স্বাধীনতার আগামীকাল - দৈনিকশিক্ষা

স্বাধীনতার আগামীকাল

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাস বেশ ঘটনাবহুল। ছাত্রাবস্থায় ব্রিটিশ আন্দোলন দেখেছি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব দেখেছি, স্বাধীনতা আন্দোলন দেখেছি। তার পরে পাকিস্তান হলো, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন হলো। যুক্তফ্রন্টের বিজয় এবং সামরিক শাসন দেখলাম। পরে শুরু হলো মানুষের বিক্ষোভ। উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান হলো, নির্বাচন হলো। একাত্তরের যুদ্ধের মাধ্যমে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হলো। রাষ্ট্রকে বাদ দিয়ে সমাজে পরিবর্তন আনয়ন সম্ভব হলো না। কিন্তু মানুষের জন্য সামাজিক পরিবর্তন ছিল আবশ্যক। অথচ সামাজিক পরিবর্তনের বিরুদ্ধে থেকেছে ব্রিটিশ আমলের রাষ্ট্র, পাকিস্তান রাষ্ট্র। এমনকি একাত্তরের স্বাধীনতার পরও যে নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলো সেই রাষ্ট্রও সামাজিক পরিবর্তন তথা সমাজ বিপ্লবের পক্ষে কাজ করল না। এ রাষ্ট্র ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলের মতোই একটি আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদী রাষ্ট্র হয়ে রইল। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক আদর্শে পুঁজিবাদী রাষ্ট্র এবং ব্যবস্থাপনায় আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্র। আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলো ভোটের জন্য জনগণের কাছে গেলেও তারা জনগণের ওপর নির্ভর করে না। অস্ত্র, কালো টাকা ও সন্ত্রাসের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। ক্ষমতায় থাকার জন্য তারা সাম্রাজ্যবাদের ওপর নির্ভর করে। ক্ষমতার দ্বন্দ্বের কারণে সরকারি ও বিরোধী দল সাম্রাজ্যবাদের কৃপালাভে সচেষ্ট। এই দুই দলের বিপরীতে কোনো ভালো বিকল্প না পেয়ে জনগণ আওয়ামী লীগ-বিএনপি, এই দুই দলকে পর্যায়ক্রমে ভোট দিয়ে এসেছে। কিন্তু জনগণের ভাগ্য তথৈবচ। সোমবার (১৬ ডিসেম্বর) কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।

নিবন্ধে আরও জানা যায়, জনমতের প্রতি উপেক্ষা করেই এই দুই দল জামায়াত ও হেফাজত দুই সাম্প্রদায়িক দলের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে।

এতে স্বাধীনতার মূল লক্ষ্য এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। অতীতের ইরাকে মার্কিন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আমাদের দেশে সর্বজনীন হয়নি। বামপন্থী ও মৌলবাদীরা সেই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তবু দৃষ্টিগ্রাহ্য প্রতিবাদ করেছে; বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণ তাতে ছিল না। এতেই বোঝা যায় তারা কত বেশি সাম্রাজ্যবাদনির্ভর। সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে আপস ও তোষামোদ করে ক্ষমতায় থাকে এ দেশের শাসক দল। স্বাধীন এ রাষ্ট্রের বিকেন্দ্রীকরণ দরকার শুধু নয়, ছিল অতি আবশ্যিক। ক্ষমতা শুধু সচিবালয়ে কেন্দ্রীভূত না রেখে স্থানীয়ভাবে ছড়িয়ে দেওয়া উচিত ছিল। নৈতিকতার উপাদানকে কাজে লাগাতে হবে, শক্তিশালী করতে হবে। এমন রাষ্ট্র গড়ে তুলতে হবে, যেখানে সাম্রাজ্যবাদের প্রতি আপস থাকবে না, সন্ত্রাসের লালন হবে না এবং সংখ্যালঘুর ওপর নিপীড়ন ও অনিরাপত্তা থাকবে না।

