উচ্চ শিক্ষার স্বপ্নে ঘোরে লামিয়ার হুইল চেয়ারের চাকা। মায়ের কোলেই শুরু শিক্ষা জীবন। মায়ের কোলে করেই স্কুলে আসা-যাওয়া প্রাইমারির পাঁচটি বছর। প্রাথমিকের গন্ডি পার হওয়ার পর থেকে শুরু হয় হুইল চেয়ারে চলা। পরিবারের অভাব অনটন কিংবা শারীরিক অক্ষমতা আর শত প্রতিকুলতায়ও হার মানতে নারাজ লামিয়া।
লামিয়ার ভাষায়, ‘আল্লাহ্ এ রকম জীবন দিয়েছে। বিদেশে নিয়ে ডাক্তার দেখানোর ক্ষমতা নাই বাবার। কী করমু লেখাপড়া ছাড়া? লেখাপড়া শিখেই একটা কিছু করতে হবে।’ লামিয়া আরও বলে, ‘আবহাওয়া ভাল না থাকলে স্কুলে যেতে পারি না। মা অসুস্থ কিংবা কাজে ব্যস্ত থাকলে সহপাঠিরা চেয়ার ঠেলে বাসায় পৌঁছে দেয়।’
পটুয়াখালীর বাউফলের ধানদী আদর্শ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ৭ম শ্রেণির ছাত্রী লামিয়া। বাড়ি তেতুলিয়া নদী পাড়ের নিমদী গ্রামে। ক্লাস শেষে মা ঝর্ণা বেগম আর নাফিসা সুলতানা ও জান্নাতুল ফেরদৌসী নামে দুই সহপাঠি হুইল চেয়ার ঠেলে নিয়ে বাসায় নিয়ে যাচ্ছিল লামিয়াকে। এ সময় কথা হয় তার সাথে।
দৈনিক শিক্ষাকে লামিয়া জানায়, ‘শারীরিক প্রতিবন্ধকতার কারণে নানান প্রতিকুলতা অতিক্রম করতে হয়। ভাল পড়াশুনা করে ডাক্তার হয়ে তাই প্রতিবন্ধীদের সেবা করতে চাই।’
লামিয়ার মা ঝর্ণা বেগম জানান, লামিয়া তিন ভাইবোনের মধ্যে দ্বিতীয়। জন্মের পর ছয়মাস বয়স পর্যন্ত স্বাভাবিকই ছিল। হঠাৎ একরাতে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসে লামিয়ার। এরপর নানা ধরনের চিকিৎসা দিয়েও কোনো ফল হয়নি। জ্বর সেরে উঠলেও শারিরিক সক্ষমতা আর ফিরে আসেনি তার। স্বাভাবিকভাবে চলার শক্তি হারায় সে। শরীরের নি¤œাংশসহ দু’পা অচল হয়ে যায়। একপর্যায় ঢাকার এক ডাক্তার তাকে ড়ংঃবড়সধষধপরধ নামক রোগে আক্রান্ত হওয়ায় স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠবে না বলে জানায়।
হুইল চেয়ারের চাকা ঘুরিয়েই এখন চলাচল করে সে। কিন্তু শারীরিক এই অস্বাভাবিকতায়ও দৃঢ় মনোবল আর পড়াশুনায় তার আগ্রহের কোনো কমতি নেই। বয়স যতই বাড়ছে এবং জীবন সম্পর্কে যতই সে বুঝে উঠছে শারীরিক প্রতিবন্ধকতার কথা ভেবে পড়াশুনায় সে আরও মনোযোগি হচ্ছে।
প্রতিদিন হুইল চেয়ার ঠেলে লামিয়াকে স্কুলে নিয়ে যেতে হয় মা ঝর্ণা বেগমকে। সহজে স্কুলে পৌঁছতে নিমদী লঞ্চঘাট এলাকার একটি ঝুপড়িঘরে ভাড়ায় থাকতো লামিয়ারা। সেখান থেকে প্রাইমারি স্কুলে সহজে আনা-নেয়া গেলেও বয়স বাড়ায় কোলে তুলে প্রায় এক কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে লামিয়াকে হাই স্কুলে পৌঁছানো কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে মা ঝর্ণা বেগমের পক্ষে। তাই স্কুল থেকে দেওয়া হুইল চেয়ারে করেই চলতে হয় লামিয়াকে। কখনো মায়ের পক্ষে তাকে স্কুলে পৌঁছানো কিংবা স্কুল থেকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব না হলে সহপাঠিরাই চেয়ার ঠেলে সাহায্য করে।
লামিয়ার মা ঝর্ণা বেগম আরও জানান, ‘অভাবের কারণে জেএসসি পাসের পর ছেলে রাব্বির পড়াশুনা আর হয়নি। তবে ৬ষ্ঠ শ্রেণি পড়–য়া লামিয়ার ছোট বোন সুমাইয়া তার দেখাদেখি পড়াশুনায় আগ্রহী হচ্ছে।
সংসারে একমাত্র উপার্জনকারী লামিয়ার বাবা বাবুল ব্যাপারীর মাছ ধরার সামান্য আয়ে কোনো রকমে সংসার চলে। তারপর লামিয়ার চিকিৎসার খরচ জোগানো, এসবের পর ভেবেছিলেন পড়াশুনা হবে না লামিয়ার। কিন্তু প্রতিদিন বিছানার ওপর বালিশে হেলান দিয়েও বই নিয়ে পড়তে বসে সে। হাল ছাড়েনি লেখাপড়ায়। ভাল ফলাফলে বাধা হয়নি তার শারীরিক প্রতিবন্ধকতা।
লামিয়ার পড়াশুনায় সাহায্য করছেন শিক্ষকরাও। ৭১ নং নিমদী সরকারি প্রাইমারি স্কুল সমাপনী পরীক্ষায় জিপিএ-৪ পায় সে। মায়ের কোলে কোলেই শেষ হয় প্রাইমারি শিক্ষা। ইতিমধ্যে পা রাখে সপ্তম শ্রেণিতে।
ভালো পড়াশুনা করে ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন দেখে লামিয়া। প্রতি ছয় মাসে ৪ হাজার ২শ’ টাকা প্রতিবন্ধি ভাতা পাওয়া আর আর্থিক দৈন্যতার কথা উল্ল্যেখ করে ঝর্ণা বেগম আরও জানান, বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের চিকিৎসা নিতে চায় মেয়েটি। কিন্তু সংসারের খাই-খরচ চালিয়ে তা সম্ভব হয়ে উঠছে না।
শারিরীক অবস্থার কারণে হয়তো ভালো চাকরি পাওয়া যাবে না। তবে ডাক্তার হওয়ার আশা কোন মতেই ছাড়ছে না মেয়েটি। পড়াশুনায় আগ্রহের শেষ নেই।
পিঠে বইখাতা ঝুলিয়ে মায়ের কোলে করে ধানদী আদর্শ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পৌঁছলে বিদ্যালয় থেকে একটি হুইল চেয়ার দেওয়া হয় তাকে। স্কুলে পৌঁছলে সহপাঠিরাও সাহায্য করে তাকে। চেয়ার থেকে তুলে বেঞ্চে বসা, শিক্ষকের কাছে খাতা পৌঁছে দেওয়া, প্রয়োজনে ওয়াশরুমে নিয়ে যাওয়া থেকে বিদ্যালয়ে থাকা কালীন প্রয়োজনীয় তার সব ছোট খাট কাজে সাহায্য করে তার সহপাঠিরা।
লামিয়া সম্পর্কে তার শিক্ষক মাওলানা আব্দুল ওহাব বলেন, ‘পড়াশুনায় বেশ মনোযোগি লামিয়া। কেবল ডাক্তার হওয়ার আশায় শারীরিক প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও এগিয়ে চলেছে লামিয়া। শিক্ষা সচেতনতায় এটা এক ব্যতিক্রম। লামিয়ার আশাপূরণে সমাজের বিত্তবানদের তার পাশে দাঁড়ানো উচিত।’