কুষ্টিয়া থেকে বাসে উঠেছিলেন যাত্রীরা, গন্তব্য চট্টগ্রাম। রাতের যাত্রা। মহাসড়ক ধরে ছুটছিল বাস। ঘুমিয়ে পড়েছিলেন অনেকেই। হঠাৎ ১০-১২ জনের একটি দল বাসের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। অস্ত্রের মুখে দ্রুত যাত্রীদের হাত, মুখ, চোখ বেঁধে ফেলে। এরপর লুট করা হলো যার কাছে যা ছিল সবই—মোবাইল ফোন, টাকা, স্বর্ণালংকার। বিভীষিকা এখানেই থেমে যায়নি। অস্ত্রধারীরা বাসের এক নারী যাত্রীকে চার দফায় ধর্ষণ করে। আরও কয়েক নারীকে করা হয় নির্যাতন।
চলন্ত বাসে তিন ঘণ্টার এই বিভীষিকা থামে টাঙ্গাইলের মধুপুরে এসে। বাসের গতি কমিয়ে নেমে পড়ে ডাকাত দল। তখন বাসটি রাস্তার পাশে বালুর ঢিবিতে ধাক্কা খেয়ে কাত হয়ে পড়ে। এতেও আহত হন কয়েকজন।
গত মঙ্গলবার দিবাগত রাতের এ ঘটনার পর গতকাল বুধবার মধুপুর উপজেলার রক্তিপাড়া নামক স্থানে গিয়ে দেখা যায় ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের পাশে কাত হয়ে পড়ে আছে ঈগল পরিবহনের বাসটি। ডিবি পুলিশের একটি দল তদন্তকাজ চালাচ্ছে। পুলিশের সহযোগিতায় একদল উদ্ধারকর্মী বাসটি টেনে তোলার চেষ্টা করছেন।
টাঙ্গাইলের পুলিশ সুপার সরকার মোহাম্মদ কায়সার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে থানায় এসে বাসযাত্রী ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। এ সময় ময়মনসিংহ থেকে আসা ডিএনএ পরীক্ষাগারের কর্মীদের থানায় অবস্থান করতে দেখা গেছে।
মধুপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মাজহারুল অমিন বলেন, ‘ডাকাতদল যাত্রীদের মালামাল লুটের পর নারীযাত্রীকে ধর্ষণ করেছে। ভুক্তভোগীকে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এ ঘটনায় এক যাত্রী বাদী হয়ে মামলা করেছেন।’
ওসি আরও জানান, জড়িতদের গ্রেপ্তারের জোর চেষ্টা চলছে। বাস চালক ও হেলপারকেও পিটিয়ে আহত করে
বেঁধে রেখে যাত্রীদের সর্বস্ব লুট করে তারা। পুলিশ সুপার সরকার মোহাম্মদ কায়সারের আর্থিক সহায়তা ছিনতাইয়ের শিকার যাত্রীদের প্রত্যেকের বাড়িতে পাঠানো হয়েছে।
বাসের যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঈগল পরিবহনের বাসটির যাত্রা শুরু হয়েছিল কুষ্টিয়া থেকে। ২৫ জনের মতো যাত্রী নিয়ে সন্ধ্যার চট্টগ্রামের উদ্দেশে ছেড়েছিল বাসটি। রাত সাড়ে ১২টার দিকে বাসটি বঙ্গবন্ধু সেতু পার হয়। অনেক যাত্রী তখন ঘুমাচ্ছিলেন। এরপরই শুরু হয় ডাকাতদের তৎপরতা। যাত্রীবেশী ডাকাতরা শুরুতেই অস্ত্রের মুখে ঘুমন্ত যাত্রীদের হাত, মুখ, চোখ বেঁধে ফেলে। এরপর তাঁদের কাছ থেকে মোবাইল ফোন, টাকা, স্বর্ণালংকার লুটে নেয়। পরে ডাকাত দলের সদস্যরা গাড়িতে থাকা নারীদের নির্যাতন করে। টানা তিন ঘণ্টা যাত্রীদের ওপর চালানো নির্যাতনের পর রাত ৩টা ২৫ মিনিটে মধুপুরের রক্তিপাড়া নামক স্থানে এসে বাসটির গতি কমিয়ে ডাকাত দল নেমে যায়। মুহূর্তের মধ্যেই চোখ, মুখ ও হাত বাঁধা যাত্রীদের নিয়ে বাসটি রাস্তার পাশের বালুর ডিবিতে ধাক্কা খেয়ে কাত হয়ে পড়ে। শব্দ শুনে স্থানীয় লোকজন এগিয়ে এসে যাত্রীদের উদ্ধার করেন।
বাসের যাত্রী ছিলেন নাটোরের বড়াইগ্রামের বাসিন্দা ফল ব্যবসায়ী হাবিবুর রহমান। তিনি রাত ১০টার দিকে নাটোরের তরমুজ চত্বর থেকে বাসে ওঠেন। ওই বাসে তিনি অনেক দিন ধরেই নিয়মিত যাতায়াত করেন বলে জানিয়েছেন।
হাবিবুর রহমান বলেন, ‘বাসটি সিরাজগঞ্জের কাছাকাছি দিবারাত্রি হোটেলে নৈশভোজের জন্য বিরতি দেয়। তখন বাস থেকে নেমে অনেকেই ওই হোটেলে খাবার খায়। বাসের সুপারভাইজার রাব্বি ও হেলপার দুলালের সঙ্গে বসে আমিও খাবার খেয়েছি। আগে যে চালক বাস চালাতেন আজ সেই চালক ছিলেন না। কড্ডার মোড়ে আসার পর গেঞ্জি-শার্ট পরা ১০-১২ যাত্রী ওঠে বাসে। তাদের প্রত্যেকেরই পিঠে ব্যাগ ছিল। তারা বাসের খালি সিটগুলোতে বসে পড়ে।’
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে হাবিবুর রহমান আরও বলেন, ‘দ্রুতগতিতে চলছিল বাস। অনেক যাত্রীই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। বাসটি বঙ্গবন্ধু সেতু পার হওয়ার পর যাত্রীবেশে থাকা ডাকাত দল ঘুমন্ত যাত্রীদের অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে বাসের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। এরপর একে একে সব যাত্রীর হাত, চোখ, মুখ বেঁধে ফেলা হয়। শিশুদেরও একই কায়দায় বেঁধে রাখে তারা। পরে পাঁচ মিনিটের মধ্যে সব যাত্রীর কাছ থেকে মোবাইল ফোন, টাকা, গয়না লুট করে নেয়। তারপর নারী যাত্রীদের পাশবিক নির্যাতন চালায় তারা। আমার পাশে বসা নারীর ওপর চার দফায় ধর্ষণ করা হয়েছে। আমি অনুধাবন করতে পেরেছি। আমরা অসহায় ছিলাম। হাত, মুখ, চোখ বাঁধা কিছুই করতে পারিনি।’
বাসটির আরেক যাত্রী কুষ্টিয়ার দৌলতপুর থানার তারাগুনিয়া গ্রামের শিল্পী বেগম। তিনি বলেন, ‘অসুস্থ মেয়েকে চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নিয়ে যাচ্ছিলাম। আমাদের সবাইরে হাত, মুখ, চোখ বাইন্দা ডাকাতরা সব লুট কইরা নিছে। আমার স্বামী পিয়ার আলীকে ছুরি দিয়ে আঘাত করছে। আমার কাছ থিকা ৩০ হাজার টাকা নিয়া গেছে।’ বাসে থাকা অন্য নারী যাত্রী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বলে জানান তিনি।
বেসরকারি চাকরিজীবী নারায়ণগঞ্জের বাসিন্দা আবদুর রশিদ নাটোর থেকে বাড়ি যাচ্ছিলেন অসুস্থ মাকে দেখার জন্য। তিনি বলেন, ‘বেতনের ২২ হাজার ৮০০ টাকা কাছে ছিল। ডাকাতরা সেই টাকা নিয়ে গেছে। দয়া কইরা ১০০ টাকা পকেটে রাইখা গেছে।’
মধুপুরের বাসযাত্রীরা জানান, মধুপুরের রক্তিপাড়ায় পৌঁছে ডাকাত দল নেমে গেলে বাসটি রাস্তার ধারে কাত হয়ে পড়ে। তখনো তাঁদের সবার চোখ, মুখ ও হাত বাঁধা। শব্দ শুনে স্থানীয় লোকজন এগিয়ে এসে যাত্রীদের উদ্ধার করেন।
বাসযাত্রী হাবিবুর রহমান বলেন, ‘স্থানীয় বাসিন্দারা আমাদের উদ্ধার করেছেন। রক্তিপাড়া জামে মসজিদের ইমাম আমাকে নাশতাও করিয়েছেন।’
মধুপুর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) এনামুল হক জানান, খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে যায়। বাসযাত্রীদের উদ্ধার করে থানায় নিয়ে আসা হয়। বাসের মধ্যে ডাকাতদের ফেলে যাওয়া দেশীয় অস্ত্রও পাওয়া গেছে।