প্রয়োজন মুক্তিযুদ্ধের চেতনাসম্পন্ন একটি বিকল্প ধারা ছিল অথচ স্বাধীনতার ৪৭ বছর অতিক্রান্তেও সেটি পূরণ হলো না। অধরাই রয়ে গেল। যার সামনে লক্ষ্য হিসেবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা থাকবে। যে গণতন্ত্রে সমাজতন্ত্রের উপাদান আছে, যে ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তি হলো ইহজাগতিকতা এবং যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদমুক্ত অঙ্গীকার আছে; সেই ধরনের অঙ্গীকার নিয়ে রাষ্ট্রব্যবস্থা গঠনের জন্য গণভিত্তিক রাজনৈতিক দল গঠন করা প্রয়োজন। আমাদের দুর্ভাগ্য, বাম দলগুলো সেই সুযোগ কাজে না লাগিয়ে দশকের পর দশক ব্যর্থ হয়েছে। বাম দলগুলো বড় দলের জোটভুক্ত হয়ে কিছুই করতে পারবে না। এসব দল ব্যর্থ হলেও তাদের প্রয়োজন আছে গণচেতনার সংগ্রামের জন্য। তবে তাদের অবশ্যই ক্ষমতার লেজুড়বৃত্তির মোহ ত্যাগ করতে হবে। তাদের প্রধান কাজই হবে জনগণের মুক্তির লক্ষ্যে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসেছে প্রধান দলগুলোর ব্যর্থতা ও দুর্বলতার কারণে। যারা নির্বাচন পরিচালনা করতে পারে না—তারা দেশ চালাবে কী করে? রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আদর্শবাদিতা নিম্নস্তরে নেমে গেছে, স্বার্থবাদিতা প্রবল হয়েছে। ছাত্ররাজনীতিকে চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসের অভিমুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। আগে ছাত্ররা রাজনীতি করত জনগণের পাশে দাঁড়ানোর জন্য। এখন করে অর্থনৈতিক মুনাফা ও লুণ্ঠনের অভিপ্রায়ে।

নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের পর দেশে জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় এসেছে একের পর এক সরকার কিন্তু এতে সন্ত্রাস বেড়েছে। সন্ত্রাস দমনের জন্য সত্যিকার কার্যকর পদক্ষেপ কোনো ক্ষমতাসীন সরকারই নেয়নি। বিপরীতে দলীয় রাজনীতির অনুকম্পায় সন্ত্রাসীদের দণ্ড মওকুফসহ নানাভাবে ছাড় দেওয়া হয়েছে। অতি সম্প্রতি ৭ই মার্চ সরকারি দলের মিছিলটি অতর্কিতে এক কলেজগামী ছাত্রীকে প্রকাশ্যে নিগ্রহ করল। অথচ অপরাধীদের দায়িত্ব সরকার নিল না। আক্রান্ত ছাত্রীটি ফেসবুকে লিখেছে, ‘শান্তিনগর মোড়ে এক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকেও কোনো বাস পাইলাম না। হেঁটে গেলাম বাংলামোটর। বাংলামোটর যাইতেই মিছিলের হাতে পড়লাম। প্রায় ১৫-২০ জন আমাকে ঘিরে দাঁড়াইল। ব্যস! যা হওয়া থাকে তাই। কলেজ ড্রেস পরা একটা মেয়েকে হ্যারাস করতেছে এটা কেউ কেউ ভিডিও করার চেষ্টা করতেছে। কেউ ছবি তোলার চেষ্টা করতেছে। আমার কলেজ ড্রেসের বোতাম ছিঁড়ে গেছে। ওড়নার জায়গাটা খুলে ঝুলতেছে। ওরা আমাকে থাপড়াইছে। আমার শরীরে হাত দিছে। আমার দুইটা হাত এতগুলো হাত থেকে নিজের শরীরটাকে বাঁচাইতে পারে নাই। একটা পুলিশ অফিসার এই মলেস্টিং চক্রে ঢুকে আমাকে বের করে অ্যান্ড একটা বাস থামায়ে বাসে তুলে দেয়। বাকিটা পথ সেইফলি আসছি। প্রচণ্ড শরীর ব্যথা ছাড়া আর কোনো কাটাছেঁড়া নাই। মেন্টালি ভয়াবহ বিপর্যস্ত, বাট শারীরিকভাবে ভালো আছি। আমি এই শুয়োরদের দেশে থাকব না। জয় বাংলা বলে যারা মেয়ে মলেস্ট করে তাদের দেশে আমি থাকব না। থাকব না। থাকব না...’

