৫০ ভাগ নম্বরে পরীক্ষা নেয়াকে ‘মস্তভুল’ বলেছিলেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান - দৈনিকশিক্ষা

৫০ ভাগ নম্বরে পরীক্ষা নেয়াকে ‘মস্তভুল’ বলেছিলেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান

আমিরুল আলম খান |

কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবের শুরুতেই কোপ পড়ে শিক্ষার ওপর। শিশু আর বৃদ্ধরা যেহেতু সংক্রমণে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে পড়ে তাই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ামাত্রই দেশে দেশে সবার আগে বন্ধ করা হয়েছে শিক্ষালয়গুলো। সেটি একান্ত জরুরি ছিল। কিন্তু ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার গতি কবে কমবে তার হদিস পাচ্ছেন না বিজ্ঞানীরা। পয়লা দিকে কিছু আশাবাদ শোনানো হলেও বিজ্ঞানীরা এখন বলছেন কোভিড-১৯ শুধু যে বহুকাল আমাদের চোখ রাঙাবে তাই নয়, হতে পারে সর্দি-কাশির মত কোভিড-১৯ এর সাথেই মানুষকে বসবাস করতে হবে। তবে তারা আশাবাদী যে, কোভিড-১৯-এর গলায় তারার শেকল পরাতে পারবেন এবং এখন যেভাবে তা চোখ রাঙাচ্ছে আর গিলে খাচ্ছে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন, তার লাগাম টানা হয়ত সম্ভব হবে।

কিন্তু সেজন্য কতকাল অপেক্ষা করতে হবে কেউ ঠিক জানেন না। এরকম অনিশ্চয়তার মধ্যে মানুষ নামক চিন্তাশীল ও বুদ্ধিমান প্রাণীর আশরাফুল মুখলুকাত হয়ে ওঠার গোপন রহস্য যে শিক্ষা সেটাই এখন মুখ থুবড়ে পড়েছে। সোজা কথায় মানব সভ্যতার আসল বুনিয়াদ যে শিক্ষা সেটিই এখন সবচেয়ে বেশি অচল, নিশ্চল দাঁড়িয়ে আছে। ইতিহাসে দুনিয়া জুড়ে একযোগে শিক্ষা ব্যবস্থা এমন সংকটে আগে কখনো পড়েনি। অবশ্য আঞ্চলিক বা স্থানিকভাবে শিক্ষা এমন অসংখ্য সংকটের মধ্য দিয়েই এগিয়ে যায়। যুদ্ধ-বিগ্রহ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মহামারী, দুর্ভিক্ষে শিক্ষা এরকম সংকটের শিকার হয় হামেশাই। মহাযুদ্ধের সময়ে দু দু বার চার-পাঁচ বছর করে শিক্ষা ব্যবস্থা কোথাও না কোথাও অচল হয়ে পড়েছেই। বিশ্ব যুদ্ধের চেয়ে ঢের বেশি কাল ধরে চলেছে ভিয়েতনামের ওপর আমেরিকার আগ্রাসন। শ্রীলংকা, আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়ায় যুদ্ধ চলছে দশকের পর দশক ধরে। প্যালেস্টাইনে ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দ থেকেই যুদ্ধ জারি আছে। নয় মাস চলেছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধ। এসব সময়ে শিক্ষা ক্ষতির শিকার হয়েছে, অবকাঠামো ব্যাপক ধ্বংসের শিকার হয়েছে, নিশ্চল হয়ে পড়েছে শিক্ষা পরিকাঠামো। 

