আমাদের দেশে শিক্ষক নির্যাতনের মাত্রা যেন ক্রমাগত বেড়েই চলেছে! অগণিত নির্যাতনের মধ্যে শিক্ষকের মাথায় মাথায় মল ঢেলে দেওয়া, কান ধরে উঠবস করানো, জনসম্মুখে দিগম্বর করা, গলায় জুতার মালা ঝুলিয়ে দেওয়া, পিটিয়ে আহত করা ও হত্যা করা ইত্যাদি সর্বাধিক আলোচিত। প্রশ্ন হচ্ছে, শিক্ষক নির্যাতনের মত জঘন্য অপরাধের মাত্রা এতোটা বেড়ে যাওয়ার কারণ কী এবং এর প্রতিকার কী?
অগণিত শিক্ষক নির্যাতনের ধরনগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বেসরকারি স্কুল, কলেজ ও মাদরাসার নির্যাতিত শিক্ষকগণ কতিপয় জনপ্রতিনিধির দ্বারা, কমিটির লোকজন দ্বারা, অভিভাবক দ্বারা এবং শিক্ষার্থী দ্বারাই অধিক নির্যাতিত হায়েছেন। অথচ এই চারটি গ্রুপই হবার কথা ছিল বেসরকারি শিক্ষকদের সার্বক্ষণিক রক্ষাকবচ। শিক্ষক নির্যাতিত হলে সহানুভূতি নিয়ে সদলবলে এগিয়ে আসার কথা জনপ্রতিনিধি ও অভিভাবকদের। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটির সদস্যদের তো শিক্ষক নির্যাতন রোধ নৈতিক দায়িত্ব হবার কথা। শিক্ষকদের ওপর আঘাত এলে শিক্ষার্থীরা রুদ্রমূর্তি ধারন করে রুখে দাঁড়াবে এরকম একটি ধারণা সমাজে কিছুদিন আগেও বিরাজমান ছিল। তাই অনেকেই সমীহ করতো শিক্ষকদের। কেউ চিন্তাও করত না শিক্ষকদের গায়ে হাত তোলবার কথা। অথচ বর্তমান চিত্রটি সম্পূর্ণ বিপরীত!
অনেকেই মনে করেন, দীর্ঘদিনের বিচারহীনতা ও শক্ত প্রতিবাদহীনতা শিক্ষক নির্যাতন বৃদ্ধির প্রধান কারণ। কেননা, শিক্ষক নির্যাতনের দৃষ্টান্তমূলক কোন শাস্তির খবর আলোচিত নেই। তদুপরি শিক্ষক নির্যাতন বৃদ্ধির পিছনে যুক্ত হয়েছে আরো অনেক কারণ। তাই ক্রমাগত বেড়ে যাচ্ছে নির্যাতনকারীর সংখ্যা। একের দেখাদেখি যুক্ত হচ্ছে অন্যজন, অন্যদল, অন্য গ্রুপ। সম্প্রতি যুক্ত হয়েছেন কিছু জনপ্রতিনিধি। আমাদের বেসরকারি শিক্ষক নির্যাতন যেন মরাকে মারার উদাহরণ। মার খেয়ে কান্নাও করা যাবে না, বলাও যাবে না! যখন তখন চাকরি চলে যেতে পারে। সবচেয়ে ভয়াবহ হচ্ছে শিক্ষক নির্যাতন ও হত্যায় যুক্ত হয়ে পড়েছে কতিপয় শিক্ষার্থী। কেননা, বিভিন্ন বাস্তব কারণে