গত ৫ আগস্টের পর পদত্যাগে বাধ্য হওয়া ও হুমকি-ধমকির মুখে নিজ প্রতিষ্ঠানে যেতে না পারা শত শত শিক্ষকের বঞ্চনা, বিড়ম্বনা ও কষ্ট এখনো কাটেনি। যদিও গত ১৪ ও ২২ জানুয়ারির প্রজ্ঞাপন আশাবাদী করে তুলেছিল তাদের। যাতে বলা হয়েছিলো, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে পদত্যাগে বাধ্য হওয়া শিক্ষকদের বেতন-ভাতা নিয়মিত রাখা হবে। কিন্তু অনেক প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটির সভাপতি সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তর থেকে এ বিষয়ক পরিপত্র না পাওয়া খোঁড়া অজুহাতে ঝুলিয়ে রেখেছেন বিতাড়িত শিক্ষকদের ভাগ্য। ফলে ফি মাসে এমপির টাকা অধিদপ্তরগুলো থেকে পাঠানো হলেও তা তুলতে না পারায় সীমাহীন কষ্টের মধ্যে দিনাতিপাত করছেন শিক্ষকরা।
শনিবার নির্যাতিত একাধিক শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলে এমন চিত্রই পাওয়া গেছে।
দৈনিক আমাদের বার্তাকে বঞ্চিত শিক্ষকরা বলেছেন, শিক্ষা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ যেনো মন্ত্রণালয় থেকে অধিদপ্তরগুলোকে নির্দেশনা দেওয়ার ব্যবস্থা করেন, যাতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো ওই পরিপত্র বাস্তবায়ন করে।
গত কয়েকমাস ধরেই মন্ত্রণালয়, আদালত, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন দপ্তরে আবেদন-নিবেদন ও রিট করেছেন তারা। পদ ফিরে পেতে ও কর্মস্থলে নিরাপত্তার দাবিতে জাতীয় প্রেসক্লাব ও অধিদপ্তরের সামনে মানববন্ধনও করেছেন কয়েকবার। তাদের সংখ্যা দুই হাজার বলে দাবি করছেন ভুক্তভোগীদের অনেকেই। কাউকে আবার এলাকায় ও প্রতিষ্ঠানে অবাঞ্ছিতও ঘোষণা করা হয়েছে।
তাদের দাবির প্রেক্ষিতে শিক্ষা উপদেষ্টার নির্দেশে, জুলাই অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে পদত্যাগে বাধ্য হওয়া শিক্ষকদের বেতন-ভাতা নিয়মিত রাখতে গত ১৪ ও ২২ জানুয়ারি স্কুল ও কলেজ পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষষ্ঠানের জন্য পৃথক দুটো নির্দেশনা দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। যেখানে মন্ত্রণালয় থেকে শিক্ষা অধিদপ্তর ও বিভাগীয় কমিশনারদের জানানো হয়, ‘জোরপূর্বক পদত্যাগের পেছনে যাদের বিরুদ্ধে যৌক্তিক অভিযোগ রয়েছে তাদের বিষয়ে বিভাগ, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে তদন্ত করে প্রতিবেদন দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। তদন্ত প্রতিবেদন প্রাপ্তির পর মন্ত্রণালয় যথাযথ নির্দেশনা জারি করবে। তদন্ত প্রতিবেদন আইন ও বিধিবিধান অনুযায়ী নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট শিক্ষকের বেতন-ভাতা চালু থাকবে।’
এ বিষয়ে পদবঞ্চিত শিক্ষকদের মোর্চা প্রধান আনোয়ার ইসলাম তালুকদার গতকাল শনিবার দৈনিক আমাদের বার্তাকে বলেন, দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আমাদের সহকর্মীরা জানিয়েছেন, প্রতিষ্ঠান পরিচালনা কমিটি সভাপতিরা বলছেন, মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনের কপি তারা পাননি। আবার কোনো কোনো সভাপতি বলছেন, অধিদপ্তর থেকে ওই প্রজ্ঞাপন বাস্তবায়নের চিঠি পাননি।
তিনি আরো বলেন, সততা ও নৈতিকতার সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে স্বার্থলোভী কিছু লোকের ব্যক্তিগত আক্রোশের শিকার হয়েছি আমরা। স্বার্থান্বেষীরা এই সংকটময় পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করে, দুষ্কৃতকারীদের সঙ্গে নিয়ে এমন নিষ্ঠুর নির্মম ঘটনা ঘটিয়েছে, যা অস্বাভাবিক, অনাকাঙ্ক্ষিত ও অনভিপ্রেত।
রাজধানীর লেক সার্কাস উচচ বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. মোস্তফা কামাল দৈনিক আমাদের বার্তাকে বলেন, আমার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই, তবু আমাকে যেতে দেওয়া হয় না। আমি যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেছি। সর্বশেষ ঢাকা শিক্ষাবোর্ড থেকে ২৭ জানুয়ারি আমার স্কুলের সভাপতিকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে আমাকে পুনর্বহালের। বোর্ডের চিঠিতে আরো বলা হয়েছে, ‘মোস্তফা কামালকে জোরপূর্বক পদত্যাগ করানো বিধিসম্মত হয়নি।’ কিন্তু দু:খের বিষয়, আমি আজও স্বপদে বসতে পারিনি, বেতনবিহীন কষ্টের মধ্যে আছি।
তিনি আরো বলেন, সারা দেশে এখন পর্যন্ত ২ হাজারের বেশি শিক্ষককে জোরপূর্বক পদত্যাগ করানো হয়েছে। এই অনৈতিক, অন্যায় ও মবজাস্টিসের মতো বর্বরতার কবলে পড়েছি আমরা বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বল্প বেতনে নিয়োজিত শিক্ষকেরা। ফলে কেউ আহত হয়ে হাসপাতালে কাতরাচ্ছেন। কেউ চাকরি হারিয়ে, পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করছেন। কেউবা ঘর-বাড়ি ছেড়ে দূর-দূরান্তে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। এই হয়রানি ও বিপর্যয়কর অবস্থা থেকে আমরা রক্ষা পেতে চাই, নিরাপদে বাঁচতে চাই।
অপর এক সূত্র জানায়, গত ২৭ জানুয়ারি চট্টগ্রাম জেলা শিক্ষা অফিসার উত্তম খীসা সাক্ষরিত এক চিঠিতে চট্টগ্রাম মহানগরী ও উপজেলাসমূহের প্রতিষ্ঠান প্রধান ও সভাপতিদেরকে মন্ত্রণালয়ে পরিপত্র অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।