৫০ বছরেও পাঠ্যপুস্তকে পূর্ণাঙ্গ প্রতিফলিত হয়নি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস - দৈনিকশিক্ষা

৫০ বছরেও পাঠ্যপুস্তকে পূর্ণাঙ্গ প্রতিফলিত হয়নি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

‘কথা ছিল একটি পতাকা পেলে/ আমাদের সব দুঃখ জমা দেবো যৌথ-খামারে/ সম্মিলিত বৈজ্ঞানিক চাষাবাদে সমান সুখের ভাগে/ সকলেই নিয়ে যাবো নিজের সংসারে।’ স্বাধীনতার ৫০ বছরে কথা ছিল অনেক কিছুই। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মধ্য দিয়ে কলঙ্ক মোচনে একদিকে মুক্তিযুদ্ধের গৌরবের পথে এগিয়ে যাওয়া, অন্যদিকে মৌলবাদী ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর আস্ফালন এর মধ্যেই উদযাপিত হচ্ছে মুজিববর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের পর রাজনীতির নানান খেলায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আঁচড় লেগেছে বারবার। জাতির পিতা ও জাতীয় চার নেতার হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ হাঁটতে শুরু করেছিল একাত্তরের উল্টো পথে। বৃহস্পতিবার (৪ মার্চ) ভোরের কাগজ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন ঝর্ণা মনি।

 

প্রতিবেদনে আরও জানা যায়, ধর্মনিরপেক্ষতা-সাম্প্রদায়িকতা-ইতিহাস বিকৃতির মহোৎসবে অবহেলিত মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মুখ থুবড়ে পড়েছে বারবার। ফলে ৫০ বছরেও পাঠ্যপুস্তকে পূর্ণাঙ্গ প্রতিফলিত হয়নি মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বগাথা, নির্মম-নিষ্ঠুর গণহত্যা, পৈশাচিক নারী নির্যাতনসহ মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনা। এজন্য অপরাজনীতি ও ভোটের রাজনীতিকেই দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। নতুন প্রজন্মকে একাত্তরের চেতনায় ঋদ্ধ করতে পাঠ্যপুস্তকে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ-ইতিহাসের প্রতিফলনের বিকল্প নেই বলে মনে করছেন তারা। বিশেষজ্ঞদের মতে, রাজনৈতিক চর্চার আড়ালে হারিয়ে গেছে ইতিহাস চর্চা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা পাবলিক স্পেসেও ইতিহাস চর্চা নেই। স্বাধীনতা সংগ্রাম কেবল একাত্তরে শুরু হয়েছে তা নয়; স্বাধীনতা সংগ্রাম সেই ব্রিটিশ আমল থেকেই শুরু। ওই ইতিহাসটাকে আমরা নতুন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরি না। গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার এন্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) ‘আ লুক অ্যাট বাংলাদেশ’স ৫০ ইয়ার জার্নি : টার্নিং পয়েন্টস অব দ্য ইকোনোমি’ প্রতিবেদন অনুযায়ী, স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশ কৃষি, ক্ষুদ্রঋণ ও রেমিট্যান্স আহরণে মাইলফলক ছুঁলেও মানসম্পন্ন শিক্ষার উন্নয়নে খুব বেশি এগোতে পারেনি মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ।

পঞ্চাশ বছরেও পাঠ্যপুস্তকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অবহেলিত ক্ষোভপ্রকাশ করে শিক্ষাবিদ, ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন, মুক্তিযুদ্ধ এখন প্রায় বিস্মৃত। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কী এ বিষয়টি কারো বোধগম্য কিনা তা নিয়ে আমার সংশয় আছে। স্বাধীনতার ৫০ বছরে এসে আমি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা খুঁজে পাই না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা শুধু মুখে আছে কিন্তু বুকে নেই। তিনি বলেন, দিন দিন ধর্মান্ধ গোষ্ঠী বাড়ছে। হেফাজতের সঙ্গে সরকারের সখ্যতা এত দূর গড়িয়েছে, তাদের কথায় পাঠ্যপুস্তক পরিবর্তন করা হয়। তাদের সরকারিভাবে প্রশ্রয় দেয়া হচ্ছে। শেখ হাসিনা এখন কওমি জননী।

