প্রশ্নটি প্রথমে অনেকের কাছে অবান্তর মনে হতে পারে। সর্বশেষ কিছু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আমাকে প্রশ্নটি করতে উৎসাহিত করেছে। আমরা অনেকেই বলে থাকি, এখনকার শিক্ষকগণ পড়াশোনা করতে চান না, করেন না। এটি একটি প্রচলিত ধারণা এবং তার সাথে বাস্তবতার যে একেবারে মিল নেই, তাও নয়। তবে এটি সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয় বরং এটি বলে আমরা শিক্ষকদের অবমূল্যায়ন করছি।
ইংলিশ টিচার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইট্যাব) করোনাকালে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষকদের পেশাগত উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন ধরনের ‘অনলাইন’ কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। ওয়েবনেয়ার করেছে। সেখানে শিক্ষকদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ তার একটি প্রমাণ ছিল। কোভিড পরবর্তীকালে শিক্ষকদের পেশাগত উন্নয়নের জন্য ইট্যাব পরিচালিত দেশের বিভিন্ন এলাকায় শিক্ষাসংক্রান্ত বিভিন্ন কার্যক্রমে শিক্ষকগণ সশরীরে উপস্থিত হয়েছেন। সেটি আর একবার প্রমাণ করছে যে, তারা জানতে আগ্রহী, তাদের জানার ক্ষুধা আছে এবং সে ক্ষুধা নিবারণের জন্য সে রকম ব্যবস্থা নেই। কারণ এমন একটি ধারণ প্রচলিত আছে যে, একজন শিক্ষক জীবনে একবার বিএড কিংবা এমএড ডিগ্রি নিলেই বোধহয় তার পেশাগত উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দেয়। আসলে পেশাগত উন্নয়ন একটি চলমান প্রক্রিয়া। নিত্যনতুন আবিষ্কারের সাথে, থিওরির সাথে, পদ্ধতির সাথে, বিশ্বের কোথায় কী হচেছ, শিক্ষায়, শিক্ষা বিজ্ঞানে কী আবিষ্কৃত হয়েছে ইত্যাদি বিষয়ের সাথে পরিচিত থাকাটা আধুনিক যুগের প্রতিটি শিক্ষকের অবশ্য করণীয় দায়িত্ব ও কর্তব্য। আধুনিক যুগের শিক্ষার্থী যারা টেলিভিশনের পর্দায়, মোবাইলের পর্দায় সারা পৃথিবী দেখতে পারে, তাদের শুধু শুষ্ক বইয়ের পৃষ্ঠা, কিংবা শাসনের ভয় দেখিয়ে শ্রেণিকক্ষে যে বসিয়ে রাখা যায় না, তাদের চেয়েও চতুর ও দক্ষ হতে হয় বিষয়টি নিশ্চয়ই শিক্ষকদের বুঝতে হচ্ছে। আর এসব পরিবর্তনের সাথে প্রাতিষ্ঠানিক একটি প্রশিক্ষণ খাপ খাওয়ার মসলা যে দিতে পারে না, সেটিও আজ শিক্ষকদের না বোঝার কথা নয়। তাই, শিক্ষকগণ যাতে অবিরত পেশাগত উন্নয়ন প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত থাকতে পারেন, তার জন্যই (ইংলিশ টিচার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ) ইট্যাব।
৩ জুন সিরাজগঞ্জে একটি প্রোগ্রাম করেছি। আলোচ্য বিষয় ছিল ‘ইংরেজি ভাষার চারটি দক্ষতায় আমাদের শিক্ষকদের অবস্থান’। ৫৬ জন শিক্ষক সেখানে উপস্থিত ছিলেন। কেউ কেউ যমুনা নদী পার হয়ে এসেছেন এটি জেনেও যে, এখানে কোনো অর্থকড়ি দেয়া হবে না, যা সাধারণত শিক্ষক প্রশিক্ষণে দেয়া হয়। আমরা জানি, শিক্ষকদের কোনো সমাবেশ হলে, কোনো প্রশিক্ষণ হলে শিক্ষকগণ সাধারণত একাডেমিক বিষয়ের সাথে এবং অনেক সময় একাডেমিক আলোচনার বাইরে নন একাডেমিক, তাদের সুযোগ সুবিধা, তাদের সমাজ বা রাষ্ট্রকর্তৃক অবমূল্যায়ন ইত্যাদি নিয়ে বেশি আলোচনা করে থাকেন। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন পর্যায়ে প্রশিক্ষণ করাতে কিংবা পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে এই বিষয়টি দেখেছি। কিন্তু অবাক হয়ে দেখলাম, এই ওয়ার্কশপে আসা শিক্ষকগণ পুরো সমযটিই সিরিয়াস বিষয় নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন। নিজেরা যে ভাষার চারটি স্কিলে পিছিয়ে আছেন, কীভাবে তার উন্নয়ন ঘটানো যায়, শিক্ষার্থীদের দু’চারটি গ্রামারের নিয়ম ও কঠিন নিয়মাবলি শেখানোই যে ইংরেজি শেখানো নয়, বিষয়টি যখন অনুধাবন করতে পেরেছেন, তখন নিজেদের সঠিক উন্নয়ন কীভাবে ঘটে, সে বিষয়টি নিয়েই তারা ব্যস্ত ছিলেন, যা খুবই ভাল লেগেছে। তাদের এই বোধোদয়ের মাধ্যমে শ্রেণিকক্ষে যখন পরিবর্তন আসবে, তখন সমাজ পাল্টাতে বাধ্য। কিন্তু শুরু করতে হবে শিক্ষকের নিজের গণ্ডী থেকে, শুধু রাষ্ট্রকে বা ব্যবস্থাকে দোষারোপ করে লাভ নেই। কারণ শিক্ষাব্যবস্থার মূল চালিকাশক্তি শিক্ষকগণই। তারাই নতুন কোনো ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করবেন।
১৭ জুন চাঁদপুরের মতলবে একটি ওয়ার্কশপ করেছি ‘এনগেইজিং লার্নার্স ইন দ্যা ক্লাসরুম’ শিরোনামে। চল্লিশজনের মতো শিক্ষক উপস্থিত ছিলেন। শিক্ষার্থীদের কেন শ্রেণিকার্যক্রমে অংশগ্রহণ করাতে হবে, কীভাবে করাতে হবে, না করালে তাদের কী কী সমস্যা হয়, শিক্ষকের কী কী সমস্যা হয়, পুরো শিক্ষাকার্যক্রমে কি তার প্রভাব পড়ে ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলোচনা, প্রেজেনটেশন, প্রশ্নোত্তরপর্ব ছিল। শ্রেণিকার্যক্রমে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ করাতে হলে একটি আকর্ষণীয় ঘটনা দিয়ে শ্রেণিকার্যক্রম শুরু করা, শিক্ষার্থীদের উৎসাহ প্রদান, শিক্ষার্থীদের বয়স অনুযায়ী অ্যাটেনশন স্পান/মনোযোগ ধরে রাখার সময়কাল নির্ভর করে, সেই অনুযায়ী লেসন প্লান করা, বিভিন্ন লার্নিং স্টাইল প্রয়োগ করা, পাঠসমূহ খেলায় রূপান্তর করা, গল্পে রূপান্তর করা ইত্যাদি টেকনিক শিক্ষকদের জানতে হবে। তা না হলে শুধু লেকচার দিয়ে শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষে ধরে রাখা যাবে না। আর এসব বিষয়ই আলোচিত হয়েছে প্রোগ্রামটিতে। সেখানেও শিক্ষকদের আগ্রহ দেখে আনন্দিত হয়েছি। আসলে শিক্ষকগণ জানতে চান, তারা তাদের পেশার উন্নয়ন চান কিন্তু কীভাবে চান, কীভাবে করালে তাদের অংশগ্রহণ সম্ভব, সেটি নিয়ে আমরা অনেকেই চিন্তা করি না। শুধু বলি শিক্ষকগণ জানতে চান না, পড়তে চান না, তারা শুধু অর্থ চান। বিষয়টি সকলের ক্ষেত্রে ঠিক নয়। অনেক আগ্রহী শিক্ষক পেয়েছি, যারা নিজ ইচ্ছায় ইট্যাব নামক পেশাগত উন্নয়নে প্লাটফর্মের সদস্য হয়েছেন, এখনও হচেছন। নিজের অর্থ খরচ করে এই প্লাটফর্ম কর্তৃক আয়োজিত বিভিন্ন কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করছেন। এই আনন্দের সংবাদটি সংশ্লিষ্টদের জানাতেই পত্রিকার পাতায় আশ্রয় নেয়া।