সব শিক্ষার্থী আর আগের মত শ্রদ্ধা করে না শিক্ষকদের। যেমন: রাষ্ট্রীয়ভাবে বেসরকারি শিক্ষকদের আর্থিক স্বচ্ছলতা, ক্ষমতা ও মর্যাদা কাঙ্খিত পর্যায়ে না থাকায় সকলের ধারণা যে, এই শিক্ষক সম্প্রদায় হচ্ছে সবচেয়ে অবহেলিত, অসহায় ও দুর্বল! তাদের ঈদের আনন্দ নেই, বদলির সুযোগ নেই, বাড়ির ভাড়া নেই, চিকিৎসা করার টাকা নেই, প্রয়োজনীয় বাজার করার সামর্থ্য নেই এবং এমন আরো অনেক নেই নেই এর মধ্যে তাদের ও তাদের সন্তনদের জীবন যাপন। পুঁজিবাদের প্রভাবে অর্থের মানদণ্ডে সামাজিক মর্যাদা ও সম্মান নির্ধারিত হওয়ার কারণে আমাদের দেশের অসচ্ছল শিক্ষকগণ আজ সামাজিকভাবে মর্যাদাহীন। তাই শিক্ষার্থীদের কাছেও তাদের মর্যাদা কমে গেছে।
অধিকাংশ ক্ষেত্রে পরিচালনা কমিটির কিছু কিছু সদস্য সদা সর্বত্র এমন আচরণ করেন যে, বেসরকারি শিক্ষক সম্প্রদায় তাদের অধীনস্ত স্বল্প বেতনভোগী হতদরিদ্র কর্মচারী এবং তাদের হাতেই শিক্ষকদের বেতন, পদোন্নতি ও চাকরি। তাই শিক্ষকগণ তাদের কাছে মাথানত করে থাকতে বাধ্য! শিক্ষার্থীরাও তাদের শিক্ষকদের এই দুরবস্থা দেখে-বুঝে শ্রদ্ধা হারায়! সাধারণত মফস্বল এলাকাতেই এমনটা বেশি হয়ে থাকে। তবে সকল কমিটির সকল সভাপতি ও সকল সদস্য যে এমন তা কিন্তু নয়; বরং কেউ কেউ খুবই ভালো। আবার অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই শিক্ষার্থীরা জানে- শিক্ষকগণ যতই আদেশ দিক, যতই উপদেশ দিক, যতই লেখাপড়ার কথা বলুক; বাস্তবে প্রমোশন, ফরম পূরণ, বহিষ্কার ইত্যাদি বিষয়ে খুব বেশি কিছু করার ক্ষমতা নেই তাদের হাতে! এমন হলে শিক্ষার্থীরা মানবে কেন শিক্ষকদের কথা?
কিছু ব্যতিক্রম ব্যতীত প্রতিনিয়ত শিক্ষার্থীরা যদি দেখে-বুঝে যে, এই সমাজে শিক্ষকদের বিশেষ করে বেসরকারি শিক্ষকদের বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কতিপয় সরকারি চাকরিজীবী, জনপ্রতিনিধি, কমিটির লোক, অভিভাবক, নেতাকর্মী, বিত্তবান, বাড়িওয়ালা, দোকানি এবং আরও অনেকেই প্রাপ্য সম্মান দেয় না; তাহলে শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের সম্মান করা শিখবে কোথা থেকে?