এবারের সংকট ভিন্নমাত্রিক। ভাইরাসের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ চলছে, তাতে শিক্ষা পরিকাঠামো নিশ্চল হয়ে পড়েছে বটে, কিন্তু অবকাঠামো ধ্বংস হয়নি। যদিও অবকাঠামো রক্ষাণাবেক্ষণ ও নতুন নির্মাণ থমকে গেছে। কিন্তু সবচেয়ে বড় ক্ষতির মুখে শিক্ষার মূল কাজ পঠন-পাঠন পড়েছে মহাসংকটে। প্রযুক্তির সহায়তায় বিশ্বের অনেক দেশ অবশ্য এই সংকট মোকাবেলা করছে এবং ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে আনার চেষ্টা করছে। কিন্তু আধুনিক যুগে শিক্ষা যত না বই নির্ভর তার চেয়ে অনেক বেশি বাস্তব পরীক্ষা নিরীক্ষা, বহিরাঙ্গণ কর্মসূচি ও ল্যাব নির্ভর। স্বীকার করতেই হবে, করোনাভাইরাস সে ব্যবস্থাকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করছে। এ অবস্থায় বিশ্বব্যাপী বিজ্ঞান, প্রকৌশল ও কারগরি শিক্ষার মত হাতে কলমে ও ল্যাব নির্ভর শিক্ষা মুখথুবড়ে পড়েছে।

বাংলাদেশে শিক্ষাব্যবস্থা যে সংকটে পড়েছে তা দুনিয়ার অন্য দেশের তুলনায় একেবারেই ভিন্ন। সে ভিন্নতা ধরনে ও মাত্রায়। বাংলাদেশে শিক্ষার মূল সমস্যা শিক্ষার লক্ষ্য, উদ্দেশ্য নির্ণয়ে বিপুল ব্যর্থতা। এদেশের শিক্ষাক্রম (কারিকুলাম) অস্পষ্ট ও লক্ষহীন। তাই শিক্ষাক্রমের লক্ষ্য অর্জনে পাঠক্রম (সিলেবাস) বিন্যাসে ও ভুলের কূলকিনারা নেই। আছে বিদ্যালয় পরিচালনায় ইচ্ছাকৃতভাবে তৈরি নানা সংকট। উপযুক্ত শিক্ষক তৈরির উদ্যোগের অভাব। কোন কোন ক্ষেত্রে তা অনুধাবন করার ক্ষমতা ও ইচ্ছার অভাব প্রকট। করোনাকালে এসব সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। বাংলাদেশে আরেকটি বড় সমস্যা শিক্ষা মূল্যায়ন ব্যবস্থায়। সমস্যা সমাধানে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অবলম্বনের পরামর্শদানের পথ পর্যন্ত বন্ধ।

বর্তমান সংকট মোকাবেলায় অন্যান্য দেশ যেসব সুবিধা ব্যবহারের সুযোগ নিচ্ছে দুর্ভাগ্যক্রমে আমরা তা করতে পারছি না। করোনাকালে শিক্ষা সচল রাখতে অনেক দেশই আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। দূরশিক্ষণের নানা উপায় এখন মানুষের হাতের নাগালে। এর বেশির ভাগই অনলাইন ভিত্তিক। কিন্তু বাংলাদেশে আধুনিক প্রযুক্তি যতখানি বাণিজ্য-বান্ধব ততখানি জনবান্ধব নয়। শিক্ষায় দূরশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনায় বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় যে আশার আলো জ্বেলেছিল প্রতিষ্ঠাতা উপাচার্যের বিদায়ের পর তার উন্নয়নতো দূরের কথা, সেটি এখন ইতিহাসে পরিণত হয়েছে। অথচ সারা পৃথিবীতে দূরশিক্ষণ ক্রমেই আরও বিস্তৃত হচ্ছে। ৯০-এর দশকে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সে ধারা অব্যাহত রাখা হলে আজকের দুর্যোগ মোকাবেলায় তা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রাখতে পারত। কিন্তু সে পথ আমাদের অদূরদর্শী রাজনীতির কোপানলে সে সুযোগ ধ্বংস হয়েছে।

গত এক দশকের বেশি সময়ে শিক্ষাক্ষেত্রে এমন বহু সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে যা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে নিঃসম্বল করে ফেলেছে। এর মধ্যে প্রধান হল শিক্ষার অবাধ বাণিজ্যিকীকরণ। তথাকথিত সৃজনশীল শিক্ষার নামে শিক্ষাকে কোচিং সেন্টারের একচেটিয়া বাণিজ্যের কাছে বন্ধক দেয়ার ফলে দেশে শিক্ষালয়গুলো অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে। শিক্ষক সম্প্রদায় পেশাজীবী হিসেবে সামাজিক মর্যাদা হারিয়েছেন। সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয়েছে শিক্ষকের দক্ষতা কমতে কমতে তলানিতে ঠেকেছে। ফলে শিক্ষার মানের ভয়াবহ অবনতি ঘটেছে।

গত এক দশকে শিক্ষা হয়ে উঠেছে পরীক্ষা নির্ভর। দুটো একেবারেই অনাবশ্যক পরীক্ষা (প্রাথমিক সমাপনী ও জেএসসি) চাপিয়ে দেয়া হয়েছে শিশু, অভিভাবক ও শিক্ষকদের কাঁধে। এই অতিরিক্ত বোঝা থেকে জাতির মুক্তি চেয়ে নাগরিকদের সকল আবেদন নিবেদন মামলা মোকদ্দমা কোনই কাজে আসেনি।

পাঠক, মনে হতে পারে, আমি ধান ভানতে শিবের গীত গাইছি। পুরনো কাসুন্দি ঘাঁটাঘাঁটি করছি। জ্বি, ঠিক তাই। এসব কাসুন্দি না ঘেঁটে করোনাকালে শিক্ষার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা অসম্ভব। তাই, আমি মনে করি, শিক্ষা সম্পর্কে সরকারের অবস্থান স্পষ্ট করার এখনই সময়।


প্রথমত, সরকারের পক্ষ থেকে মুহূর্ত মাত্র বিলম্ব না করে প্রাথমিক ও জেএসসি/জেডিসি পরীক্ষা তুলে দেবার স্পষ্ট ঘোষণা করা উচিত।

শিক্ষা কার্যক্রম চালু রাখার স্বার্থে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষ জনশক্তি, প্রযুক্তি ও অন্যান্য সুবিধা কাজে লাগানো এবং তার দ্রুত আধুনিকায়ন ও উন্নতির পদক্ষেপ নেয়া জরুরি উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার। 

শিক্ষক বাতায়নকে আরও কার্যকর করা। এবং ডিজিটাল কন্টেন্ট গুলোর ব্যাপক উন্নতি সাধন করা। আমরা লক্ষ্য করেছি, শিক্ষক বাতায়নে অনেক কন্টেন্ট ভয়াবহ রকম যান্ত্রিক ও প্রাণহীন।

সংসদ টেলিভিশনের সম্প্রচার শুধুমাত্র ক্যাবল ভিত্তিক না রেখে তা বিটিভির সাথে টেরিস্টেরিয়াল প্রযুক্তিতে সম্প্রচার করার জরুরি পদক্ষেপ নেয়া।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও এটুআই যৌথভাবে শিক্ষা অ্যাপ উদ্ভাবন ও তার মাধ্যমে পাঠদানের ব্যবস্থা করা। সুখের কথা, এটুআই ইতিমধ্যে তেমন একটি ব্যবস্থা চালু করেছে। তবে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যা দেখেছি তা অনেকখানি প্রাণহীন এবং তাত্ত্বিক। এ দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে হবে।

দেশের সব শিক্ষার্থীর ডাটাবেজ তৈরি করে প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে মোবাইল নেটওয়ার্কের মধ্যে নিয়ে আসা এবং তাদের জন্য নামমাত্র মূল্যে বিশেষ ডাটা প্যাকেজ ঘোষণা করা। এ বিষয়ে মোবাইল অপারেটরগুলোর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করার এখনই সুযোগ।

সর্বোপরি, স্থগিত উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা গ্রহণ এবং ২০২১ খ্রিষ্টাব্দের মাধ্যমিক পরীক্ষা সম্পর্কে সরকারের চিন্তা-ভাবনা প্রকাশ করা। এ বিষয়ে একটি কথা বলা প্রয়োজনীয় বোধ করছি। ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের শিক্ষার বিষয়টি দেখভাল করতেন সদ্য প্রয়াত অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। কিন্তু তার সাথে কোন আলোচনা না করেই সে সময়ের শিক্ষামন্ত্রী অধ্যাপক ইউসুফ আলী সংক্ষিপ্ত সিলাবাসের নামে ৫০ ভাগ নম্বরে পাবলিক পরীক্ষা নেয়ার ঘোষণা করেন। তার সাথে যুক্ত হয় গণটোকাটুকি। এ ঘটনাকে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান তাঁর স্মৃতিকথায় একটা মস্ত ভুল সিদ্ধান্ত বলে বর্ণনা করেছেন।

দুর্ভাগ্যক্রমে ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ভুল পথে হাঁটার দিকেই বাংলাদেশের কর্তা ব্যক্তিরা বেশি সোচ্চার। একই ভুল দ্বিতীয় বার করলে তার যে মাসুল দিতে হবে তা আমরা কখনও পূরণ করতে পারব না। বরং বুদ্ধিমানের কাজ হবে বিপর্যস্ত শিক্ষা মূল্যায়নে দীর্ঘ গৃহযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যাওয়া শ্রীলংকার অভিজ্ঞতা ও গৃহীত পদক্ষেপ সম্পর্কে খোঁজ খবর নিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া। শিক্ষার মান নিয়ে আপোষ করা আমাদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। এবার যেন সেই ভুল না করি।

আরেকটি কথা। নতুন কারিকুলাম তৈরি করা হচ্ছে। তা চালুর আগ ও নবম ও দশম শ্রেণিতে মাধ্যমিক এবং একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা গ্রহণের ব্যবস্থা পুনরায় চালু করায় কোন বাঁধা থাকার কথা নয়। শিক্ষা বোর্ডগুলোর সে সামর্থ্য ষোলোআনাই আছে।

আমিরুল আলম খান, যশোর শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান

[email protected]

কাল খুলছে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শনিবারও চালু ক্লাস - dainik shiksha কাল খুলছে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শনিবারও চালু ক্লাস সরকারি কলেজ মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খাদিমের চাকরি জাতীয়করণ দাবি - dainik shiksha সরকারি কলেজ মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খাদিমের চাকরি জাতীয়করণ দাবি উপবৃত্তির সব অ্যাকাউন্ট নগদ-এ রূপান্তরের সময় বৃদ্ধি - dainik shiksha উপবৃত্তির সব অ্যাকাউন্ট নগদ-এ রূপান্তরের সময় বৃদ্ধি শিক্ষকের বেতন ও শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধে কাজ চলছে: শিক্ষামন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষকের বেতন ও শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধে কাজ চলছে: শিক্ষামন্ত্রী বিএসসি মর্যাদার দাবিতে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের মাসব্যাপী কর্মসূচি - dainik shiksha বিএসসি মর্যাদার দাবিতে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের মাসব্যাপী কর্মসূচি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে ১৩ বছরের কম বয়সী শিশুদের হাতে স্মার্টফোন নয় - dainik shiksha ১৩ বছরের কম বয়সী শিশুদের হাতে স্মার্টফোন নয় একই স্কুলের দুই ছাত্রীকে বিয়ের পর আরেক ছাত্রীকে ল্যাব সহকারীর অনৈতিক প্রস্তাব - dainik shiksha একই স্কুলের দুই ছাত্রীকে বিয়ের পর আরেক ছাত্রীকে ল্যাব সহকারীর অনৈতিক প্রস্তাব দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ ১২ মে - dainik shiksha এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ ১২ মে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0036709308624268