এ ব্যাপারে মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের মহাসচিব, লেখক, গবেষক হারুন হাবীব বলেন, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ভিত্তি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। রাষ্ট্রের ভিত্তিকে শক্তিশালী করতে নতুন প্রজন্মকে ইতিহাসের আলোকে বড় হওয়া বাঞ্ছনীয়। একসময় পাঠ্যপুস্তকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা একেবারে অনুপস্থিত ছিল। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিষ্ঠিত করার কাজ করছে। তবে এখনো গণহত্যা, নারী নির্যাতনের বিবরণ পাঠ্যপুস্তকে ওভাবে আসেনি। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথার ইতিহাস পাঠ্যপুস্তকে আসেনি। এটি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। নতুন প্রজন্মকে ইতিহাস সম্পর্কে জ্ঞাত করার জন্য অবশ্যই মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বগাথা, আত্মত্যাগের ইতিহাস সন্নিবেশিত করা জরুরি। শিশু শ্রেণি থেকেই এটি আসা উচিত। তাহলে শিশু বয়স থেকেই ইতিহাসের ওপর দায়বদ্ধ প্রজন্ম তৈরি হবে বলে মন্তব্য করেন রণাঙ্গনের এই বীর মুক্তিযোদ্ধা।

বিশ্লেষকদের মতে, ৫০ বছরে শিক্ষাক্ষেত্রে যুগান্তকারী কিছু সফলতাও দৃশ্যমান। এক্ষেত্রে সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিতকরণে অভিন্ন পাঠ্যসূচি, পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি সুবিধাবঞ্চিতদের জন্য নানামুখী সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি উল্লেখযোগ্য। শিশুদের মধ্যে গণতন্ত্র ও নেতৃত্বের বিকাশ ঘটানোর তাগিদে ২০১০ সাল থেকে সরাসরি ভোটের মাধ্যমে স্টুডেন্ট কাউন্সিল নির্বাচন হচ্ছে। মাল্টিমিডিয়া ক্লাস এবং সংসদ টিভির মাধ্যমে পাঠদানের কৌশল বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। বিশেষ করে বৈশ্বিক করোনা ভাইরাসে অনলাইন পাঠদানের কারণে জিইয়ে রাখা হয়েছে শিক্ষা কার্যক্রম। তবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অবহেলিত থাকার কারণে মর্মাহত শিক্ষাবিদরা। জানতে চাইলে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের উপউপাচার্য ড. মুহাম্মদ সামাদ বলেন, মুক্তিযুদ্ধ কারো কারো কাছে বাস্তবতা, কারো কারো কাছে কাহিনীকথা। আমরা যারা নিজের চোখে মুক্তিযুদ্ধ দেখেছি, তারা দেখেছি এর নির্মমতা, একই সঙ্গে বীরত্বগাথারও সাক্ষী। যারা দেখেননি তারা মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন গল্প পড়েছেন, সিনেমা দেখেছেন, তাদের কাছে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃতি ভিন্ন। ৫০ বছরেও পাঠ্যপুস্তকে মুক্তিযুদ্ধ চেতনা অবহেলিত হওয়ার মূল কারণ ভোটের রাজনীতি। দীর্ঘদিন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি রাষ্ট্রক্ষমতার বাইরে ছিল। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের পর বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতা হত্যাকা-ের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে পাকিস্তানের ভাবধারায় ফিরিয়ে নেয়ার একটা অপচেষ্টা করা হয় এবং তখন থেকেই সারাদেশে ইতিহাস বিকৃতির মহোৎসব চলে, যা সবার জানা। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড, জাতীয় চার নেতা হত্যা, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করেছেন শেখ হাসিনা। এতে অপশক্তিরা আরো দুর্বল হচ্ছে। এখন পাঠ্যপুস্তকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ফিরিয়ে আনার সময়। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ফিরিয়ে আনতে হবে। পাঠ্যপুস্তকে এসবের প্রতিফলন ঘটানো জরুরি। তাহলে নতুন প্রজন্ম ইতিহাসের আলোকে আলোকিত হবে এবং ইতিহাস বিকৃতি থেকে বেরিয়ে আসবে; অন্যদিকে একাত্তরের চেতনায় ঋদ্ধ হবে।

