হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর জন্মদিন আজ | বিবিধ নিউজ

হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর জন্মদিন আজ

প্রাচ্যবিদ্যা বিশারদ এবং সংস্কৃতের পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর জন্মদিন আজ। তিনি ১৮৫৩ খ্রিষ্টাব্দের এই দিনে খুলনা জেলার কুমিরা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি অগ্রজ বন্ধু ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের আশ্রয়ে থেকে সংস্কৃত কলেজে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হন। এখানে এবং অংশত প্রেসিডেন্সি কলেজে তার ছাত্রজীবন অতিবাহিত হয

প্রাচ্যবিদ্যা বিশারদ এবং সংস্কৃতের পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর জন্মদিন আজ। তিনি ১৮৫৩ খ্রিষ্টাব্দের এই দিনে খুলনা জেলার কুমিরা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি অগ্রজ বন্ধু ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের আশ্রয়ে থেকে সংস্কৃত কলেজে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হন। এখানে এবং অংশত প্রেসিডেন্সি কলেজে তার ছাত্রজীবন অতিবাহিত হয়। ১৮৭১ খ্রিষ্টাব্দে এন্ট্রান্স, ১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দে ফার্স্ট আর্টস, ১৮৭৬ খ্রিষ্টাব্দে বিএ এবং ১৮৭৭ খ্রিষ্টাব্দে সংস্কৃতে অনার্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পরে তিনি এমএ ডিগ্রি ও ‘শাস্ত্রী’ উপাধি অর্জন করেন।

হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর জন্মদিন আজ

 সেসময় এমএ পরীক্ষার ব্যবস্থা ছিলো না, অনার্স গ্রাজুয়েটরা এমএ ডিগ্রি পেতেন। টোল-চতুষ্পাঠীর পরিবর্তে হরপ্রসাদ আধুনিক স্কুল-কলেজে শিক্ষা লাভ করেন। সংস্কৃত কলেজে সংস্কৃত বিষয়ের ছাত্র হলেও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন সিলেবাস অনুযায়ী তাকে বিস্তৃতভাবে ইংরেজি সাহিত্য, দর্শন, ইতিহাস, পলিটিক্যাল ইকনমি, অ্যালজেব্রা-ট্রিগোনোমেট্রি পড়তে হয়েছিলো। 

১৮৭৮ খ্রিষ্টাব্দে হরপ্রসাদ হেয়ার স্কুলে ট্রানস্লেশন শিক্ষক হিসেবে চাকরি জীবন শুরু করেন। একই বছর তিনি কিছুদিন লখনৌ ক্যানিং কলেজে অধ্যাপনা করেন। পরে তিনি ১৮৮৩ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতার সংস্কৃত কলেজে অধ্যাপক ও একই সঙ্গে বঙ্গীয় সরকারের সহকারী অনুবাদক হিসেবে কাজ করেন। সংস্কৃত কলেজে অধ্যাপনার সঙ্গে সঙ্গে ১৮৮৬ থেকে ১৮৯৪ পর্যন্ত তিনি বেঙ্গল লাইব্রেরির লাইব্রেরিয়ান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৮৯৫ খ্রিষ্টাব্দে প্রেসিডেন্সি কলেজে সংস্কৃত বিভাগের প্রধান অধ্যাপক এবং ১৯০০ খ্রিষ্টাব্দে সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ হন।

১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। 

প্রাচ্যবিদ্যাচর্চার অন্যতম প্রতিভা রাজেন্দ্রলাল মিত্রের সহায়তায় ১৮৮৫ খ্রিষ্টাব্দে হরপ্রসাদ এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্য হন। রাজেন্দ্রলালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কাজ ‘দ্য স্যান্সক্রিট বুডিস্ট লিটারেচার অব নেপাল’ গ্রন্থে সংকলিত বৌদ্ধপুরাণের অধিকাংশ অনুবাদ তিনি সম্পন্ন করেন। এশিয়াটিক সোসাইটিতে প্রাচীন ভারতীয় জ্ঞানের আকরস্বরূপ বিভিন্ন ভাষা ও বিষয়ের পুঁথি সংগ্রহ ও পুঁথির বিবরণাত্মক সূচি প্রকাশের প্রকল্প তত্ত্বাবধান করতেন রাজেন্দ্রলাল। তার মৃত্যুতে ১৮৯১ খ্রিষ্টাব্দে জুলাই থেকে হরপ্রসাদ সেই শূন্য পদে ‘Director of the Operations in Search of Sanskrit Manuscripts’-নিযুক্ত হন।