নির্বাচিত সরকার সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে আপস করেছে। আদমজী পাটকল বন্ধ করেছে, শ্রমিকদের বেকার করা হয়েছে। মানুষের জীবন-জীবিকার কোনো নিশ্চয়তা নেই। খুন, ধর্ষণ, লুণ্ঠন এবং সংখ্যালঘু নিপীড়ন প্রবল হয়েছে। দুর্নীতি ও মানবাধিকার লঙ্ঘন বেড়েছে, বিরোধী নেতাকর্মীদের ওপর নির্যাতন ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিরোধী দল দেশে থাকবে বলে মনে হচ্ছে না। আইন-শৃঙ্খলার চরম অবনতি ঘটেছে। দেশ দুর্নীতির শীর্ষে অবস্থান করছে, জনগণের গচ্ছিত টাকা ব্যাংক থেকে লোপাট হয়ে যাচ্ছে। আর্থিক অনিয়ম-দুর্নীতির কাছে দেশ এখন অতীতের সব আর্থিক অনিয়ম-দুর্নীতি ম্লান হয়ে পড়েছে। সন্ত্রাসের ঝুঁকিপূর্ণ রাষ্ট্র হয়েছে। বাংলাদেশের সমাজ মনুষ্য বসবাসের অযোগ্য, তা নরকে পরিণত হয়েছে। দুই প্রধান দল ইরাকে আগ্রাসনের জন্য ইঙ্গ-মার্কিন বাহিনীর বিরোধিতা করতে পারেনি। এ দেশের বুর্জোয়া তথাকথিত জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দল দেশবিরোধী, গণবিরোধী। রাষ্ট্রের চরিত্র বদলের জন্য তারা কিছুই করেনি। মৌলবাদের অন্ধকার থেকে, সাম্প্রদায়িকতার ছোবল থেকে, লুটেরা পুঁজির দুঃশাসন থেকে মুক্তির জন্য আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে প্রকৃত দেশপ্রেমিকদের। নির্বাচনে লাভ হয় রাজনীতিক, ব্যবসায়ী ও ক্ষমতাসীন দলের আর ক্ষতি হয় দুর্বল ও সংখ্যালঘু শ্রেণির। বড় দলগুলো লুণ্ঠনজীবী; ক্ষমতাসীনরা একচেটিয়া লুণ্ঠন করে। গণমাধ্যমকেও একচেটিয়াভাবে ভোগ করে চলেছে সরকারি দল। তারা বিরোধী দলকে লুণ্ঠনের সুযোগ দেয় না। ক্ষমতাসীনরা ক্ষমতা ব্যবহার করে দখল, লুণ্ঠন ও প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য। দেশি-বিদেশি সুযোগ তারা কুক্ষিগত করে, জনগণকে বঞ্চিত করে।

বাংলাদেশ জাতিরাষ্ট্র নয়, মুসলিম রাষ্ট্রও নয়। এখানে বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিসত্তা রয়েছে। বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। বড় দুটি দল নিজেদের জাতীয়তাবাদী বলে বড়াই করে। অথচ ক্ষুদ্র জাতিসত্তার কোনো স্বীকৃতি দিতে চায় না। সচেতন আদর্শবাদী মধ্যবিত্ত ও শ্রমজীবীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মাধ্যমে সব জাতিসত্তার সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার ভিত্তিতে বাংলাদেশকে গড়ে তুলতে হবে। ঘরে-বাইরে নৃশংসতা ও ভোগবাদিতা প্রবল হচ্ছে। সমাজ রূপান্তরের জন্য সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণের মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী স্থানীয় ও জাতীয় আন্দোলন গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি।

রাষ্ট্র ও রাজনীতির মাধ্যমেই সমাজ বদলাতে হবে। রাজনীতিকদের দুর্বলতা ও ব্যর্থতার কারণে সেনাবাহিনী ক্ষমতায় আসে, আমলারা ক্ষমতা গ্রহণ করে। অথচ আর্মি কোনো রাজনৈতিক দল নয়, আমলারাও কোনো রাজনৈতিক দল নয়। জাতীয় উন্নয়নে রাষ্ট্রকেই উপায় বের করতে হবে। জনগুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ও স্থানীয় ইস্যু নিয়ে রাজনীতি করা দরকার, অথচ বড় রাজনৈতিক দলগুলো তা করে না। স্থানীয় পর্যায়ে সন্ত্রাস দমন, দুর্বল ও সংখ্যালঘুর নিরাপত্তা বৃদ্ধি, যুব উন্নয়নে পাঠাগার স্থাপন, প্রশিক্ষণ দান ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা, দুর্যোগে-বিপদে সাহায্য-সহযোগিতা করা রাষ্ট্রের কর্তব্য। সরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা নেই, শ্রমিকের কর্মসংস্থান নেই বরং চালু কলকারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, সাম্রাজ্যবাদ ও দুর্নীতি প্রভৃতি জাতীয় পর্যায়ের প্রধান ইস্যু এখন। এসব জাতীয় ইস্যু নিয়ে আন্দোলনের বিকল্প কিছু নেই।