এদিকে ৫০ বছরেও পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি জাতীয় শিক্ষানীতি। এক সরকার শিক্ষানীতি করেছে তো আরেক সরকার বাতিল করেছে। সর্বশেষ জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণীত হয় ২০১০ সালে। কিন্তু ১০ বছর পেরিয়ে গেলেও আলোর মুখ দেখেনি। ফলে কাগজে-কলমেই বন্দি শিক্ষার আধুনিকায়ন। জানতে চাইলে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. হাফিজুর রহমান কার্জন বলেন, আমাদের অর্জন অনেক, তবে সন্তোষজনক নয়। শিক্ষা খাতের অবস্থা নাজুক। মানসম্মত শিক্ষা এখনো অনেক দূরে।

পাঠ্যপুস্তকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সন্নিবেশ, মানসম্মত ও যুগোপযোগী শিক্ষাকে গুরুত্ব দিয়ে সরকার কাজ করছে, তবে বৈশি^ক কোভিড পরিস্থিতির কারণে অনেকটা পিছিয়ে পড়তে হয়েছে এমন দাবি সরকারপক্ষের। এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের শিক্ষা ও মানবসম্পদবিষয়ক সম্পাদক শামসুন্নাহার চাঁপা বলেন, দীর্ঘদিন ধরে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ছিল অপশক্তিরা। তারা জাতিকে পাকিস্তানি ভাবধারায় নিয়ে যাওয়ার অপচেষ্টায় লিপ্ত ছিল। কেউ নিজের দায়িত্বটা পালন করেনি। সর্ষের মধ্যেই ভূত ছিল, যে কারণে দীর্ঘদিন পাঠ্যপুস্তকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অনুপস্থিত ছিল। তিনি বলেন, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে ইতিহাসের চাপা পড়া থেকে সত্যকে আলোতে আনার চেষ্টা করছে। ধীরে ধীরে সত্য প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের খুনিদের বিচার হয়েছে। জাতীয় চার নেতা হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলমান। পাঠ্যপুস্তকে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কথা উঠে এসেছে। বিষয়গুলোর আরো বিশদ আকারে আসা উচিত বলে মনে করেন তিনি।

কাল থেকে শিক্ষা বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী চলবে সব প্রাথমিক বিদ্যালয় - dainik shiksha কাল থেকে শিক্ষা বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী চলবে সব প্রাথমিক বিদ্যালয় বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মান বাড়ানোর নির্দেশ রাষ্ট্রপতির - dainik shiksha বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মান বাড়ানোর নির্দেশ রাষ্ট্রপতির ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার দাবিতে দেশজুড়ে সংহতি সমাবেশ - dainik shiksha ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার দাবিতে দেশজুড়ে সংহতি সমাবেশ সব মাদরাসার ওয়েবসাইট ও তথ্য হালনাগাদের নির্দেশ - dainik shiksha সব মাদরাসার ওয়েবসাইট ও তথ্য হালনাগাদের নির্দেশ অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক : দুই মন্ত্রণালয় যা করবে - dainik shiksha অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক : দুই মন্ত্রণালয় যা করবে নার্সিং-মিডওয়াইফারি ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ - dainik shiksha নার্সিং-মিডওয়াইফারি ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় সিনিয়র আইনজীবীরা বিচার বিভাগের স্বার্থে কথা বলবেন, আশা প্রধান বিচারপতির - dainik shiksha সিনিয়র আইনজীবীরা বিচার বিভাগের স্বার্থে কথা বলবেন, আশা প্রধান বিচারপতির দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0035300254821777