পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি জালিয়াত চক্রের ৪ সদস্যকে গ্রেফতার করেছে র্যাব। তাদের মধ্যে আনোয়ার হোসেন রোকন নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের একজন ছাত্র রয়েছে। র্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে সে ভর্তি জালিয়াতির চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছে। গতকাল র্যাবের মিডিয়া শাখা থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
গতকাল র্যাবের টিম নীলক্ষেত এলাকায় অভিযান চালিয়ে আনোয়ার হোসেন রোকন, ইসমাইল হোসেন রুবেল, আখতারুজ্জামান খোকন ও জাকারিয়া সরকারকে গ্রেফতার করে। তাদের কাছ থেকে অপহৃত সিকদার মো. সালেহ সৌরভকে উদ্ধার করা হয়।
আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ ও প্রাথমিক অনুসন্ধানে জানা যায়, আটক আসামিরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিচ্ছু ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে তাদের মার্কশিট, সার্টিফিকেট ও প্রবেশপত্রের মূল কপি সংগ্রহ করে। এরপর ছাত্রদের কাছ থেকে অনলাইনে ফরম পূরণের আইডেন্টিফিকেশন নম্বর সংগ্রহ করে প্রবেশপত্র ডাউনলোড করে ফটোশপের মাধ্যমে প্রবেশপত্রের ছবি পরিবর্তন করে অন্য মেধাবী ছাত্রকে দিয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেয়ায়। এর বিনিময়ে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীর অভিভাবকদের নিকট জনপ্রতি ৪,০০০০০/- টাকা হতে ৫,০০০০০/- টাকা পর্যন্ত আদায় করে থাকে।
যদি কোন ভর্তিপ্রার্থী টাকা দিতে অক্ষম হয় তাহলে তারা সেই ছাত্রকে অপহরণ এবং তার মূল মার্কশিট ও সার্টিফিকেট আটক করে বিকাশ, ডাচ-বাংলা মোবাইল ব্যাংকিং, ব্যাংক একাউন্ট বা হাতে হাতে টাকা আদায় করে। এসব কাজে তাকে সার্বিকভাবে সহযোগিতা করে থাকে তার খালাত ভাই আটক মো. ইসমাইল হোসেন রুবেল (২৭)।
অভিযুক্ত আনোয়ার হোসেন রোকন জানায়, অপরাধ চক্রে প্রক্সি ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অনার্স ৪র্থ বর্ষের ছাত্র মো. আশরাফুল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার বিভাগের অনার্স ৪র্থ বর্ষের ছাত্র মো. মাহবুর হোসেন এবং বুয়েটের মেকানিক্যাল অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ৪র্থ বর্ষের ছাত্র জিহান। এরা প্রত্যেকেই পরীক্ষাপ্রতি ১ লাখ টাকা হতে দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত নিয়ে থাকে। উল্লেখ্য, মো. আশরাফুল এভাবে পরীক্ষা দিতে গিয়ে হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে আটক হয় এবং তার ১৯ দিনের জেল হয়।
আসামি রোকন আরও জানায়, ২০১৪-২০১৫ শিক্ষাবর্ষ হতে তার চক্র বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক ছাত্র ভর্তি করেছে। ভর্তি পরীক্ষা সম্পন্ন ও টাকা আদায় হওয়ার পর সে আর যোগাযোগ রক্ষা করে না। তবে যারা পরবর্তীতে জালিয়াতির মাধ্যমে ভর্তি হতে ইচ্ছুক শিক্ষার্থীর সন্ধান দিতে পারে তাদের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখে। এদের মধ্যে রয়েছে জাকারিয়া, খোকন, অমিত কর্মকার, তানভীর, জয়, হাসান, তারেক, আকতার।
আটক আনোয়ার হোসেন রোকন জালিয়াতির মাধ্যমে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে যাদের ভর্তি করেছে তাদের মধ্যে ২০১৬-২০১৭ শিক্ষাবর্ষে, দিনাজপুর হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সালেহ সৌরভ, এগ্রি ইঞ্জিনিয়ারিং মো. রিফাত ইসলাম রবিন, ফুড ইঞ্জিনিয়ারিং আদল বিন আহনাদ, বিবিএ আরিফ হোসাইন। পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে অজয় পাল, কম্পিউটার সাইন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং মারুফ বঙ্গবাসী, কম্পিউটার সাইন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে মো. আলী বোখারী, আইসিটি, টাঙ্গাইল, মাওলানা ভাসানী বিশ্ববিদ্যালয়, আবু সাইদ, বিবিএ, ময়মনসিংহ জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় শেখ তানভীর, ইকোনমিক্সে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে অমিত কর্মকার, গণিত বিভাগে। রোকনকে জিজ্ঞাসাবাদে আরও জানা যায়, দীর্ঘদিন ধরে ভর্তি জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত থাকলেও এর আগে তাকে কোন আইনি ঝামেলায় পড়তে হয়নি।
জিজ্ঞাসাবাদে সে আরও জানায়, তার পরিচিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের মাস্টার্স প্রথম সেমিস্টারের ছাত্র আবু রায়হান ও দেবজিৎ দাশের নেতৃত্বে ২টি চক্র, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইআর বিভাগের মাস্টার্স প্রথম সেমিস্টারের ছাত্র শামীম হোসেন নেতৃত্বে ১টি চক্র, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আলমগীর হোসাইনের নেতৃত্বে আরও ১টি চক্র বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত রয়েছে।
এভাবে উক্ত সংঘবদ্ধ অপহরণকারী চক্র সিকদার মো. সালেহ সৌরভ (১৮), পিতা. মো. আবদুল মতিন সাং-খিলগাতী, থানা-কালিহাতী জেলা-টাঙ্গাইল, বর্তমান ঠিকানা : সাং-১৫০/২, পশ্চিম আকুর টাকুর পাড়া, থানা ও জেলা: টাঙ্গাইলকে জালিয়াতির মাধ্যমে এগ্রি ইঞ্জিনিয়ারিং, ২০১৬-২০১৭ শিক্ষাবর্ষ, হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুরে ভর্তি করে। কিন্তু সৌরভের পিতা টাকা দিতে অক্ষমতা প্রকাশ করলে উক্ত চক্র গত ১৫ এপ্রিল সিকদার মো. সালেহ সৌরভকে (১৮) টাঙ্গাইল থেকে অপহরণ করে। পরবর্তীতে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে তার বাবা মো. আবদুল মতিনের কাছে চার লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে।
বিষয়টি র্যাব-১২ টাঙ্গাইলকে জানানোর পর অপহৃত ছাত্রকে উদ্ধার ও অপহরণ চক্রকে গ্রেফতারের লক্ষ্যে অভিযান পরিচালনা করে এবং নীলক্ষেত হতে গত শুক্রবার গভীর রাতে অভিযান চালিয়ে তাকে উদ্ধার ও আসামিদের গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়।
এই চক্র প্রক্সি পরীক্ষার মাধ্যমে ভর্তি ইচ্ছুক ছাত্রছাত্রী সংগ্রহ করার জন্য এই চক্র সাধারণ ছাত্রছাত্রীকে মোটা অংকের অর্থ প্রদানের প্রস্তাব দিয়ে থাকে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্রদের প্রক্সি পরীক্ষা দিতে উদ্বুদ্ধ করার জন্য প্রার্থী প্রতি ১ লাখ টাকা দিয়ে থাকে। আরও জানা যায়, যারা প্রক্সি পরীক্ষা দিয়ে ভর্তি হয় তারাই পরবর্তীতে অন্য শিক্ষার্থীদের জালিয়াতির মাধ্যমে ভর্তি হতে প্রলুব্ধ করে। এভাবেই এরা সারাদেশব্যাপী ভর্তি জালিয়াতি চক্রের এক বিশাল সিন্ডিকেট গড়ে তোলে।
এই চক্রের অপতৎপরতার ফলে একদিকে যেমন প্রকৃত মেধাবীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ হতে বঞ্চিত হচ্ছে, অন্যদিকে অপেক্ষাকৃত কম মেধাসম্পন্ন শিক্ষার্থীরা টাকার বিনিময়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। এতে করে শিক্ষা জীবনের শুরুতে ভর্তি ইচ্ছুক শিক্ষার্থী, ভর্তি জালিয়াতিতে জড়িত মেধাবী শিক্ষার্থীদের নৈতিকতার চরম অবক্ষয় হচ্ছে। তারা অধ্যয়নরত অবস্থায় পড়ালেখা বাদ দিয়ে জালিয়াতির মাধ্যমে অর্থ উপার্জনের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। এমনকি তারা অপরাপর সহপাঠীদের এধরনের বেআইনি অনৈতিক কাজে প্রলুব্ধ করছে। অন্যদিকে সন্তানের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কামনায় অভিভাবকরা এসব অনৈতিক কাজে অর্থ দিয়ে সহায়তা করছে।
উল্লেখ্য, সংঘবদ্ধ ভর্তি জালিয়াত চক্রের সব সদস্যই বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। এ চক্রের মূল হোতা মো. আনোয়ার হোসেন রোকন (২৬) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। সে রাজগঞ্জ ফাজিল মাদ্রাসা, বেগমগঞ্জ, নোয়াখালী হতে ২০০৬ সালে দাখিল ও ২০০৮ সালে আলিম উভয় পরীক্ষায় গোল্ডেন জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ২০০৯-২০১০ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে জসিম উদ্দিন হলের ২১২নং কক্ষে থাকার সময় একই বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্র আবু রায়হানের সঙ্গে এক হয়ে বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে জালিয়াতির মাধ্যমে ছাত্র ভর্তি করে অবৈধভাবে অর্থ উপার্জনে লিপ্ত হন।