উত্তর ও উত্তরপূর্বাঞ্চলে সৃষ্ট ভায়বহ বন্যার মধ্যেই দেশের সব প্রধান নদ-নদীর পানি বাড়ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডে পূর্বাভাস অনুযায়ী, আগামী ২৪ ঘণ্টায় দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে অতি ভারি বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, রাঙামাটি ও বান্দরবান জেলার নদ-নদীর পানি দ্রুত বৃদ্ধি পাবে। এছাড়া তিস্তা নদীর পানি বিপৎসীমার কাছাকাছি অথবা ওপরে অবস্থান করতে পারে। সোমবার নদ-নদীর পরিস্থিতি ও পূর্বাভাসে এ তথ্য জানানো হয়।
এদিকে বন্যায় প্লাবিত হচ্ছে আরও নতুন এলাকা। এ পর্যন্ত তিনজনের প্রাণহানির খবর পাওয়া গেছে। বন্যার্তদের সহায়তায় যথাসম্ভব পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন উপদ্রুত জেলাগুলোর প্রশাসন।
সিলেটে মাসজুড়ে ভারি বৃষ্টির শঙ্কা :
সিলেট বিভাগের বিভিন্ন এলাকায় মাসজুড়ে ভারি থেকে অতিভারি বৃষ্টির শঙ্কা রয়েছে বলে জানিয়েছেন আবহাওয়াবিদরা। উজান থেকে নেমে আসা ঢল ও ভারি বর্ষণে সিলেট ও সুনামগঞ্জে আকস্মিক বন্যায় জনদুর্ভোগ মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। বিশেষ করে খাদ্য ও সুপেয় পানি সংকট তীব্র হয়েছে। কিছু নিত্যপণ্য পাওয়া গেলেও দাম লাগামহীন। মানুষের একটি অংশ আশ্রয়কেন্দ্র ও নিরাপদ আশ্রয়ে ঠাঁই পেলেও সেখানেও খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে কিছু ত্রাণসামগ্রী দেয়া হয়েছে, তবে তা পর্যাপ্ত নয়। সিলেটের বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও অপরিবর্তিত আছে সুনামগঞ্জের বন্যা। বন্যার সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে বিভিন্ন স্থানে প্রশাসনের পক্ষ থেকে কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে। বিভিন্ন স্থানে সেনাবাহিনী উদ্ধার তৎপরতা চালাচ্ছে।
এখনই চালু হচ্ছে না ওসমানী বিমানবন্দর :
ওদিকে সিলেটের ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রানওয়ে থেকে পানি নেমে গেলেও রানওয়ের দিকনির্দেশনামূলক অ্যাপ্রোচ লাইট এখনো ডুবে আছে। তাই বিমানবন্দর এখনই চালু হচ্ছে না। সোমবার ওসমানী বিমানবন্দর পরিদর্শন করেন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলী। পরে সাংবাদিকদের তিনি এ কথা জানান।
বড়লেখায় পৌর এলাকাসহ কয়েকটি গ্রাম প্লাবিত :
মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলায় অতি বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে বন্যা বিস্তৃর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। নদ-নদীসহ হাকালুকি হাওড়ের পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় বড়লেখা পৌর এলাকাসহ ভূকশিমইল, ভাটেরা, জয়চন্ডী, ব্রাহ্মণবাজার, কাদিপুর, ও কুলাউড়া সদর এ ৭টি ইউনিয়নের বিস্তৃর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এছাড়া জুড়ী, রাজনগর, শ্রীমঙ্গল ও কমলগঞ্জ উপজেলায় ৩০ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে আছে।
যমুনায় পানি বাড়ছে, নতুন এলাকা প্লাবিত :
দৈনিক আমাদের বার্তার সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি জানিয়েছেন, যমুনা নদীর পানিবৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় প্রতিদিন নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। বিশুদ্ধ পানি আর খাবারের সংকটে মানবেতর জীবনযাপন করছেন পানিবন্দী মানুষ। সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার খুকনি ইউনিয়নের ব্রাহ্মণগ্রামের অন্তত ৫০টি বাড়িঘর, ১০টি তাঁত কারখানা, গো-খামার, একটি মসজিদ ও অসংখ্য গাছপালা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।
জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, সোমবার সিরাজগঞ্জ শহররক্ষা বাঁধ হার্ডপয়েন্ট এলাকায় পানি ৩৫ সেন্টিমিটার এবং কাজিপুর পয়েন্টে ৪০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বইছে। ভারি বৃষ্টিপাতের ফলে ২২ জুন পর্যন্ত পানি বাড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বিপৎসীমার ২৮ সেমি ওপরে তিস্তার পানি :
লালমনিরহাট প্রতিনিধি জানিয়েছেন, টানা কয়েক দিনের বৃষ্টি ও উজানের ঢলে তিস্তার পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করেছে। ফলে লালমনিরহাটের তিস্তা তীরবর্তী এলাকার লোকজন বড় বন্যার আশঙ্কা করছেন। সোমবার দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলার তিস্তা ব্যারাজ ডালিয়া পয়েন্টে পানির প্রবাহ রেকর্ড করা হয় ৫২ দশমিক ৮৮ সেন্টিমিটার, যা বিপৎসীমার ২৮ সেন্টিমিন্টার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