২২ জুলাই ‘শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক মোটিভেশনের গুরুত্ব শীর্ষক’ একটি ওয়ার্কশপ করেছি গাজীপুরে। পঞ্চাশজনের অধিক শিক্ষক অংশগ্রহণ করেছেন। তাদের স্বত:স্ফূর্ত অংশগ্রহণ, প্রশ্ন করা, প্রেজেনটেশনের বিভিন্ন পয়েন্ট ব্যাখ্যা করা, শিক্ষার উন্নয়নে বিশেষ করে ইংরেজি ভাষা শিক্ষার ওপর তাদের আগ্রহ, শিক্ষার্থীদের ফলপ্রসূভাবে ইংরেজি শেখানো নিয়ে কথা হয়েছে, আলোচনা হয়েছে, তারা এই পেশাগত উন্নয়নের প্লাটফর্মে লেগে থাকার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। তারা সবাই বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক কিন্তু একবারও কেউ সমস্যার কথা বলেননি। তারা পুরো সময়ই ব্যয় করেছেন ’মোটিভেশন’ বিষয়টি কী, এক্সাটারনাল মোটিভেশন, ইন্টারনাল মোটিভেশন, একজন ডিমোটিভেটেড শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে, শিক্ষার্থীদের সাথে কীভাবে আচরণ করেন, প্রতিষ্ঠানকে কীভাবে সার্ভিস দেন। একজন ডিমোটিভেটেড শিক্ষক কী আচরণ করেন, একজন শিক্ষক কীভাবে মোটিভেটেড হতে পারেন ইত্যাদি বিষয় আলোচনা হয়েছে। শিক্ষকরা মন দিয়ে শুনেছেন, সক্রিয়ভাবেই অংশগ্রহণ করেছেন যেটি আনন্দের বিষয়। বিশ্বে প্রতিবছর অর্ধ মিলিয়ন শিক্ষক তাদের পেশা ছেড়ে দেন এবং তাদের মধ্যে ৪১শতাংশ শ্ক্ষিক তাদের চাকরির ৫ বছরের মধ্যে চাকরি ছেড়ে দেন। তারা পেশার সাথে তাল মেলাতে পারেন না। এখানে মোটিভেশনের অভাব রয়েছে। কিন্তু আমাদের গ্রামীণ জনপদের বেসরকারি শিক্ষকগণ যেভাবে নিজেরা ওয়ার্কশপের বিভিন্ন বিষয় আলোচনা করছেন, কোনো কিছুর সংজ্ঞা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন, তাতে কেউ আনন্দিত না হয়ে পারবেন না। আবার ছোট একটি অংশ কোনোভাবে কোনো কথা বলার চেষ্টা করছেন না। তার মানে তারা তাদের লজ্জা কাটাতে পারছেন না, ইতস্তততা কাটিয়ে উঠতে পারছেন না। বোঝা যায়, শ্রেণিকক্ষে তাদের শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটে। ওয়ার্কশপে এ বিষয়গুলোও আলোচনা করা হয়েছে যাতে তারা শ্রেণিকাজে, ওয়ার্কশপের কাজে অংশগ্রহণ করেন।
শিক্ষামূলক ওয়ার্কশপ, সেমিনার, সিম্পোজিয়ামে যোগদান করলে শিক্ষকদের আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়, নতুন নতুন ধারণা একে অপরের সাথে শেয়ার করতে পারেন, অভিজ্ঞতা বিনিময়ের ফলে তাদের জ্ঞানের ভাণ্ডার আরও সমৃদ্ধ হয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বছরের পর বছর শুধু শ্রেণিকার্যক্রম, খাতা মূল্যায়ন, পরীক্ষা নেয়া ইত্যাদি কাজে ব্যস্ত থাকলে পেশাগত উন্নয়ন যেমন কম হয়, তেমনি শিক্ষকগণ একই ধরনের কাজ করে করে বিরক্ত হয়ে যান। তাই মাঝে মাঝে তাদের শিক্ষামূলক কোনো কাজে অংশগ্রহণ করতে হয়। সেটি হতে পারে নিজের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, হতে পারে অন্যের প্রতিষ্ঠানে। এর সাথে আর একটি উপকার হয়। সেটি হচ্ছে তাদের শিক্ষা সার্কেল বা নেটওয়ার্কের সম্প্রসারণ। শিক্ষা সার্কেল বাড়ানো মানে হচ্ছে অভিজ্ঞতা ক্ষেত্রের প্রসারণ ঘটানো। এতে মন আরও উদার হয়। শিক্ষাসংশ্লিষ্ট যত দুর্নীতি, ব্যর্থতা, হীনন্মন্যতা ইত্যাদি বিষয় মন থেকে, নিত্যদিনের আলোচনা থেকে কমতে থাকে। বৃদ্ধি পেতে থাকে শিক্ষাগত যোগ্যতাসমূহ। প্রকৃত শিক্ষকসুলভ আচরণের ক্ষেত্রগুলো উন্নত হতে থাকে।
লেখক : কান্ট্রি ডিরেক্টর, ভলান্টিয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন ফর বাংলাদেশ (ভাব)