবার ঝরে পড়ার হার নিশ্চিতভাবেই বাড়বে বলছেন পরিসংখ্যান ও  বিশ্লেষকরা। শিক্ষার্থীদের যারা করোনাকালে কাজে যুক্ত হয়েছে তাদের অনেকেই আর স্কুলে ফিরবে না। আবার অনেকে স্কুলে ভর্তি হলেও ক্লাসে অনুপস্থিতির হারও বাড়বে। শনিবার (২৩ জানুয়ারি) কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন শরীফুল আলম সুমন।

প্রতিবেদনে আরও জানা যায়, ঢাকার বাইরের একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভর্তির তথ্য নেওয়া হয়। সেখানে দেখা যায়, গত বছরের তুলনায় এ বছর এখনো এক-তৃতীয়াংশ শিক্ষার্থী ভর্তি হয়নি। এমনকি শিক্ষকরা বাড়িতে বাড়িতে গিয়েও শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে পারছেন না। বিশেষ করে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় যেখানে ভর্তিতে কোনো ধরনের টাকা নেওয়া হয় না, সেখানেও ভর্তির হার ব্যাপকভাবে কমেছে। ঢাকার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর চিত্রও প্রায় একই। তবে শহরাঞ্চলের নামি-দামি স্কুলগুলোর ভর্তিতে কোনো প্রভাব পড়েনি।  

জানা যায়, ২০১৯ সালে প্রাথমিকে ঝরে পড়ার হার ছিল ১৭.৯ শতাংশ আর মাধ্যমিকে এই হার ছিল ৩৭.৬২ শতাংশ। ২০২১ সালে এই ঝরে পড়ার হার অনেক বাড়বে বলেই নিশ্চিত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তাঁরা বলছেন, ঝরে পড়ার পেছনে অন্যতম কারণ দারিদ্র্য ও বাল্যবিয়ে। বিশেষ করে শহরের বস্তিবাসী এবং চর ও হাওর অঞ্চলের শিশুরাই বেশি ঝরে পড়ে। করোনার কারণে এসব পরিবারে দারিদ্র্য আগের চেয়ে বেড়েছে।

বাংলাদেশে এখন ২০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। করোনার কারণে আরো ২০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নামতে পারে। সম্প্রতি পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) এক যৌথ গবেষণায় দেখা যায়, করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে তৈরি হওয়া পরিস্থিতির প্রভাবে শহরের নিম্ন আয়ের মানুষের আয় কমেছে ৮২ শতাংশ। আর গ্রামাঞ্চলের নিম্ন আয়ের মানুষের আয় ৭৯ শতাংশ কমেছে। অনেক ক্ষেত্রে তাঁরা কোনো রকমে তিন বেলা খেতে পারলেও পুষ্টিমান রক্ষা করতে পারছেন না। 

গত সপ্তাহে প্রকাশিত এডুকেশন ওয়াচের অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদন ২০২১-এ ঝরে পড়ার ব্যাপারে উদ্বেগজনক মতামত পাওয়া যায়। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রাথমিকের ৩৮ শতাংশ শিক্ষক মনে করেন বিদ্যালয় খুলে দেওয়ার পরও শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি কমে যেতে পারে। ২০ শতাংশ মনে করেন, ঝরে পড়ার হার বাড়বে এবং ৮.৭ শতাংশ মনে করেন, শিক্ষার্থীরা শিশুশ্রমে নিযুক্ত হতে পারে। মাধ্যমিকের ৪১.২ শতাংশ শিক্ষক মনে করেন, বেশি শিক্ষার্থী ক্লাসে অনুপস্থিত থাকতে পারে। ২৯ শতাংশ মনে করেন, ঝরে পড়ার হার বাড়বে। ৪০ শতাংশ অভিভাবক মনে করেন, শিক্ষার্থীদের অনিয়মিত উপস্থিতির হার বাড়বে এবং ২৫ শতাংশ মনে করেন, ঝরে পড়ার হার বাড়বে।

৪৭ শতাংশ জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মনে করেন, শিক্ষার্থীদের অনুপস্থিতের হার বাড়বে, ৩৩.৩ শতাংশ মনে করেন ঝরে পড়া বাড়বে এবং ২০ শতাংশ মনে করেন, অনেকেই শিশুশ্রমে যুক্ত হতে পারে। ৬৪ শতাংশ এনজিও কর্মকর্তা মনে করেন, শিক্ষার্থীদের অনুপস্থিতির হার ও ঝরে পড়া বাড়বে।

গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে. চৌধূরী বলেন, ‘করোনায় দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। অনেক পরিবারেই দারিদ্র্য বেড়েছে। অনেকেই শিশুশ্রমে যুক্ত হয়েছে। স্কুল খোলার পর সব শিশুকে ফিরিয়ে আনতে একটি অভিযান পরিচালনা করা প্রয়োজন। শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের সচেতনতার পাশাপাশি আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। এ ছাড়া সরকারের একটা প্রণোদনা দেওয়া দরকার। সেটা হতে পারে মিড ডে মিল বা দুপুরের গরম খাবার। এ ছাড়া পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের জন্য এক্সট্রা ক্লাসেরও ব্যবস্থা করতে হবে। স্কুলগুলোতে সার্বিক তদারকিও বাড়াতে হবে।’

দেশে করোনার প্রাদুর্ভাব শুরুর পর গত ১৭ মার্চ থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। আগামী ৩০ জানুয়ারি পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটি রয়েছে। করোনায় পড়ালেখা অব্যাহত রাখতে সংসদ টেলিভিশনে ক্লাস সম্প্রচার করা হয়। এ ছাড়া শহরাঞ্চলের নামি-দামি স্কুলগুলো নিজেরাই জুম, গুগলসহ নানা মাধ্যমে অনলাইনে ক্লাস নিচ্ছে। কিন্তু মফস্বলে টেলিভিশন না থাকা, ডিভাইসের অভাব, ইন্টারনেটের উচ্চ দাম ও দুর্বল নেটওয়ার্কের কারণেও অনেক শিক্ষার্থী ক্লাস করতে পারেনি। ফলে দরিদ্র পরিবারের শিশুরা গত বছরের পুরোটাই ছিল পড়ালেখার বাইরে। এতে শিক্ষায় বড় বৈষম্যের সৃষ্টি হয়েছে।

করোনাকালে কিন্ডারগার্টেনগুলো সবচেয়ে বেশি দুরবস্থায় রয়েছে। সার্জন স্কুল অ্যান্ড কলেজের চট্টগ্রামে চারটি ও ঢাকায় একটি ক্যাম্পাস রয়েছে। প্রতিবছর তাদের পাঁচটি ক্যাম্পাসে নতুন প্রায় ৫০০ শিক্ষার্থী ভর্তি হয়। কিন্তু এবার এখন পর্যন্ত হাতে গোনা কয়েকজন শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছে। এই স্কুলের প্রধান ও বাংলাদেশে কিন্ডারগার্টেন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ঐক্য পরিষদের চেয়ারম্যান এম ইকবাল বাহার চৌধুরী বলেন, ‘সারা দেশের ৬০ হাজার কিন্ডারগার্টেন স্কুলে প্রায় ৮০ লাখ শিক্ষার্থী লেখাপড়া করে। প্রতিবছর এই সময়ে স্কুলগুলো থাকে জমজমাট। কিন্তু এবার এসব স্কুলে এক লাখ শিক্ষার্থীও ভর্তি হয়নি। বেশির ভাগ কিন্ডারগার্টেনে নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তানরাই বেশি পড়ে। দ্রুত স্কুলগুলো খুলে না দিলে অনেক শিক্ষার্থী ঝরে পড়বে।’

পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলার নলুয়াবাগী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে চলতি বছর ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছে ৮০ শিক্ষার্থী। অথচ গত বছর ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিল ১০৫ জন। এ বছর বিভিন্ন শ্রেণিতে মোট ভর্তি হয়েছে ২৮৫, গত বছর ছিল ৩৭৫ জন। ওই স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী সুজনকে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি করা হয়নি। সুজনের বাবা রফিকুল ইসলাম প্যাদ্যা বলেন, ‘ক্লাস অয় না, আবার স্কুলে ভর্তি অইয়া লাভ কি। যহন ক্লাস অইবে তখন ভর্তি করামু পোলারে।’ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মুহাম্মাদ মতিয়ার রহমান বলেন, ‘করোনায় স্কুল বন্ধ, তাই স্কুলে ভর্তি হওয়ার জন্য দরিদ্র শ্রেণির অভিভাবকদের কোনো মাথাব্যথা নেই। তাই বাড়ি বাড়ি গিয়ে শিক্ষার্থীদের স্কুলে ভর্তি করানো হচ্ছে। মূলত করোনার কারণে তারা আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে।’

গলাচিপা উপজেলার ৩৯ নম্বর পানপট্টি নুরিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গত বছর প্রাক-প্রাথমিকে ২৮ শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছিল। অথচ এ বছর ওই বিদ্যালয়ে প্রাক-প্রাথমিকে ভর্তির সংখ্যা ১৬। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. রেফায়েতুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের উপকূলীয় বেশির ভাগ স্কুলে গরিব অভাবী পরিবারের সন্তানরা লেখাপড়া করে। করোনার কারণে ক্লাস বন্ধ থাকায় অভিভাবকসহ শিক্ষার্থীরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে।’

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরের কাইতলা যজ্ঞেশ্বর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ লিয়াকত আলী জানান, ‘গত বছর আমাদের স্কুলে ভর্তি হয়েছিল ২৮৫ জন; এ বছর ২১৫ জন ভর্তি হয়েছে।’ আখাউড়ার আমোদাবাদ শাহ আলম উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জানান, গত বছর ষষ্ঠ শ্রেণিতে ১৮৭ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হয়; এ বছর ভর্তি হয়েছে ১১৩ জন। এ ছাড়া গত বছর মোট শিক্ষার্থী ছিল ৬৫৮ জন। বর্তমানে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীসহ সংখ্যা ৪২০ জন।

মাদারীপুর সদর উপজেলার শহীদ সুফিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক নুরজাহান বেগম বলেন, ‘গত বছর আমাদের শিশু শ্রেণিতে ২৩ জনসহ অন্যান্য শ্রেণি মিলে প্রায় ৩৫ জন নতুন শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছিল। এ বছর এখন পর্যন্ত শিশু শ্রেণিতে ১৭ জন ও অন্যান্য শ্রেণিসহ ২২ জনের মতো ভর্তি হয়েছে।’

নীলফামারী জেলা সদরের পঞ্চপুকুর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. বাবুল হোসেন জানান, গত বছর ষষ্ঠ শ্রেণিতে নতুন শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছিল ১৯০ জন; এবার ভর্তি হয়েছে মাত্র ১৫০ জন। গত বছর শিক্ষার্থী ভর্তিতে কোনো বেগ পেতে না হলেও এবার বিভিন্ন গ্রামের বাড়ি বাড়ি ঘুরতে হয়েছে।

একই জেলার ডোমার উপজেলার আমবাড়ী মাঝাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ভুপেন্দ্র নাথ রায় বলেন, গত বছর প্রাক-প্রাথমিকে ২৩ জন শিশু ভর্তি হয়েছিল; এবার হয়েছে মাত্র ১২ জন। করোনার কারণে অভিভাবকরা শিশুদের ভর্তির ব্যাপারে তেমন গুরুত্ব্ব দিচ্ছেন না।

সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার জয়নগর বাজার হাজী গণিবক্স উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. লিলু মিয়া বলেন, ‘গত বছর এই সময়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ২২০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছিল; কিন্তু এবার ১৮৬ জন ভর্তি হয়েছে। করোনার কারণে অনেকেই এবার দূরে কাজে যেতে পারেনি। তাই এবার শিক্ষার্থী ভর্তির হার বেশি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বাস্তবে ভর্তি হয়েছে কম।’

সুনামগঞ্জ জেলার জামালগঞ্জ উপজেলার আব্দুল মুকিত হাই স্কুলে গত বছর ১০৮ জন শিক্ষার্থী ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিল। কিন্তু এবার এখন পর্যন্ত ৮২ জন ভর্তি হয়েছে। প্রধান শিক্ষক মো. সুলতান আহমদ বলেন, অভিভাবকরা শিশুদের স্কুলে ভর্তি করানোর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। এতে ঝরে পড়ার হার বাড়বে।

হাইকোর্টের আদেশ পেলে আইনি লড়াইয়ে যাবে বুয়েট: উপ-উপাচার্য - dainik shiksha হাইকোর্টের আদেশ পেলে আইনি লড়াইয়ে যাবে বুয়েট: উপ-উপাচার্য প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ: তৃতীয় ধাপের ফল প্রকাশ হতে পারে আগামী সপ্তাহে - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ: তৃতীয় ধাপের ফল প্রকাশ হতে পারে আগামী সপ্তাহে ভূমির জটিলতা সমাধানে ভূমিকা রাখবেন নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা - dainik shiksha ভূমির জটিলতা সমাধানে ভূমিকা রাখবেন নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা সর্বজনীন শিক্ষক বদলি চালু হোক - dainik shiksha সর্বজনীন শিক্ষক বদলি চালু হোক ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের বিএসসির সমমান দিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কমিটি - dainik shiksha ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের বিএসসির সমমান দিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কমিটি রায় জালিয়াতি করে পদোন্নতি: শিক্ষা কর্মকর্তা গ্রেফতার - dainik shiksha রায় জালিয়াতি করে পদোন্নতি: শিক্ষা কর্মকর্তা গ্রেফতার কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0047440528869629