*অনেক সময় ধর্মীয় উন্মাদনার কারণে নির্যাতিত বা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন আমাদের কোন কোন শিক্ষক। মাঝে মাঝে খুব ভয়াবহ রূপ লাভ করে এটি। এরকম একটি উন্মাদনায় মেতে উঠে অধ্যক্ষের গলায় জুতার মালা ঝুলিয়ে দিয়েছে কতিপয় দুষ্কৃতিকারী ছাত্র-অভিভাবক-জনতা। হামলা চালিয়েছে একজন বিজ্ঞান শিক্ষকের বাড়িতে। আছে এমন আরো অনেক ঘটনা। ধর্মীয় বিভেদ চাঙ্গা হলে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক। এসব ঘটনা এরই প্রমাণ। অথচ আমরা যখন ছাত্র ছিলাম তখন চিন্তাও করতাম না, কেউ দেখিও দিতো না, কোন শিক্ষক হিন্দু আর কোন শিক্ষক মুসলমান। যিনি জ্ঞানে, গুনে, পাঠদানে যত বেশি উত্তম ছিলেন তিনিই তত বেশি প্রিয় শিক্ষক ছিলেন।
*অনেক সময় সরকারি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে গিয়েও কতিপয় অভিভাবকের বিরাগভাজন হতে হয় শিক্ষকদের। যেমন, সরকার ঘোষিত বৃত্তি, উপবৃত্তি, পোশাক, শিক্ষাসামগ্রী ইত্যাদির টাকা সঠিক সময়ে সবাইকে দেওয়া না হলে ভুক্তভোগী অভিভাবকগণ বিক্ষুব্ধ হোন শিক্ষকদের উপর। বিলম্বে আদেশ পেয়ে তড়িঘড়ি করে কোন অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে গেলে শিক্ষকদের উপর অসন্তুষ্ট হন কিছু শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবক। তারা মনে করেন, এই বিলম্বের জন্য প্রতিষ্ঠানপ্রধান ও শিক্ষকগণ দায়ী। অর্থাৎ তারা ভুল বুঝে শিক্ষকদের প্রতি শ্রদ্ধা হয় হারায়। কখনো কখনো কতিপয় প্রতিষ্ঠানপ্রদান এবং শিক্ষক-কর্মচারীর দায়িত্ব অবহেলার কারণেও এমনটি হয়ে থাকে।
*বিভিন্ন পর্যায়ের অধিকাংশ শিক্ষার্থী এখন যেনো কেবল পরীক্ষার্থী। জানা নয়, বুঝা নয়, পরীক্ষায় পাশ করাই তাদের উদ্দেশ্য। শিক্ষকের অনেকটা স্থান এখন দখল করে নিয়েছে নোটবই ও গাইডবই। শিক্ষা লাভের চেয়ে সনদ লাভের প্রয়োজনীয়তা যেনো তাদের কাছে অনেক বেশি। এমনকি ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষার মতো বিষয়ও তারা হৃদয়ে ধারণ করে না, অনুশীলন করে না, মুখস্ত করে পরীক্ষায় পাস করে। তাই তাদের জীবন যাপনে এর প্রতিফলন খুব একটা দেখা যায় না। পরীক্ষায় এ প্লাস পায়; কিন্তু এ প্লাস মানুষ হয় না! এমন অবস্থায় শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের নিকট শিক্ষক গুরুত্ব হীন, শ্রদ্ধা হীন, ভালোবাসা হীন।
শিক্ষাবাণিজ্যের কারণে শিক্ষা এখন পণ্যে পরিণত হয়েছে। সামান্য কিছু ব্যতিক্রম ব্যতীত অধিকাংশ ক্ষেত্রেই লক্ষ্য করা যায়, যে শিক্ষার্থী বেশি সচ্ছল সেই শিক্ষার্থী নামিদামি প্রতিষ্ঠানে পড়ার সুযোগ পায় এবং নামিদামি শিক্ষকের নিকট প্রাইভেট পড়ার সুযোগ পায়। বেশি টাকা দিলে বেশি সময় এবং কম টাকা দিলে কম সময় পড়ার সুযোগ পায়। টাকা দেয়, শিক্ষা(?) নেয়, লেনদেন শেষ। ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক এখন অনেকটা ক্রেতা-বিক্রেতার রূপ লাভ করছে। তাই আগের মত স্নেহবোধ ও শ্রদ্ধাবোধ বজায় থাকছে না।