এদিকে পানির প্রবাহ বেড়ে যাওয়ায় তিস্তা তীরবর্তী ৫ উপজেলার প্রায় পাঁচ হাজার পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন।
জামালপুরে শিশুর লাশ উদ্ধার :
জামালপুর প্রতিনিধি জানিয়েছেন, ইসলামপুর উপজেলায় বন্যার পানি থেকে আরিফা আক্তার (৮) নামে এক শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। ইসলামপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাজেদুর রহমান জানান, গতকাল সকালে ওই উপজেলার চিনাডুলীর পশ্চিম বামনা ঘোনাপাড়া এলাকা থেকে লাশটি উদ্ধার করা হয়। আরিফা ওই এলাকার আলম মিয়ার মেয়ে।
পানিবন্দী হাওরের লাখো মানুষ :
কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধি জানিয়েছেন, হাওরাঞ্চলের ঘোড়াউত্রা ও কালনী নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। উজানের পানি দ্রুত হাওরে প্রবেশ করছে। এতে করে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে বলে জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।
ইতোমধ্যে জেলার অষ্টগ্রাম, ইটনা, মিঠামইন উপজেলার শতাধিক গ্রামের প্রায় দেড় লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। এছাড়া করিমগঞ্জ, তাড়াইল, নিকলী, বাজিতপুর ও ভৈরবের নিচু এলাকা বন্যায় ডুবে গেছে। প্রশাসনের উদ্যোগে তিন শতাধিক আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। সেসব কেন্দ্রে এরইমধ্যে আশ্রয় নিয়েছে প্রায় ১০ হাজার মানুষ।
একদিনে আত্রাই নদীতে ৭০ সেন্টিমিটার পানিবৃদ্ধি :
নওগাঁ প্রতিনিধি জানিয়েছেন, পত্নীতলা, মহাদেবপুর ও মান্দা উপজেলায় আত্রাই নদীর পানি বেড়ে এখন বিপৎসীমার ৪০ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে যেভাবে পানি বাড়ছে তাতে যে কোনো মুহূর্তে পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এদিকে, নদীর পানি বাড়তে থাকায় বেড়িবাঁধের পুরাতন ৩টি ভাঙন এলাকা দিয়ে লোকালয়ে পানি ঢুকতে শুরু করায় ইতোমধ্যেই মান্দা উপজেলার শতাধিক পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। নওগাঁ পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, গত ২৪ ঘণ্টায় এ নদীর পানি ৭০ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়েছে। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তা বিপদসীমা অতিক্রম করার আশঙ্কা রয়েছে।
ফেনীর মুহুরী নদীর তিন স্থানে বাঁধে ভাঙন, ৯ গ্রাম প্লাবিত :
ফেনীতে ভারতের উজান থেকে আসা পাহাড়ি ঢলে মুহুরী নদীর তিন স্থানে বেড়িবাঁধে ভাঙন দেখা দিয়েছে। গত রোববার উপজেলার দরবারপুর ইউনিয়নের দক্ষিণ বরইয়া রতন মেম্বারের বাড়ি সংলগ্ন ও সোমবার ভোর ৬টার দিকে ফুলগাজী সদর ইউনিয়নের উত্তর দৌলতপুর সেকান্তর মাস্টার বাড়ি বাঁধে সংলগ্ন ভাঙন সৃষ্টির পর বেলা ১১টার দিকে একই ইউনিয়নের দেড়পাড়ায় মুহুরী নদীর ভাঙনের স্থান সৃষ্টি হয়েছে। এতে প্লাবিত হচ্ছে প্রায় ৯টি গ্রাম। ডুবে গেছে রাস্তা-ঘাট ও ফসলি জমি।
চট্টগ্রামে ২ জনের মৃত্যু :
চট্টগ্রাম প্রতিনিধি জানিয়েছেন, নগরীর পাঁচলাইশ থানার কাতালগঞ্জের জলাবদ্ধ একটি বাড়িতে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। মৃতরা হলেন ওই বাড়ির দারোয়ান আবু তাহের গাড়িচালক মো. হোসেন। নগরীর পঁচলাইশ, চকবাজার, আগ্রাবাদসহ বিভিন্ন এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে।
খাগড়াছড়ির নিম্নাঞ্চল প্লাবিত :
খাগড়াছড়ি থেকে পাঠানো খবরে জানা গেছে, ভারি বর্ষণে জেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। খাগড়াছড়ি সদর, দীঘিনালা, মানিকছড়িসহ বেশ কিছু উপজেলায় অতি বর্ষণের কারণে জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে।
এ ছাড়া মেরুং ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চলের বিভিন্ন গ্রাম পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে। মেরুংয়ের মাইনী নদী তীরবর্তী ও আশপাশের অর্ধশতাধিক পরিবার ইতোমধ্যে বসতবাড়ি ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেছেন। ভারী বর্ষণ অব্যাহত থাকলে খাগড়াছড়ির চেঙ্গী, মাইনী ও ফেনী নদীর পানি বেড়ে বন্যার শঙ্কা রয়েছে।