৭ শিক্ষার্থীর ৩ শিক্ষক ! - দৈনিকশিক্ষা

৭ শিক্ষার্থীর ৩ শিক্ষক !

মিলন কর্মকার রাজু, কলাপাড়া(পটুয়াখালী)থেকে |

পাকা আলীশান ভবন। কাগজপত্রে শিক্ষার্থী ১৭ হলেও বাস্তবে মাত্র ৭ জন। তাদের শিক্ষার নিয়োজিত আছেন ৩ জন শিক্ষক। প্রতিমাসে তাদের সরকারি বেতন দিতে হয় ৭৩ হাজার ১৫৫ টাকা। পটুয়াখালীর কলাপাড়ার চাকামইয়া ইউনিয়নের শান্তিপুর গ্রামের বানীকান্ত হাওলাদার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এ চিত্র। অথচ এ বিদ্যালয়টি প্রাথমিক শিক্ষা অফিস থেকে নিয়মিত পরিদর্শনও করেন একজন সহকারি শিক্ষা কর্মকর্তা। চলতি মাসেও কাগজপত্রে এ বিদ্যালয়টি ভিজিট করা হয়েছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দে বিদ্যালয়বিহীন গ্রাম হিসেবে শান্তিপুর গ্রামে ৩৩ শতক জমির উপর বানীকান্ত হাওলাদার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়। ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দে বিদ্যালয়টি জাতীয়করণ হয়। ওই বছরের ১১ মার্চ ১৮ জন শিক্ষার্থী নিয়ে ক্লাস শুরু হয়। ২০১৬ খ্রিস্টাব্দে ২২ জন ও ২০১৭ খ্রিস্টাব্দে ২২ জন শিক্ষার্থী শিশু, প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হলেও শিক্ষার্থী না থাকায় তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির ক্লাস শুরু করতে পারেনি। ২০১৮ খ্রিস্টাব্দে কাগজপত্রে ১৭জন শিক্ষার্থী ভর্তি দেখানো হয়েছে। বাস্তবে শিশু শ্রেণিতে (প্রাক প্রাথমিক) তিন জন, প্রথম শ্রেণিতে একজন,দ্বিতীয় শ্রেণিতে একজন ও তৃতীয় শ্রেণিতে দুই জন শিক্ষার্থী রয়েছে। এ বছরও চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণিতে কোন শিক্ষার্থী ভর্তি হয়নি। আর এই ৭ শিক্ষার্থীকে পাঠদানে নিয়োজিত রয়েছেন তিনজন শিক্ষক।

জানা যায়, সংযুক্তি ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক দেলোয়ার হোসেন ২০১৫ খ্রিস্টাব্দের ৪ মে, সহকারী শিক্ষক আবুল কালাম আজাদ ২০১৬ খ্রিস্টাব্দের ৯ আগষ্ট ও বদলী শিক্ষিকা সুপর্না রানী ২০১৬ খ্রিস্টাব্দের ১১ মার্চ এ বিদ্যালয়ে যোগদান দেন।

সরেজমিনে দেখা যায়, শান্তিপুর গ্রামে বিদ্যালয়ের জরিপ এলাকায় চার থেকে ১০ সবছর বয়সী শিশুর সংখ্যা ৫০ জন। কিন্তু এ বিদ্যালয়ের পাঁচশ গজ
দূরে গামুইরবুনিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। আনুমানিক ছয়শ মিটার দূরে তারিকাটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। চারশ মিটার দূরে এনজিও পরিচালিত প্রাক প্রাথমিক স্কুল মায়ের আঁচল। আধা কিলোমিটার দূরে কারিতাসি পরিচালিত বিদ্যালয়। গ্রামের পূর্ব প্রান্তের সীমানায় অপরিকল্পিতভাবে এ বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা হওয়ায় পাশের গ্রামের স্কুলগামী শিক্ষার্থীরা দূরের এই স্কুলে না পাঠিয়ে পাশ্ববর্তী স্কুলে ভর্তি করানোর কারণে প্রতিবছর কমছে বানীকান্ত হাওলাদার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।

কলাপাড়া প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের গাফেলতি ও অনিয়মের কারণে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার চার বছরেও এখনও চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির ক্লাস শুরু করতে
পারেনি। অথচ প্রতিবছর এ বিদ্যালয়ে প্রতিটি শ্রেণির জন্য বই বরাদ্দ দেয়া হয়। এ বছরও এ বিদ্যালয়ে প্রতি ক্লাসে ১০ সেট করে ৬০ সেট বই দেয়া হয়েছে। কিন্তু কাগজপত্রে ১৭ সেট বিতরণ দেখালেও ৩৩ সেট বই রয়ে গেছে স্কুল গুদামে। সে হিসাবে গত চার বছরে ১২০-১৩০ সেট বই অতিরিক্ত দেয়া হয়েছে এ বিদ্যালয়ে। শিক্ষা অফিস সঠিক তদারকি না করায় সরকারকে ১৩০ সেট বইয়ের টাকা গচ্ছা দিতে হয়েছে।

শিক্ষকদের বেতনের হিসাব ও তাঁদের দায়িত্ব-কর্তব্য নিয়ে এলাকায় হাস্যরস ও ক্ষোভ রয়েছে বছরের পর বছর ধরে। শিক্ষকরা সরকারি বেতন নিয়মিত তুললেও শিক্ষার্থী ভর্তির ব্যাপারে তাদের আন্তরিকতার অভাবে এ বিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম এখন শূণ্যের কোঠায় বলে অভিযোগ করেন স্থানীয় গ্রামবাসীরা।ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক দেলোয়ার হোসেন। সর্বসাকুল্যে তাঁর বেতন ২৯হাজার ৬১৬ টাকা। এ বিদ্যালয়ে যোগদানের পর থেকে
তিনি গত ৩৫ মাসে বেতন তুলেছেন ১০ লাখ ৩৬ হাজার ৫৬০ টাকা। অপর শিক্ষক আবুল কালাম আজাদের প্রতিমাসে সর্বসাকুল্যে বেতন পান ২৪ হাজার ৭’শ টাকা। এ বিদ্যালয়ে যোগদানের পর গত ২০ মাসে তিনি বেতন তুলেছেন চার লাখ ৯৪ হাজারটাকা। সহকারী শিক্ষিকা সুপর্না রানী প্রতিমাসে সর্বসাকুল্যে বেতন পান ১৮ হাজার ৮৩৯ টাকা। এ বিদ্যালয়ে যোগদানের পর গত ৩৭ মাসে তিনি বেতন তুলেছেন ছয় লাখ ৯৭ হাজার ৪৩ টাকা। এ বেতনের টাকা ছাড়াও তারা কয়েক লাখ টাকা বোনাস পেয়েছেন। কিন্তু গত চার বছরে এ বিদ্যালয় থেকে সঠিকভাবে ২০ জন শিক্ষার্থীও ন্যূনতম শিক্ষা পায়নি। এ নিয়ে গোটা এলাকায় ক্ষোভ বিরাজ করছে।

এ বিদ্যালয়ে প্রাক প্রাথমিকের শিক্ষার্থী জিহাদ, নিলয় ও সৃদিতা। প্রথম শ্রেণিতে নদী। দ্বিতীয় শ্রেণিতে শ্রাবন্তী এবং তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী ইয়াসিন ও আমেনা। এই সাতজনই প্রকৃত শিক্ষার্থী। তবে কাগজপত্রে রয়েছে ১৭ জন। সাতজন শিক্ষার্থী হলেও বিদ্যালয়ে দেয়া হয় ৬০ জনের বিস্কুট। এই
বিদ্যালয়ে অধ্যায়নরত শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তিও দেয়া হয় । গত বছর  বিদ্যালয়ের ১২জনকে উপবৃত্তি দেয়া হয়েছে এ তথ্য জানালেন শিক্ষকরা। তবে এ
উপবৃত্তির টাকা কারা পেয়েছেন তাদের নাম বলতে পারেননি।

কলাপাড়া উপজেলার এ বিদ্যালয়ের বেহালদশার চিত্র গত শনিবার (২৮ এপ্রিল)কুয়াকাটায় অনুষ্ঠিত মা সমাবেশে প্রাথমিক ও গনশিক্ষা মন্ত্রীর উপস্থিতিতে তুলে ধরেন অভিভাবকরা। এ সময় মন্ত্রী অ্যাডভোকেট মোস্তাফিজুর রহমান জেলা ও উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ও দায়িত্বরত সহকারি শিক্ষা কর্মকর্তাকে তাদের দায়িত্ব পালন নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

অভিযোগ রয়েছে, কলাপাড়া উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ও দায়িত্বরত সহকারি শিক্ষা কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করেই চলতো এই বিদ্যালয়। সরকার এ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর দায়িত্বরত শিক্ষকদের ২২ লাখ ২৭ হাজার ৬০৩ টাকা শুধু বেতন দিয়েছেন। এছাড়া কয়েক লাখ টাকা বোনাসসহ আলীশান ভবন ও শিক্ষা আসবাবপত্র দেয়া হয়েছে। কিন্তু শিক্ষা অফিসের সঠিক তদারকির অভাবে এ বিদ্যালয়ে শিক্ষা কার্যক্রম ভেস্তে গেছে। শিক্ষার্থী না থাকায় শিক্ষকরাও নিয়মিত বিদ্যালয়ে না গিয়ে একদিন উপস্থিত হয়ে হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করে বেতন তুলছেন। শিক্ষা অফিস বিষয়টি অবগত থাকলেও তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা কিংবা শিক্ষার্থী ভর্তি করতে না পারার কোন কারণ জানতে চেয়ে কখনও
চিঠি দেয়নি।

বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রথান শিক্ষক দেলোয়ার হোসেন দৈনিকশিক্ষা ডটকমকে জানান, এ বছর স্কুল থেকে বই নিয়েছে ১৭ জন। কিন্তু ক্লাস করে এই ৭ জন। একই এলাকায় একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থাকায় শিক্ষার্থী পাওয়া যায় না। তবে তারা চেষ্টা করছেন বিদ্যালয়ে শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে আনার।  বাড়ি বাড়ি গিয়ে শিক্ষার্থীদের ভর্তির জন্য অভিভাবকদের বলছেন। কিন্তু অভিভাবকরা অন্য স্কুলে শিক্ষার্থী ভর্তি করলে তাদের কি করার আছে।

উপজেলা সহকারি শিক্ষা কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম দৈনিকশিক্ষা ডটকমকে বলেন,  এই মাসে স্কুলটি পরিদর্শন করেছি। এ সংক্রান্ত রিপোর্ট  জমা শিগগিরই জমা  দেবেন বলে জানান তিনি।

উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মনি লাল সিকদার দৈনিকশিক্ষা ডটকমকে জানান, তিনি বিষয়টি জানতেন। শিক্ষকদের বলেছেন শিক্ষার্থী ভর্তির জন্য। তবে অতিরিক্ত বই যদি নিয়ে থাকে তা ফেরত আনা হবে।

প্রাথমিকের তৃতীয় ধাপের মৌখিক পরীক্ষা শুরু ৯ মে - dainik shiksha প্রাথমিকের তৃতীয় ধাপের মৌখিক পরীক্ষা শুরু ৯ মে প্রাথমিকের তৃতীয় ধাপে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha প্রাথমিকের তৃতীয় ধাপে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের নতুন নির্দেশনা ঢাকার তাপমাত্রা দেখে স্কুল বন্ধের সিদ্ধান্ত নয়: শিক্ষামন্ত্রী - dainik shiksha ঢাকার তাপমাত্রা দেখে স্কুল বন্ধের সিদ্ধান্ত নয়: শিক্ষামন্ত্রী তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রির বেশি হলে স্থানীয়ভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হতে পারে - dainik shiksha তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রির বেশি হলে স্থানীয়ভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হতে পারে বঙ্গবন্ধুকে হারিয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শিক্ষাখাত - dainik shiksha বঙ্গবন্ধুকে হারিয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শিক্ষাখাত আরো ৭২ ঘণ্টার হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha আরো ৭২ ঘণ্টার হিট অ্যালার্ট জারি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0070681571960449