অতীতের মতো গুরু-শিষ্য শিক্ষাব্যবস্থা এখন আর নেই। এখন একজন শিশু শিক্ষার্থীর অনেকজন শিক্ষক। প্রতি বিষয়ের জন্য আলাদা আলাদা শিক্ষক। প্রত্যেক শিক্ষকের নিকট থেকে সুনির্দিষ্ট বিষয় শিখে। যেমন, টেলিভিশন থেকে শিখে, ইন্টারনেট থেকে শিখে। পরস্পর পরস্পরকে পর্যবেক্ষণ করবার, অনুভব করবার, সময় সুযোগ নেই ছাত্র ও শিক্ষকের। শিক্ষার্থীর পিছনে বাড়তি সময় ও মেধা দিয়ে পর্যবেক্ষণ করে প্রয়োনীয় পরিচর্যা দিতে চান না, পারেন না অধিকাংশ শিক্ষক। তাই শিক্ষকের নিকট থেকে ন্যায়নীতি, সতাদর্শ ও গুণাবলী সঠিকভাবে সঞ্চারিত হয় না শিক্ষার্থীর নৈতিক চরিত্রে। শিক্ষকের শিষ্য হয় না শিক্ষার্থী, তৈরি হয় না গভীর শ্রদ্ধা। বহন করে না শিক্ষকের নীতি-আদর্শ। তাই সদা সর্বদা মনে রাখে না শিক্ষকের কথা। শিক্ষকের সামনে এসেও অবনত হয় না তার মাথা। তাই শিক্ষকের বিপদে আন্তরিকভাবে এগিয়ে আসার কোন তাগিদ অনুভব করে না এসব শিক্ষার্থী।
কতিপয় শিক্ষক আছেন যারা শিক্ষকতাকে ব্রত হিসেবে নিতে চান না। শিক্ষক হিসেবে শিক্ষার্থীর প্রতি সঠিক দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পাদন করেন না। নীতি-নৈতিকতা বিবর্জিত কাজ করে সব শিক্ষকের মর্যাদা ও সম্মানহানি করেন। তারা সংখ্যায় কম হলেও তাদের কারণে বিতর্কিত ও অপমানিত হতে হয় সকল শিক্ষকের। তাদের কারণে সর্ব সাধারণের শ্রদ্ধা হারায় শিক্ষক সমাজ। শিক্ষকদের প্রতি তৈরি হয় ঘৃণা ও ক্ষোভ। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রূপে এর বহিঃপ্রকাশ ঘটে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের দ্বারা।
আগের দিনের তুলনায় বর্তমান শিক্ষার্থীরা অনেক বেশি সজাগ, সচেতন ও তথ্যসমৃদ্ধ। তারা সহজেই বুঝতে পারে শিক্ষকের মনোভাব ও নীতি-নৈতিকতা। অনুভব করতে পারে কোন শিক্ষক তাদের প্রতি কতটা আন্তরিক ও দায়িত্ব-কর্তব্য পরায়ন। কে কতটুকু প্রস্তুতি নিয়ে পড়াতে আসেন শ্রেণিকক্ষে। কোন শিক্ষক কী উদ্দেশ্যে ফাঁকি দেন শ্রেণিকক্ষের পাঠদানে। অথচ অনেক শিক্ষক বুঝতে চান না যে, কোনো ফাঁকিবাজ শিক্ষকের প্রতি স্থায়ী হয় না শিক্ষার্থীদের শ্রদ্ধাবোধ।
দীর্ঘদিন ধরে বেসরকারি শিক্ষকদের আর্থিক সুবিধা অত্যন্ত কম থাকায় অধিক যোগ্যরা বেসরকারি শিক্ষক হতে আসেননি, এলেও থাকেননি। অন্যান্য অনেক চাকরির তুলনায় এখনো বেসরকারি শিক্ষক হবার জন্য নির্ধারিত ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা (জিপিএ) কম এবং বয়সের ঊর্ধ্বসীমা বেশি। ফলে এলাকার মানুষ জানেন, যারা বেসরকারি স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায় শিক্ষক হয়েছেন ও আছেন তারা ছাত্রজীবনে কতটা মেধাবী ছিলেন এবং শিক্ষকতা জীবনে কতটা যোগ্যতা ও দক্ষতার স্বাক্ষর রাখছেন। আর অন্য কোনও কোনও কর্মক্ষেত্রে চলে গেছেন অধিক মেধাবীরা। কিছু ব্যতিক্রম যে নেই তা নয়। তবে কমন/সাধারণ ধারণা অনুসারেই সকলের কাছে মূল্যায়িত হয়ে থাকেন বেসরকারি শিক্ষকগণ। যদিও এই অবস্থার জন্য বিগত সকল সরকারই কম/বেশি দায়ী।
কিছু কিছু শিক্ষক তাদের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক প্রভাব-প্রতিপত্তির বলে সমাজের সম্মানিত হয়ে থাকেন। কেউ কেউ শিক্ষায় ও সহশিক্ষায় অনেক বেশি শ্রম, মেধা ও দক্ষতায় নিবেদিত হয়ে শিক্ষার্থীদের প্রিয় হয়ে উঠেন। লেখালেখি বা অন্যান্য সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও সাংগঠনিক কর্মকান্ড করে কোন কোন শিক্ষক হয়ে ওঠেন বিখ্যাত। এমনিভাবে অর্জিত সম্মান, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা শুধু শিক্ষক পদমর্যাদা দ্বারা অর্জিত নয়। অর্থাৎ আমাদের সমাজে শিক্ষক পদ বিশেষ করে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক পদ একজন মানুষকে অন্য অনেক চাকরির তুলনায় অধিক সম্মানিত ও মর্যাদাবান করে না এখন!
