শিক্ষায় শাসন বনাম সোহাগ - দৈনিকশিক্ষা

শিক্ষায় শাসন বনাম সোহাগ

অধ্যক্ষ মুজম্মিল আলী |

আমাদের ছোট বেলায় মসজিদ- মক্তবে পড়া শিখে না গেলে কিংবা দুষ্টুমি করলে হুজুর এক আধটা বেত, কান মলা, কান ধরে উঠবস ইত্যাদি শাস্তি দিতেন। প্রাইমারি এবং হাই স্কুল পর্যায়ে ও আমরা এ সব শাস্তি পেয়েছি। কলেজে যাবার পর থেকে এ রকম শাস্তি আর পাইনি কিংবা দেখি ও নি। এ পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের বোঝে ওঠার ক্ষমতা মোটোমুটি বেড়ে যায় এবং দুরন্তপনা অনেক কমে যায় বলে শাসন বা শাস্তির প্রয়োজন পড়েনি।

‘শাসন করা তারই সাজে, সোহাগ করে যে। ‘ মসজিদ-মক্তবে হুজুর কিংবা স্কুলের স্যারদের কাছ থেকে আমরা যতটুকু না শাস্তি পেয়েছি, তারচে’ তাদের আদর মমতা পেয়েছি বেশী।

আপন সন্তানের ন্যায় অতি যত্ন সহকারে মসজিদ-মক্তবের হুজুর এবং স্কুলের স্যারেরা আমাদের পড়াতেন, আদব কায়দা শিক্ষা দিতেন এবং প্রয়োজনে আদর- মাখা একট-আধটু শাসন করতেন।

আমরা কখনো কখনো বাড়ি ফিরে মসজিদের হুজুর কিংবা স্কুলের স্যারের বিরুদ্ধে অভিযোগ করতাম। আমাদের মা-বাবা অথবা বড় ভাই-বোন আমাদের শরীরে যেখানটায় হুজুর কিংবা স্যার বেত দিয়েছেন, সেখানটায় হাত বুলাতে বুলাতে শান্ত্বনা দিয়ে বলতেন, ” স্যার ও হুজুর যে জায়গায় বেত দেন, তা মৃত্যুর পর বেহেস্তে যায়। “সে কথায় অগাধ বিশ্বাস রেখে আমরা শাস্তির কথা একদম ভুলে যেতাম। যে স্যার বা হুজুরের দেয়া শাস্তির জায়গাটা বেহেস্তে যায়, তার প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা কতেক গুণ বেড়ে যেত। স্যার ও হুজুরের প্রতি আমাদের অভিভাবকদের অগাধ বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা ছিল। আমাদের নিয়ে তাদের হাতে সঁপে দিতেন এ কথা বলে,”কেবল হাড্ডি আমার আর বাকী সব আপনার।”

আমাদের হুজুর কিংবা স্যারেরা কোনদিন কাউকে অন্যায় ভাবে শাসন করতে বা শাস্তি দিতে দেখিনি।যে শাসন ভালোর জন্য অপরিহার্য ছিল, কেবল সে শাসনটাই করতেন।

কিন্তু, আজকাল আমাদের কোন কোন হুজুর ও শিক্ষক আছেন -যারা কোমলমতি শিক্ষার্থীদের শাস্তি বা শাসনকে নির্যাতনের পর্যায়ে নিয়ে যান। অনেকের এ সব শাসন ও শাস্তি পাশবিকতাকে পর্যন্ত হার মানায়। তারা এমন ভাবে মারধর করেন, যাতে আদর কিংবা সোহাগের এতটুকু লেশমাত্র থাকে না। তারা শিশু-শিক্ষার্থীদের কখনো কখনো শাসনের নামে এমন শাস্তি দেন, যা কথিত শিশু নির্যাতনকে ও ছাড়িয়ে যায়। তবে, এ জাতীয় শিক্ষক বা হুজুরের সংখ্যা একেবারে নগন্য। শতকরা হিসেবে বড় জোর পাঁচ কিংবা দশ জন হতে পারেন, এর বেশী ন।

শতকরা এ পাঁচ- দশজনের কারণে শিক্ষকদের শাসন বা শাস্তি দেবার বিষয়টি নিয়ে দিনে দিনে নেতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি হয়। আমাদের অভিভাবকদের ও ধ্যান-ধারণায় আসে পরিবর্তন। সরকার বাধ্য হয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে শাস্তি দেবার বিষয়টিকে বেআইনি ও শাস্তিযোগ্য ঘোষণা করেন।

এ সুযোগে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা আজকাল শিক্ষকের অবাধ্য ও অননুগত হয়ে ওঠছে। শিক্ষককে তাদের এতটুকু ভয় কিংবা শ্রদ্ধা নেই। তারা শিক্ষককে সামান্যই কেয়ার করে। পড়াশুনায় তাদের তেমন একটা মনযোগ নেই। ইচ্ছে মত স্কুল কামাই করে। যত্রতত্র আড্ডা মারে। শিক্ষক বাড়ির কোন কাজ দিলে সে সবে তাদের কোন গরজ থাকে না। ইচ্ছে মত হাতের নখ লম্বা করে । নানা সাইজ, কিসিম ও ঢংয়ে মাথায় চুল রাখে। পাঠ্যপুস্তকের চেয়ে মোবাইল ও ফেসবুকে তাদের বেশী মনযোগি দেখা যায়।

