সাবেক শিক্ষা সচিব মো. নজরুল ইসলাম খান (এন আই খান) পাঠ্যবইয়ে ভুলের বিষয়ে বলেন, দায়িত্বে অবহেলার কারণেই এমন ভুল, যা ফৌজদারি অপরাধের শামিল। অপরাধের সাজা না হওয়ার কারণেই একই ভুল বারবার হচ্ছে।
দৈনিকশিক্ষাডটকমকে দেয়া টেলিফোন সাক্ষাতকারে তিনি আরও বলেন, ভুল হয়েছে বলে বসে থাকার কোনো সুযোগ নেই। সৃজনশীল পদ্ধতি যদি ব্যবহার করা যায়, তাহলে এই ভুল কিছুটা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। মন্ত্রণালয় এবং এনসিটিবি বলছে, বইয়ে আঠা লাগিয়ে সমাধান করতে। এটি কোনো সিদ্ধান্ত হতে পারে না। আঠা উঠে যাবে। বৃষ্টির সময় বই নষ্ট হবে। সৃজনশীল পদ্ধতিতে ভুল সংশোধন করা যেতে পারে। ধরে নিতে হবে বইয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে ভুল করা হয়েছে। ক্লাসে গিয়ে শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের বলবে যে, এই চ্যাপ্টারের কোথায় কোথায় ভুল আছে, তা বের কর। শিক্ষক-শিক্ষার্থী যদি ভুল বের করার মধ্য দিয়ে শিক্ষা আদান-প্রদান করে তাহলে সহজেই সমাধান হবে এবং সেই ভুল শিক্ষার্থীদের মনে গেঁথে যাবে। একটি বইয়ের ভেতরে ভুল! এই ভুল ইতিবাচকভাবেও দেখা যেতে পারে, যদি শিক্ষার্থীদের মাঝে অনুশীলনের মাধ্যমে ধরিয়ে দেয়া যায়। ভুল শুধরানোর জন্য শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত করাই হচ্ছে একজন ভালো শিক্ষকের মেধার পরিচয়। ভালো পড়াতে পারলেই ভালো শিক্ষক হওয়া যায় না।
একটি বইয়ে অমুকের বাণী, তমুকের কথা। অযথা কন্টেন্ট দিয়ে বই ভারী করা হয়েছে। এ ব্যাপারে আদালত রায়ও দিয়েছেন। বই বড় কিন্তু কন্টেন্ট কম। আমি মনে করি, কন্টেন্ট আরও বাড়ানো উচিত। ফিনল্যান্ডে দেখলাম, ১৮টি বিষয়ে পড়ানো হয়। সময় পাল্টাচ্ছে। অনেক নতুন বিষয় অন্তর্ভুক্ত করার সময় এসেছে।
আমি মনে করি, বইয়ের কাজটি বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়া উচিত। তবে নিয়ন্ত্রণ থাকবে এনসিটিবির হাতে। একটি স্কুলে একাধিক টেক্সট বই থাকবে। জ্ঞানের রাজ্য গড়ে তুলতে হবে। বেসরকারিভাবে বই লেখার সিদ্ধান্ত দিলে অনেক বেশি লেখক তৈরি হবে। অনেক বেশি বই লেখা হবে। একই বিষয় ভিন্ন ভিন্ন লেখক ভিন্নভাবে উপস্থাপন করতে পারবেন। এতে শিক্ষার্থীরা সঠিক জ্ঞান অর্জন করতে পারবে। ফ্রি বই না দিয়ে স্কুলে অর্থ দিয়ে দেবে এবং সেই অর্থ দিয়ে একাধিক পাঠ্যবই কিনবে স্কুল কর্তৃপক্ষ।
ভুল তো ভুলই। ছোট যা, বড়ও তা। তবে কন্টেন্ট অর্থাৎ কবিতা বা গল্প বাদ দেয়ার যে প্রশ্ন উঠেছে, তা নিয়ে তদন্ত ছাড়া মন্তব্য করা ঠিক হবে না। একটি কবিতা বাদ দিয়ে অন্য আরেকটি কবিতা দেয়া যেতেই পারে। প্রশ্ন হচ্ছে প্রাসঙ্গিক হচ্ছে কিনা।