অনেক পাল্টে গেছে আমাদের সমাজের চিত্র। বিচারহীনতার সংস্কৃতি এখন সর্বত্র বিস্তৃত। আমাদের সময়ে শুধু শিক্ষক নন, সমাজের সকল বয়বৃদ্ধরাই ছোটদের কম/বেশি শাসন করতেন, তখন যেন শাসন করার অধিকার ছিল, এখন আর সেই অধিকার কারও নেই। এমনকি বাবা-মাও অনেকটা হারিয়ে ফেলছেন তাদের সন্তানদের শাসন করার অধিকার। সন্তানের প্রতি বাবা-মায়ের দায়িত্ব-কর্তব্য যতটা বেড়েছে ততটা বাড়েনি বাবা-মায়ের প্রতি সন্তানের দায়িত্ব-কর্তব্য। বরং বেড়েছে বাবা-মায়ের প্রতি সন্তানের অবহেলা ও অবমূল্যায়ন। তার প্রভাব পড়েছে শিক্ষকগণের উপরেও।
আগের দিনে শিক্ষকদের মনে করা হতো পিতা-মাতার মতো। এখন মনে করা হয় ভাই-বোনের মতো। অনেক ক্ষেত্রে সম্বোধনও করা হয় ভাই/আপু বলে। আমাদের সমাজের অতীত ঐতিহ্য ও মূল্যবোধ ভিত্তিক ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের এইরূপ মাত্রাগত পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব পড়েছে ব্যাপক হারে। কেননা, অতি দ্রুত সংঘটিত এই পরিবর্তনকে সঠিকভাবে প্রয়োগ করার যোগ্যতা সবাই অর্জন করতে পারেনি এখনো। তাই অনেক ক্ষেত্রেই শিক্ষার্থী দিতে ব্যর্থ হচ্ছে শিক্ষকের সঠিক সম্মান এবং শিক্ষক নিজে ধরে রাখতে ব্যর্থ হচ্ছেন নিজের ব্যক্তিত্ব ও মর্যাদা।
স্বীকৃত শিক্ষক সংগঠনগুলো ছাড়াও পেশাগত পদমর্যাদা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ধরন, রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি, ধর্মীয় মতভেদ, পাঠদানের বিষয় ইত্যাদির ভিত্তিতে বিভিন্ন দলে ও উপদলে বিভক্ত আমাদের অনেক শিক্ষক। বাস্তবে এ সকল ভাগাভাগি খুব একটা দেখা-বুঝা না গেলেও ভার্চুয়াল প্লাটফর্মে তারা অনেকই অনেক বেশি সক্রিয়। তদুপুরি নানামুখী স্বার্থসংশ্লিষ্ট কারণে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে রয়েছে অভ্যন্তরীণ কোন্দল। এক ভাগের বিপদে আন্তরিকভাবে এগিয়ে আসেন না অন্য ভাগের শিক্ষকগণ। ফলে বৃহত্তর ঐক্যের অভাবে জোরালো হয় না শিক্ষক নির্যাতনের প্রতিবাদ।
নানামুখী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রভাবে শিক্ষকগণ যেমন বিভিন্ন দলে উপদলে বিভক্ত তেমনি শিক্ষার্থীরাও বিভিন্ন মতে পথে বিভক্ত। এতে ধ্বংসপ্রাপ্ত হচ্ছে জাতিগতভাবে আমাদের পরমত সহিষ্ণুতা। একেক ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিদ্যমান একেক ধরনের পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যসূচি। এই ভিন্ন ভিন্ন পাঠ্যসূচির আওতায় আমাদের শিশুরা বেড়ে উঠছে ভিন্ন ভিন্ন মানসিকতা নিয়ে। তাদের কর্ম