আন্দোলনের মাধ্যমে শক্তি বৃদ্ধি করা যায়। সব পর্যায়ে আন্দোলন প্রয়োজন। গণসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য সংস্কৃতিকর্মী ও ছাত্ররা কাজ করবেন। এ ব্যাপারে আবৃত্তি, নাটক, গান, পাঠচক্র, আলোচনা সভা করা প্রয়োজন। নেতৃত্ব ওপর থেকে আসবে না, স্থানীয় পর্যায় থেকে তা গঠন করতে হবে। ছাত্র ও সংস্কৃতিকর্মীকে আমরা গুরুত্ব দেব। শ্রেণিচ্যুতরা গরিবদের পাশে দাঁড়াতে পারে কিন্তু আদর্শচ্যুতরা তা পারবে না। স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে পেশাগতদের আন্দোলন দরকার। স্থানীয় সরকার গুরুত্বপূর্ণ। স্থানীয় উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দু করা দরকার স্থানীয় সরকারকে। সিভিল সোসাইটিকে আমি তেমন গুরুত্বপূর্ণ মনে করি না। তারা নিজেদের অরাজনৈতিক বলে ঘোষণা দেয়, কিন্তু কাজটা করে রাজনৈতিক। সিভিল সোসাইটি নতুন ধারণা; এটি আগে ছিল না। তারা দারিদ্র্য বিমোচনের কথা বলে; অথচ রাষ্ট্রের দায়িত্ব দারিদ্র্য বিমোচন করা, শিক্ষা বিস্তার করা। শিক্ষা দিয়ে কী হবে যদি শিক্ষিতদের কর্মসংস্থান করা না যায়? এনজিও বিস্তৃত হচ্ছে সরকারের ব্যর্থতা ও দুর্বলতার কারণে। দাতারা সরকারের পাশাপাশি এনজিওদের দিয়ে কাজ করায়। সরকারের কাছ থেকে ভালো কাজ না পেয়ে দাতারা এনজিওদের টাকা দেয়, তৎপরতা বাড়িয়ে দেয়। সরকারের সমান্তরাল এনজিওর প্রতিনিধিদের বিদেশ ভ্রমণ করানো, তাদের প্রশংসা করা ও পুরস্কৃত করার ব্যবস্থা করা হয়। পশ্চিমবঙ্গে বাংলাদেশের মতো এনজিওর এত তৎপরতা নেই। সেখানে আছে পঞ্চায়েত ব্যবস্থা। এনজিওর কর্মকর্তাদের জীবনের সঙ্গে গরিবদের জীবনের কেনো মিল নেই। সরকারি আমলার সমান্তরালে তাই এনজিও প্রতিনিধিদের দাঁড় করানো হচ্ছে। সিভিল সোসাইটির লোকেরা এনজিওর প্রতিনিধি, তারা রাজনীতিক নয়।

এতদিন চালু ছিল আধুনিকতা মানে পাশ্চাত্যকরণ। আধুনিকতা মানেই আমেরিকানায়ন, ইউরোপীয় ভাবধারায় চালিত হওয়া। এই ধারণায় অতি দ্রুত পরিবর্তন ঘটেছে, মোহ ভেঙে গেছে। এখন আধুনিকতা বলতে আমেরিকান আধুনিকতাকে বোঝায় না। কারণ আমেরিকান আধুনিকতার মধ্যে যে একটা বর্বরতা ও নিষ্ঠুরতা আছে, সেটা লক্ষণীয়। আধুনিকতার প্রয়োজনে এখন দরকার সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা, মাতৃভাষার চর্চা, নিজস্ব সংস্কৃতিকে বিকশিত করা। আর একটি দার্শনিক মতবাদ হলো উত্তরাধুনিকতাবাদ। এটির মোহ এ দেশের তরুণ সমাজ কাটিয়ে উঠতে পেরেছে। উত্তরাধুনিকতার প্রবণতা হলো খণ্ড-বিখণ্ডতা, বিচ্ছিন্নতা। এটি পরিবার, সমাজ, প্রতিষ্ঠান, নারী-পুরুষ, ট্রেড ইউনিয়ন প্রভৃতির মধ্যে দ্বন্দ্ব-বিচ্ছিন্নতার ধারণা ও তৎপরতাকে উসকে দিয়েছে। উত্তরাধুনিকতাবাদ বিশ্বায়ন ও সাম্রাজ্যবাদের দর্শন। বিশ্বায়ন মানেই আধিপত্য; সেটা আন্তর্জাতিকতাবাদের বিরোধী। আন্তর্জাতিকতাবাদে বহু জাতি ও বহু ভাষার অস্তিত্ব আছে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে নানা ভাষার অনুমোদন আছে। আমেরিকার নেতৃত্বে যে বিশ্বায়ন সৃষ্টি হয়েছে, তার আধিপত্যবাদী হাতিয়ার হচ্ছে ইংরেজি ভাষা। সব রকমের আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে এ ভাষা ব্যবহৃত হচ্ছে। কিন্তু ভাষার মাধ্যমে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন মেনে নেওয়া যায় না। আমাদের দাঁড়াবার জায়গা হচ্ছে সংস্কৃতি। সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্রে মাতৃভাষার গুরুত্ব বেড়েছে। আমরা গণতান্ত্রিক বিশ্ব চাই, কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী, পুঁজিবাদী ও আধিপত্যবাদী বিশ্ব চাই না। আমরা এমন গণতান্ত্রিক বিশ্ব চাই, যেখানে সম-অধিকার ও সহমর্মিতা হবে সম্পর্কের ভিত্তি। রাষ্ট্রের অধীনে নাগরিকদের অধিকার সংহত থাকবে।