হিন্দু লেখক নাকি মুসলমান লেখক এমন যারা প্রশ্ন তুলেছেন, তারা সম্প্রীতি চান না। সব লেখকই হিন্দু বা মুসলমান হতে পারে। জ্ঞানের কোনো জাত থাকে না। আমি বিভাজনে বিশ্বাস করি না। এটি হলে তো বরিশালের লেখকের বই রংপুরের শিক্ষার্থীর পড়ার কথা নয়। এই ধরনের চিন্তা হচ্ছে সংকীর্ণ মানসিকতা। তবে কোনো বিষয় যদি ধর্মে ধর্মে বিভেদ তৈরি করে, তা পরিত্যাজ্য বলেই মনে করি। তাই বলে কোনো গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের চাপের মুখে কন্টেন্ট বাদ দেয়া কোনো সমুচিত ঘটনা না। তবে হ্যাঁ, কোনো বিষয় বাদ দিয়ে যদি ভালো কিছু সংযুক্ত করা যায়, তাহলে সবার জন্যই মঙ্গল। কারণ সময়ের পরিবর্তনে পরিবর্তন করতেই হয়।
আগেই বলেছি, বিশেষ খাতিরের কারণে এমনটি হচ্ছে। অভিজ্ঞ বা ওই বিষয়ে বিশেষজ্ঞ না হলেও পছন্দের কারণে তাকে ওই জায়গায় রাখা হয়েছে। আমি চেষ্টা করেছিলাম, এই সমস্যার সমাধান করতে। পারিনি। ভেতরের অনেক কথা বলাও যায় না। সব কথা পছন্দও হবে না।
বই করে এনসিটিবি। এনসিটিবি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে কাজ করে। এনসিটিবি প্রাথমিক শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে নয়। আমি সমন্বয়হীনতার কোনো সমস্যা দেখি না। একটির সঙ্গে আরেকটি কানেকটেড। যোগ্য লোক থাকলে সব জায়গা থেকেই কাজ করা যায়।
এনসিটিবিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপের বিষয়ে এন আই খান বলেন, অনেক কিছুই হতে পারে। আবার সব ঠিকঠাক মতোও চলতে পারে। এনসিটিবিতে যারা রয়েছেন, তারা সবাই কলেজ শিক্ষক। আমি স্পষ্ট করে বলতে চাই, এনসিটিবি-তে স্কুল শিক্ষকদের নেয়া উচিত। এক কলেজ শিক্ষক সব বিষয়ে পারদর্শী হতে পারেন না। অথচ স্কুল শিক্ষকদের কোথাও পাত্তা দেয়া হয় না। যেন জোর যার মুল্লুক তার, এই নীতিতেই সব চলছে। প্রাইমারি শিক্ষকরা কি আসলে কিছুই বোঝে না? নাকি তাদের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বুঝতে চেষ্টা করে না।
তিনি আরও বলেন, আমরা এগিয়ে যাচ্ছি, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এতেই সন্তুষ্ট হয়ে বসে থাকলে চলবে না। আরও এগিয়ে যেতে হবে। ভুল দিয়ে ভুল সংশোধন করা যায় না। ভুলের জন্য অনুতাপ করতে হয়। এটি করতে পারলেই আমাদের আত্মমর্যাদা বাড়বে। আমরা বিশ্বকে চ্যালেঞ্জ করতে পারব। সব জায়গার দ্বৈতনীতি পরিহার করতে হবে। যোগ্য মানুষের মূল্যায়ন করতে হবে। তবেই আমরা কাক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারব।