শিক্ষকদের ‘ক্রীতদাস’ ভাবা কাম্য নয় | শিক্ষাবিদের কলাম নিউজ

শিক্ষকদের ‘ক্রীতদাস’ ভাবা কাম্য নয়

যে শিক্ষক তাদের সেবা দিয়ে জীবন আলোকিত করেছে, তারা ফাস্ট ক্লাস হতে ফাস্ট হয়ে শিক্ষক সমাজকে করে রেখেছেন, থার্ড ক্লাস কর্মচারী করে। শিক্ষক জাতির গুরু হয়েও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পদধুলি তো নয় সাক্ষাৎ তথা বসার চেয়ারটুক তাদের ভাগ্যে জোটে না।

#শিক্ষক

অর্থের বিনিময় কাজ করিয়ে রাষ্ট্র, ব্যক্তি ও সমাজ তথা জনগোষ্ঠীর সেবা অর্জন করে থাকেন। দেশের প্রায় নাগরিক উচ্চপর্যায় থেকে নিম্নপর্যায়ে একে অপরকে সেবাদানের মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করে থাকেন। যথাক্রমে ডাক্তার, উকিল, শিক্ষক, চাকরিজীবী, কৃষক, শ্রমিক, গৃহের কাজের লোকসহ অন্যান্যরা। প্রত্যেকে তাদের কাজের বিনিময়ে সেবা দিয়ে পারিশ্রমিক গ্রহণ করে থাকেন। এ সেবার বিনিময় ব্যক্তি, সমাজ, প্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্র তথা সরকার উপকৃত হয়। সেবার পারিশ্রমিক কম বা বৈষম্য হলে সেবাদানকারী ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর মাঝে অসন্তোষ সৃষ্টি হয়। মালিক বা সরকারকে নানাভাবে নোটিশ দিতে দিতে অধিক মেধাবীরা তথ্য দক্ষ জনবল ভালো সুযোগ পেলে সুবিধাজনক পারিশ্রমিকে অন্যত্র বা লাভজনক পেশায় চলে যায়। দেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ের বিবেকবান মন্ত্রী-উপদেষ্টারাও এই সুযোগ হাতছাড়া করতে চায় না। কাঙ্ক্ষিত সেবা পেতে হলে ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান তথা রাষ্ট্রের মানসিকতায় সেবা প্রদানকারীর প্রতি আন্তরিকতারও সদয় মনোভাব থাকতে হয়। বিশেষ করে স্বাধীনতার দীর্ঘ ৫ দশক পরেও শিক্ষাব্যবস্থার বেহাল দশার মূলে রয়েছে বিশেষ করে মন্ত্রী, উপদেষ্টা ও সচিব নামক ক্ষমতাশীল ব্যক্তিরা। তাদের বেশিরভাগেরই মাঝে শিক্ষার উন্নয়নের পরিবর্তে অহমিকাসহ অধিক অর্থ উপার্জনের মনোভাব জাগ্রত থাকে।

যে শিক্ষক তাদের সেবা দিয়ে জীবন আলোকিত করেছে, তারা ফাস্ট ক্লাস হতে ফাস্ট হয়ে শিক্ষক সমাজকে করে রেখেছেন, থার্ড ক্লাস কর্মচারী করে। শিক্ষক জাতির গুরু হয়েও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পদধুলি তো নয় সাক্ষাৎ তথা বসার চেয়ারটুক তাদের ভাগ্যে জোটে না। এই দৃশ্য চলে আসছে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে উচ্চপর্যায়ে। শিক্ষকতা সর্বোৎকৃষ্ট পেশা। এ পেশাকে হেয় প্রতিপন্ন করার কাজটি করা হচ্ছে সুধী সমাজ নামক ব্যক্তিসহ রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ে। প্রাথমিক বিদ্যালয় লেখাপড়া হয় না। এই বাক্যটি তাদের মুখে মুখে। বাস্তবে সারা দেশে শিক্ষাব্যবস্থার জ্ঞানমুখী শিক্ষা দেয়া হচ্ছে প্রাথমিক বিদ্যালয়। অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো মুখস্থনির্ভর, জিপিএ-৫ নির্ভর ও পরীক্ষাবান্ধব শিক্ষাদান করে যাচ্ছে। কারণ, সেসব প্রতিষ্ঠানে উচ্চশিক্ষিত জনবল থাকলেও মেধাবী ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকের অভাব। উচ্চশিক্ষিত, মেধাবী ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকেরা মেধার বিকাশ ঘটিয়ে শিক্ষার্থীদের গড়ে তুলেছেন। মেডিক্যাল, বুয়েট, বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিসিএসসহ সর্বত্র বিপুল সংখ্যক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে, প্রাথমিকের শিক্ষার্থীরা মেধার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখে চলেছেন। এর অন্যতম কারণ প্রাথমিক শিক্ষকেরা শিশু শিক্ষা বিশেষজ্ঞ। এ মেধাবী প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বিশেষজ্ঞ শিক্ষকদের সুনাম ম্লান করে দিচ্ছেন নীতিনির্ধারণী পর্য্যায়ে কর্মকর্তাসহ মন্ত্রী ও উপদেষ্টারা। তারা বছরের পর বছর এমনকি যুগের পর যুগ প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক সংকট রেখে যাচ্ছেন। এক যুগের বেশিরভাগ সময় প্রাথমিকের প্রধান শিক্ষক পদ প্রায় ৪০ হাজার শূন্য। সহকারী শিক্ষক পদে শিক্ষক নিয়োগ হলেও দীর্ঘসূত্রতার কারণে শিক্ষক সংকটে বিপর্যস্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়।

এদিকে নিয়োগ দিলেও অপরদিকে অবসর, মৃত্যু, অন্য পেশায় চলে যাওয়া, অসুস্থতার, ছুটি প্রশিক্ষণসহ নানা কারণে শিক্ষক সংকটে নিমজ্জিত প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো। অনেকটা ‘নদীর এ-কূল ভাঙে ও-কূল গড়ে, এই তো নদীর খেলা’ প্রবাদের মতো। শিক্ষক সংকটের ফলে শিক্ষকেরা ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও তাদের প্রশিক্ষণ অনুযায়ী পাঠদান করতে পারছেন না। অপরদিকে রয়েছে পাঠদান বর্হিভূত অসংখ্য কাজের চাপ।

এ ছাড়া একজন শিক্ষককে দৈনিক ৬ থেকে ৭টা বা শিক্ষক সংকটের কারণে একনাগাড়ে এক সঙ্গে একাধিক শ্রেণিতে পাঠদান করতে হয়। একজন শিক্ষক সাধারণত দৈনিক তিনটা পিরিয়ডের বেশি পাঠ পরিকল্পনা তৈরি করে প্রশিক্ষণ মোতাবেক শিশু মনোবিজ্ঞানসম্মত শিক্ষার্থীকে আনন্দঘন পরিবেশে পাঠদান করাতে পারে না। শিক্ষক স্বল্পতার কারণে শিক্ষাকে যখন একাধিক ক্লাসে বা একনাগাড়ের ৬-৭টা পিরিয়ড পাঠদান করতে হয়, তখন শিক্ষক বাধ্য হন দায়সারাভাবে তাদের শিক্ষাদান কাজটি শেষ করতে। পত্রিকা বা ইলেকট্রনিক্স ও অনলাইন মিডিয়ায় প্রায় শিক্ষক সংকটে বেহাল চিত্র তুলে ধরা হচ্ছে। এ বেহাল চিত্রের জন্য দায়ী মন্ত্রী, উপদেষ্টা, সচিব ও মহাপরিচালক তারা কি কোনোদিন তাদের ব্যর্থতার জন্য দুঃখ প্রকাশ বা ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন? তা না করে তাদের ব্যর্থতার আড়াল করার জন্য প্রাথমিক শিক্ষকদের ওপর দায় চাপিয়ে যাচ্ছেন। এশিয়া মহাদেশের মধ্যে বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষক তথা শিক্ষক সমাজের বেতন সবচেয়ে কম। প্রাথমিক শিক্ষকেরা উন্নত বিশ্বের মতো তাদের প্রথম শ্রেণির মর্যাদা ও বেতন ভাতা দাবি করছেন না। তারা দেশের অভ্যন্তরে একই যোগ্যতা ও সমকাজে অন্যান্য পেশাজীবীর মতো বেতন চায়। এ প্রত্যাশা অযৌক্তিক হতে পারে না। এতে দেশে মর্যাদা ও বেতনের বৈষম্য দূর হবে। এ যৌক্তিক দাবি অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে করাতো অন্যায় বা রাষ্ট্রবিরোধী নয়।

বিশেষ করে, বর্তমান অন্তবর্তী সরকার, বৈষম্য নিরসনের প্রত্যাশা কাজ করে যাচ্ছেন। প্রাথমিক শিক্ষকেরা সব সরকারি কর্মচারীর মধ্যে নাগরিকদের মাঝে সম্মানিত অবস্থানে আছেন। তৃণমূলের মানুষ পারিবারিক ও সামাজিক বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে প্রাথমিক শিক্ষকদের দ্বারস্থ হয়ে থাকেন। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা উপদেষ্টার প্রায়ই বক্তব্যে বলেন, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে লেখাপড়া হয় না। ঢালাওভাবে বলে থাকেন, প্রাথমিক শিক্ষকেরা লেখাপড়ায় ফাঁকি দেন। যেহেতু আজকাল খুব নগণ্য শিক্ষকেরাও ফাঁকি দেয়ার সুযোগ নেই। বরং নীতিনির্ধারকসহ মন্ত্রী-উপদেষ্টারা প্রাথমিকের শিক্ষার্থী তথা শিক্ষকদের সমস্যা নিরসনে ফাঁকিবাজি না করে বা ছলচাতুরীর আশ্রয় নিয়ে প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থাকে পর্যুদস্ত করে ফেলেছে। প্রতিযোগিতায় উত্তীর্ণ হয়ে প্রাথমিক শিক্ষকেরা শিক্ষকতা পেশায় এসেছেন। উপদেষ্টার দায়িত্ব গ্রহণের প্রায় ছয় মাস হলো আজও একজনও ফাঁকিবাজ শিক্ষক চিহ্নিত করতে পেরেছেন তা দৃশ্যমান নয়। অথচ এ সময় প্রাথমিকে প্রধান শিক্ষক পদে পদোন্নতি এক যুগ থেকে বন্ধ, প্রধান শিক্ষকদের সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রায় বাস্তবায়ন, সহকারী শিক্ষকদের তৃতীয় শ্রেণি থেকে দ্বিতীয় শ্রেণিতে যাওয়ার যৌক্তিক প্রত্যাশা নিয়ে বিরূপ মন্তব্য, বরং বিগত আওয়ামী লীগ আমলের সহকারী প্রধান শিক্ষক পদ সৃষ্টির বাস্তবায়ন। সহকারী শিক্ষকদের দশম গ্রেড প্রাপ্তিতে গলার কাঁটা তা নিয়ে অগ্রণী ভূমিকা নিতে ব্যস্ত। ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে প্রাথমিক শিক্ষার মান উন্নয়নের পরিবর্তে বিগত সরকারের আমলের মতোই টালবাহানা ও ফাঁকিবাজি বিদ্যমান।

গত ৬ জানুয়ারি ২০২৫ দুপুরে চট্টগ্রাম নগরের সার্কিট হাউজের সভা কক্ষে মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নের করণীয় শীর্ষক বিনিময়ের সভা অনুষ্ঠিত হয়। মতবিনিময় সভায় উপদেষ্টা অধ্যাপক ডক্টর বিধান রঞ্জন পোদ্দার বেতন ভাতায় না পোষালে শিক্ষকদের অন্য পেশায় চলে যাওয়ার পরামর্শ দেন। এ বক্তব্য প্রাথমিক শিক্ষক তথা গোটা জাতির জন্য অবমাননাকর। প্রাথমিক শিক্ষকেরা রাষ্ট্রের কর্মচারী বা সেবক। তারা আদিম বর্বর যুগের কোনো ব্যক্তি বিশেষের ক্রীতদাস নয়। যে কেউ ক্রীতদাসকে যা কিছু তা বলতে, মারতে বা শাস্তি দিতে পারে। শিক্ষক সমাজের পাশাপাশি গোটা জাতি তার বক্তব্যে মানসিকভাবে পর্যুদস্ত। স্বাধীনতার পূর্ব মুহূর্তে পাকিস্তানের শাসকচক্র বুদ্ধিজীবীদের হত্যার মাধ্যমে জাতিকে মেধাশূন্য করতে চেয়েছিলো। অপরদিকে উপদেষ্টা শিক্ষক সমাজকে মানসিক কষ্ট দিয়ে সমস্যা নিরসনের পরিবর্তে প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে মেধা বিনাশ করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে যাচ্ছেন। অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে প্রতিমান হচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষা এনজিও অধীনে ন্যস্ত করার পাঁয়তারা করা হচ্ছে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. বিধান রঞ্জন পোদ্দার একজন মানসিক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। তার ভাবা উচিত, তিনি প্রাথমিক শিক্ষকদের তার বক্তব্য ও কার্যক্রমে মানসিক আঘাত কীভাবে নিরসন করা যায়। এই ব্যাপারে জাতির একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হিসেবে তিনি অবশ্যই চিকিৎসা করবেন। নাহলে এ মানসিক আঘাত প্রাথমিক শিক্ষা তথা জাতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা উপদেষ্টা শুভবুদ্ধির উদয় হোক। এই প্রত্যাশায়।

লেখক: শিক্ষাবিদ

#শিক্ষক