সাম্রাজ্যবাদ আকাশে থাকে না। তাদের প্রতিনিধিরাই দেশ শাসন করে। সাম্রাজ্যবাদ আধিপত্য বিস্তার করছে আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির প্রভু হয়ে। সাম্রাজ্যবাদ তথাকথিত বিশ্বায়নের রূপ নিয়ে সব সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য বিলুপ্ত করে দিয়ে পদানত করতে চায় সারা বিশ্বকে। পৃথিবী এখন সাম্রাজ্যবাদ আর সাম্রাজ্যবাদবিরোধী—এই দুই ভাগে বিভক্ত। বাংলাদেশে যাঁরা উদারনীতির চর্চা করেছেন এবং যাঁরা ভেবেছেন উদারনীতির মাধ্যমে একটা ইতিবাচক সামাজিক পরিবর্তন আসবে, আজ তাঁরাও বুঝতে পেরেছেন সাম্রাজ্যবাদ কত নৃশংস ও আক্রমণাত্মক হতে পারে। আমাদের মাটির নিচে যে সামান্য প্রাকৃতিক সম্পদ আছে, যে তেল ও গ্যাস আছে, সাম্রাজ্যবাদের চোখ পড়েছে সেখানেও। তারা তা দখল করে নিতে পারে যেকোনো সময়ে। আঞ্চলিক অখণ্ডতা ও রাজনৈতিক স্বাধীনতার কোনো মূল্য নেই তাদের কাছে। এই উপলব্ধিটি সর্বজনীন হয়েছে। জাতিসংঘ একটি অকার্যকর-ব্যর্থ প্রতিষ্ঠান। তারা মার্কিনিদের সব হামলা-আগ্রাসনের বৈধতা দিয়ে এসেছে। কিন্তু আমাদের দাঁড়াতে হবে সেই বড় শক্তি  সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে। আমাদের স্থানীয়ভাবে কাজ করতে হবে, ক্ষুদ্র আন্দোলন করতে হবে মুক্তির জন্য। এর পাশাপাশি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বড় আন্দোলন প্রয়োজন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে। গণমুক্তির লক্ষ্যে এ উপলব্ধিকে কাজে লাগাতে হবে। নয়তো বছরান্তে স্বাধীনতা দিবস আসা-যাওয়া করবে। আমাদের সমষ্টিগত স্বাধীনতা ও মুক্তি নিশ্চিত হবে না।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

সব মাদরাসার ওয়েবসাইট ও তথ্য হালনাগাদের নির্দেশ - dainik shiksha সব মাদরাসার ওয়েবসাইট ও তথ্য হালনাগাদের নির্দেশ অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক : দুই মন্ত্রণালয় যা করবে - dainik shiksha অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক : দুই মন্ত্রণালয় যা করবে নার্সিং-মিডওয়াইফারি ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ - dainik shiksha নার্সিং-মিডওয়াইফারি ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করার বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রী যা জানালেন - dainik shiksha চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করার বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রী যা জানালেন গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ, পাস ৩৬.৩৩ শতাংশ - dainik shiksha গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ, পাস ৩৬.৩৩ শতাংশ দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে বেসরকারি শিক্ষকদের বদলির উদ্যোগ স্থগিতের নেপথ্যে - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষকদের বদলির উদ্যোগ স্থগিতের নেপথ্যে শিক্ষাখাতে অপপ্রচারে ভূয়া অভিভাবক ফোরাম, জাল সনদের অধ্যক্ষ - dainik shiksha শিক্ষাখাতে অপপ্রচারে ভূয়া অভিভাবক ফোরাম, জাল সনদের অধ্যক্ষ please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0083820819854736