মাধ্যমিক পর্যায়ে অনেক শিক্ষার্থীর বয়ঃসন্ধিকাল অতিক্রম করার বয়স। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এ বয়সকে ইঙ্গিত করে বলেছেন, “চৌদ্দ পনের বছর বয়সের মতো এমন বালাই আর পৃথিবীতে নাই। “আসলে এ বয়সে যে কোন একটা কিছু ঘটিয়ে দেবার মনোভাব থাকে অনেকের। এ সময়ে তাদের একটা নিয়ম-কানুনের মধ্যে রাখা লাগে। লাগামহীন ভাবে তাদের ছেড়ে দিলে যে কোন অঘটন তারা ঘটিয়ে দিতে পারে।

সরকার শিক্ষার্থীদের শাস্তি দেবার বিষয়টিকে শাস্তি যোগ্য অপরাধ হিসেবে প্রজ্ঞাপন জারি করার কারণে অনেক শিক্ষা বিদ্বেষী ও শিক্ষক বিরোধী লোক এর অপব্যবহারের সুযোগ নিচ্ছে। স্কুল সময়ের বাইরে খেলায় অথবা দৌড়াদৌড়িতে হাত-পা ভেঙ্গেছে কিংবা মাথা ফেটেছে। যে কোন কারণে শিক্ষকের সাথে অভিভাবকের মনোমালিন্য। এ সুযোগে শিক্ষকের নামে থানায় কিংবা কোর্টে মামলা। এ ভাবে এ যাবত কত নিরীহ শিক্ষক যে হয়রানীর শিকার হয়েছেন, তার হিসেব কে রেখেছে?

আমাদের প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সঃ) এর কাছে প্রথম হেরা পর্বতের গুহায় হজরত জিব্রাইল (আঃ) ওহি নিয়ে এসে বলেন, ‘ইকরা’ অর্থাৎ ‘পড়’। নবী মোহাম্মদ (সঃ)পর পর তিন বার পড়তে পারেন না বলে জানালে হযরত জিব্রাইল (আঃ) নবীজিকে বুকে জড়িয়ে ধরে একটা আলিঙ্গন করেন। এ আলিঙ্গনের মধ্যে যেমন আদর-মহব্বত ছিল তেমনি কিছুটা বল প্রয়োগ ও ছিল। নবীজি তাতে কিছুটা ভয় ও কষ্ট অনুভব করেছিলেন। তিনি বাড়ি ফিরে যান এবং জ্বরে আক্রান্ত হন। এ ঘটনার পর থেকে নবীজির জ্ঞানের দ্বার চির উন্মুক্ত ও প্রসারিত হয়ে যায়। এ থেকে আমরা কী শিক্ষা পাই? এতে শিক্ষায় সোহাগ ও শাসন-এ দুয়ের কী ঐশী ইঙ্গিত মেলে না?

মা-বাবা এ বয়সে সন্তানের মঙ্গলের জন্য যেটুকু শাসন করা প্রয়োজন, তাই করে থাকেন। শিক্ষকদের আমরা দ্বিতীয় জন্ম দাতা বলে জানি। কেবল মঙ্গলের জন্য শিক্ষক এক-আধটু শাসন করলে তাতে ক্ষতির কিছু আছে বলে মনে হয় না। পনের ষোল বছর বয়স পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের কিছুটা শাসনের মধ্যে না রেখে অবাধ চলাফেরার সুযোগ দেয়াটা কতটুকু সমীচিন, তা আরেকটু ভেবে দেখা অপরিহার্য হয়ে ওঠেছে। তবে শিক্ষক হয়ে যারা শাস্তির নামে অমানবিক ও পাশবিক নির্যাতন করে, তারা শিক্ষক নামের কলংক। এমন লোকের শিক্ষক হবার সুযোগ বারিত হওয়া প্রয়োজন।

লেখক: অধ্যক্ষ মুজম্মিল আলী, চরিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, কানাইঘাট, সিলেট।

শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা - dainik shiksha শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা - dainik shiksha রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা ট্রেনে কাটা পড়ে স্কুলশিক্ষকের মৃত্যু - dainik shiksha ট্রেনে কাটা পড়ে স্কুলশিক্ষকের মৃত্যু গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা কাল - dainik shiksha গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা কাল শিক্ষকরাই স্মার্ট নাগরিক গড়ার কারিগর: শিল্পমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষকরাই স্মার্ট নাগরিক গড়ার কারিগর: শিল্পমন্ত্রী এনটিআরসিএর সার্টিফিকেট সংশোধনের নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha এনটিআরসিএর সার্টিফিকেট সংশোধনের নতুন নির্দেশনা মর্নিং স্কুলের ছয় সুবিধা উল্লেখ করলেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা - dainik shiksha মর্নিং স্কুলের ছয় সুবিধা উল্লেখ করলেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা দেড় মাস পর ক্লাসে ফিরছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা, স্থগিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা - dainik shiksha দেড় মাস পর ক্লাসে ফিরছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা, স্থগিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে চায় সরকার - dainik shiksha অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে চায় সরকার দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0028219223022461