দক্ষতায়ও রয়েছে অনেক ভিন্নতা। এক ধরনের শিক্ষায় শিক্ষিতরা কোনভাবেই মেনে নিতে পারছে না অন্য ধরনের শিক্ষায় শিক্ষিতদের। পরস্পর পরস্পরের প্রতি পোষণ করছে মারমুখো মনোভাব। এমনকি এক ধরনের প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা অন্য ধরনের প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের প্রতিও প্রদর্শন করছে না যথেষ্ট শ্রদ্ধা।
উল্লেখিত সমস্যাগুলোর বাইরেও রয়ে গেছে শিক্ষক নির্যাতনের আরো অনেক কারণ। এই পরিসরে যা আলোচনা করা সম্ভব না। শিক্ষকদেরও করতে হবে আত্মসমালোচনা। অন্তত নিজের কাছে স্বীকার করতে হবে নিজেদের ভুল-ত্রুটি ও দুর্বলতা। থাকতে হবে নিজেকে সংশোধন করার মানসিকতা। মনে রাখতে হবে, নিয়োগপত্র পেলেই শিক্ষক হওয়া যায় না, শিক্ষক হয়ে উঠতে হয়।
যেহেতু দীর্ঘ অশুভ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আমাদের সমাজে, রাষ্ট্রে ও শিক্ষাক্ষেত্রে তৈরি হয়েছে এ সব সমস্যা; সেহেতু স্বল্প সময়ে এগুলো সমাধান করা সম্ভব নয়। এ সকল সমস্যা নির্মূল করার জন্য প্রতিটি ক্ষেত্রে নিতে হবে বাস্তব ভিত্তিক দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা। অত্যন্ত আন্তরিকতা ও সদিচ্ছা নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে আপসহীনভাবে। রাষ্ট্রীয়ভাবে নিশ্চিত করতে হবে শিক্ষকদের সর্বোচ্চ সচ্ছলতা ও মর্যাদা; যাতে ছোটবেলা থেকেই সেরা ছাত্রটি স্বপ্ন দেখে শিক্ষক হবার জন্য।
তার আগে এখনই নিতে হবে কিছু জরুরি পদক্ষেপ। এখনই বন্ধ করতে হবে শিক্ষক নির্যাতন। কোনও অবস্থাতেই মেনে নেয়া যাবে না শিক্ষকের অপমান। শুরুতেই বলেছিলাম, আবারও বলছি- প্রধানত শিক্ষক নির্যাতনকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায় এবং শিক্ষকগণ ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদে ও প্রতিরোধে ব্যর্থ হওয়ায় থামছে না শিক্ষক নির্যাতন এবং বারবার অপমানিত হচ্ছেন শিক্ষকগণ। তাই অন্যান্য পেশাজীবীদের মত শিক্ষকদেরও গড়ে তুলতে হবে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ এবং সরকারিভাবে নিশ্চিত করতে হবে অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। অন্যথায় অদূর ভবিষ্যতে এই জাতিকে দিতে হবে চরম মূল্য। কেননা, বঞ্চিত, নিপীড়িত, নির্যাতিত ও মাথানত শিক্ষক দিয়ে কখনোই তৈরি হবে না মাথা উঁচু করে বিশ্বদরবারে দাঁড়াবার মত সুযোগ্য মানুষ।
লেখক: সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক এবং অধ্যক্ষ -কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা।