গ্রেফতার হওয়া নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনগুলোর দুর্ধর্ষ ১৩৭ জঙ্গিকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছে কারা কর্তৃপক্ষ। কারণ এসব জঙ্গি কারাগারে ও আদালতে আনা-নেওয়ার সময় উগ্র আচরণ করে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, মামলায় হাজিরা দিতে আদালতে আনা-নেওয়ার জন্য গাড়িতে তোলার সময় ওই জঙ্গিরা চিৎকার-চেঁচামেচি ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করে। কেউ কেউ কারাগারের ভেতরেও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। এক সেল থেকে অন্য সেলে যাওয়ার চেষ্টা করে। যেকোনো সময় অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটার আশঙ্কা রয়েছে।
এ বিষয়টি ইতিমধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে কারা কর্তৃপক্ষ অবহিত করেছে বলে ওই সূত্র জানিয়েছে।
জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, ‘কারাগারে আটক জঙ্গিদের বিরুদ্ধে যেসব মামলা আছে সেগুলোর যাতে দ্রুত অভিযোগপত্র দেওয়া হয় সেই জন্য আমরা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দিয়েছি। জঙ্গিদের বিষয়ে আমরা সবসময় সতর্ক। আটক জঙ্গিদের বিষয়ে তীক্ষè দৃষ্টি রাখছে কারা কর্তৃপক্ষ।’
কারাগার ও পুলিশ সূত্র জানায়, ঢাকা, চট্টগ্রাম ও গাজীপুরের কাশিমপুরের হাই সিকিউরিটি কারাগারে অন্তত ১৩৭ জন দুর্ধর্ষ জঙ্গি আটক আছে। তাদের বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন থানায় মামলা আছে। এসব মামলার কিছু নিষ্পত্তি হয়েছে, কিছু আদালতে বিচারাধীন। সাজাপ্রাপ্ত ও বিচারের অপেক্ষায় থাকা জঙ্গিরা দীর্ঘদিন কারাগারে থাকায় উগ্র হয়ে উঠেছে। যেসব মামলা বিচারাধীন ও তদন্তাধীন সেগুলো সুরাহা হচ্ছে না। এসব মামলা দ্রুত শেষ করতে সম্প্রতি পুলিশ সদর দপ্তর থেকে একটি নির্দেশনা গেছে পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটে।
নাম প্রকাশ না করে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, কারাগারে আটক দুর্ধর্ষ জঙ্গিদের নিয়ে তারা সবসময় দুশ্চিন্তায় থাকেন। তাদের আদালতে নেওয়া ও আনার সময় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে তারা। দুই পায়ে ডান্ডাবেড়ি লাগিয়ে রাখা হয়। তাই পালানোর সুযোগ নেই। কিন্তু তারা প্রিজন ভ্যানে চিৎকার চেঁচামেচি করে। এসব জঙ্গির একটি তালিকা পাঠানো হয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে।
উল্লেখ্য, ২০১৮ সালের ২ মার্চ কাশিমপুর কারাগার থেকে ময়মনসিংহে আদালতে নেওয়ার সময় ত্রিশালে প্রকাশ্যে প্রিজন ভ্যানে হামলা চালিয়ে তিন জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়। ওই জঙ্গিরা ছিল জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) সদস্য। তাদের মধ্যে দুজন মৃত্যুদ-প্রাপ্ত ও একজন যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামি ছিল। এ ঘটনায় তখন ব্যাপক তোলপাড় হয়।
পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা জানান, ১৯৯২ সালে আফগানফেরত মুফতি আবদুর রউফ, মাওলানা আবদুস সালাম আর মুফতি আবদুল হান্নান গঠন করে হরকত উল জিহাদ হুজি। ১৯৯৯ সালে হুজি জঙ্গিরা কবি শামসুর রাহমানকে হত্যার চেষ্টা চালায়। যশোরে উদীচীর অনুষ্ঠানে বোমা হামলা চালিয়ে ১০ জনকে হত্যা করে। হামলা করা হয় রমনা বটমূলে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে। ২০০৪ সালের মে মাসে সিলেটে তৎকালীন ব্রিটিশ হাইকমিশনারের ওপর বোমা হামলা চালায় তারা। হুজির আরেকটি বড় হামলার ঘটনা ঘটে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার ওপর। ২০০৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে সাবেক অর্থমন্ত্রী কিবরিয়াকে হত্যার পেছনেও ছিল হুজি। তা ছাড়া জেএমবি, জেএমজেবির তৎপরতা ছিল বেপরোয়া।
ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, জেএমবির আবদুর রহমান ও সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাইসহ শীর্ষ স্থানীয় কয়েক নেতা, হুজির মুফতি হান্নানকে ফাঁসি দেওয়া হয়। এরপর উত্থান ঘটে নব্য জেএমবির। পাশাপাশি আনসারুল্লাহ বাংলা টিম (এবিটি), হিযবুত তাহরীরও এখনো সক্রিয় আছে। হলি আর্টিজানের হামলার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে নব্য জেএমবির শীর্ষস্থানীয় বেশ কয়েকজন নিহত হয়, অনেকেই ধরা পড়ে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম, ঢাকা ও গাজীপুর কারাগারে থাকা জঙ্গিদের মধ্যে আছে আমিরুজ্জামান পারভেজ, সাবকাত আহম্মেদ, ফাহাদ বিন সোলাইমান, রাকিব হাসান প্রকাশ ওরফে খালিদ, হাবিবুর রহমান, তাহসীন, সাখাওয়াত হোসেন, কুমিল্লার কামরুল ইসলাম, নুরুল আলম, দিদারুল আলম, আবুল কাশেম, ইউসুফ, হবিগঞ্জের নুরুল হক, আবু তাহের, মহিবুর রহমান, আবদুল হক, মমতাজ উদ্দিন, নাঈম, আসাদ, সোহাগ, রেজাউল, শরিয়তউল্লাহ, মুসা আহম্মদ, রফিকুল ইসলাম, রেজাউল করিম, সিরাজুল করিম, আনোয়ার উদ্দিন জাবেদ, ওসমান ও হাবিব, মুজাহিদুল ইসলাম, জাহাঙ্গীর, আবদুর রহমান, বোরহান উদ্দিন মাসুম, আলী ইয়াস আহম্মদ, ইব্রাহিম ওয়ালিউল্লহ, খালেদ, রাশিদুল ইসলাম, আবু জিহাদ, মামুনুর রশীদ, আবদুল খালেক হুরায়রা, আমির হোসাইন, ইসহাক, লিটন আমির, আমিনুল ইসলাম হামজা, আমিনুল, মোবাশ্বের সামাদ ওরফে সামাদ, আজিজুল হক, আবদুল কাইয়ুম, মানছুর ইসলাম, জাবেদ ইকবাল, মোহাম্মদ, আমানউল্লাহ, আবু হুররার, শামীম হোসেন গালিব, শামীম হোসেন, শামীম হাসান, বরগুনার এরশাদ হোসেন, মামুন, মাহবুব, মিনহাজুল ইসলাম, সাজিল, শাহজাহান, নুরনবী, রাজু, রিয়াদ, রমজান আলী, রাজু আহমেদ, আবদুল মান্নান, সুজন বাবু, বুলবুল আহম্মদ, আপেল ফুয়াদ, রফিক মেহেদী, জহিরুল হক, জসিম উদ্দিন, আরজিনা, হাছান, রাকিবুল হাসান, সালাহ উদ্দিন আইয়ুবী, আবু তাহছির আল বাঙ্গালী হাসান, আশফাকুর রহমান, আবু মাহির, বাবলু রহমান, তাজুল ইসলাম সুমন, মঞ্জুরুল মুরাদ, আল রায়হী মুরাদ, শরফুল আওয়াল, শফিকুল ইসলাম শেখ ও মনিরুজ্জামান।
এই প্রসঙ্গে পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, দুর্ধর্ষ জঙ্গি জাবেদ ইকবালের বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, রাঙ্গামাটি, বান্দরবানে ১৯টি মামলা রয়েছে। তার মধ্যে ১৬টি মামলায় সাজা হয়েছে। তিনটি মামলা এখনো বিচারাধীন আছে। আরেক জঙ্গি শামীম হোসেন গালিবের বিরুদ্ধে কুমিল্লা, ফেনী, চাঁদপুর, সাতক্ষীরা, রাজশাহীতে ৮টি মামলা আছে। দুটি মামলা এখনো বিচারাধীন। বাকি ৬টি মামলায় তার সাজা হয়েছে। মেহেদী আলমের বিরুদ্ধে ৮টি মামলা আছে। এখনো তিনটি মামলার তদন্ত চলছে। জহিরুল হকের বিরুদ্ধে থাকা ৭টি মামলার মধ্যে ৫টি মামলার তদন্ত চলছে। হাছানের বিরুদ্ধে থাকা ৮টি মামলার মধ্যে ৭টি তদন্ত চলছে। বাবলু রহমানের বিরুদ্ধে আছে ৫টি মামলা। তার মধ্যে ৩টি মামলার তদন্ত চলছে। আমিনুল ইসলাম হামজার বিরুদ্ধে আছে ২টি মামলা, সেগুলোর এখনো অভিযোগপত্র হয়নি।
ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, তারা চেষ্টা করছেন যেসব মামলার অভিযোগপত্র এখনো হয়নি সেগুলো দ্রুত দেওয়ার। এই জন্য পুলিশ সদর দপ্তর থেকে একটি নির্দেশনা পাঠানো হয়েছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, দেশের বিভিন্ন কারাগারে আটক দুর্ধর্ষ জঙ্গিদের নিয়ে তারা সবসময় দুশ্চিন্তায় থাকেন তা সত্য। কারা কর্তৃপক্ষও এই নিয়ে বেশ সতর্ক। আদালতে আনা-নেওয়ার সময় জঙ্গিরা নানা সমস্যা সৃষ্টি করে। বিষয়টি কারা কর্তৃপক্ষ তাদের অবহিত করেছে।