প্রাচীন সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যের পরিচয় উদ্ধারে হরপ্রসাদের অবদান দৃষ্টান্তমূলক। তিনি প্রায় দশ হাজার পুঁথির বিবরণাত্মক সূচি প্রণয়ন করেন, যা এগারো খন্ডে প্রকাশিত হয়। রাজস্থান অঞ্চল থেকে তিনি ভাট ও চারণদের পুঁথি সংগ্রহ করেন। সংস্কৃত পুঁথি সন্ধানের সূত্রেই তার আগ্রহে প্রাচীন বাংলা পুঁথি সংগ্রহের কাজ শুরু হয় এবং এ বিষয়ে তাকে সাহায্য করেন দীনেশচন্দ্র সেন এবং  মুনশি আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ। এশিয়াটিক সোসাইটির গবেষণা প্রকল্পের মধ্যে হরপ্রসাদই প্রথম ‘বাংলা পুঁথি সন্ধান ও বিবরণ প্রকাশ’ কার্যক্রম অন্তর্ভুক্ত করেন।

১৯১৯ ও ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দে দুই বছর হরপ্রসাদ এশিয়াটিক সোসাইটির সভাপতির পদ এবং পরে আজীবন সহসভাপতির পদ অলঙ্কৃত করেন। সোসাইটিতে Descriptive Catalogue সংকলন-সম্পাদনা ছাড়া ভারতের সাহিত্য-সংস্কৃতি ও ইতিহাসের বহু তথ্য তিনি উদ্ধার ও প্রকাশ করেন যার মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য  বৃহদ্ধর্মপুরাণ, সন্ধ্যাকর নন্দীর রামচরিতম্ ও আর্যদেবের চতুঃশতিকা।

১৮৮৫  খ্রিষ্টাব্দে হরপ্রসাদের সহযোগিতায় রমেশচন্দ্র দত্ত ঋগ্বেদসংহিতার অনুবাদ প্রকাশ করেন। রমেশ দত্তের প্রভাবে হরপ্রসাদ অর্থনীতি বিষয়ক ইতিহাসেও আগ্রহী হন এবং পাঁচটি প্রবন্ধ রচনা করেন, যার মধ্যে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের বিরুদ্ধে লেখা ‘নূতন খাজানা আইন সম্বন্ধে কলিকাতা রিভিউর মত’ শীর্ষক প্রবন্ধটি সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। প্রবন্ধটি ১২৮৭ বঙ্গাব্দের বঙ্গদর্শন কার্তিক সংখ্যায় প্রকাশিত হয়।

এশিয়াটিক সোসাইটির জন্য পুঁথি সন্ধানের কাজ করতে গিয়ে হরপ্রসাদ বাংলা ভাষা-সাহিত্য ও সংস্কৃতির উদ্ভব ও বিকাশের পর্ব-পর্বান্তর কালানুক্রম অনুযায়ী স্পষ্ট করে তোলার লক্ষ্যে তথ্য সংগ্রহ, বিশ্লেষণ ও দেশের বিদ্বৎসমাজের কাছে তা উপস্থাপনের জন্য গভীরভাবে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। অনুসন্ধিৎসু হরপ্রসাদ প্রাচীন বাংলার পুঁথির খোঁজে চারবার নেপাল যান ১৮৯৭, ১৮৯৮, ১৯০৭ এবং ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে। ১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দে তার হাতে আসে বাংলার প্রাচীনতম কবিতা-সংগ্রহ চর্যাগীতির পুঁথি। 

হরপ্রসাদের লেখক জীবনের বিস্তার প্রায় ৫৫ বছর। তার সাহিত্য-জীবন বঙ্কিমযুগ থেকে রবীন্দ্রযুগ অবধি প্রসারিত। একটা সময়ের পরে বঙ্কিমচন্দ্রের সাহিত্যাদর্শ থেকে হরপ্রসাদ সরে আসেন। হরপ্রসাদ বহু বিদ্যাপ্রতিষ্ঠানের সম্মাননা পেয়েছেন, যার মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য- ১৮৮৮ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আজীবন ফেলো মনোনয়ন এবং ১৮৯৮ খ্রিষ্টাব্দে সরকারের দেয়া সম্মান ‘মহামহোপাধ্যায়’ উপাধি। ১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ নভেম্বর তিনি পরলোকগমন করেন।