কোভিড ১৯ এর তাণ্ডব থেকে বিশ্ববাসী প্রাণপণ চেষ্টা করছেন মুক্তি পাওয়ার। অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ছে দ্রুত। কম্যুনিটি ট্রান্সমিশন শুরু হয়ে গেছে। প্রায় সকল জেলা লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে। পরিস্থিতি আরও অবনতির দিকে যাচ্ছে। দীর্ঘ এক মাসেরও বেশি সময় ধরে সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ আছে। সারাদেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বন্ধ থাকার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। এমতাবস্থায় সব ধরণের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষক-কর্মচারীদের দুরবস্থা ও আর্থিক সংকটের কথা তুলে ধরছি।
সবচেয়ে বেশি সংকটে আছেন ননএমপিও শিক্ষক-কর্মচারীরা। সারাদেশে একাডেমিক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত ননএমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে প্রায় দশ হাজার।
এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দুই লক্ষাধিক শিক্ষক-কর্মচারী কর্মরত আছেন। এই শিক্ষক-কর্মচারীদের কেউ কেউ প্রতিষ্ঠান থেকে নামমাত্র বেতন পান। আবার কেউ কেউ আদৌ বেতন পান না। প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ২৭৩০টি প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির জন্য শিক্ষামন্ত্রণালয়ে সাত মাস যাবত প্রক্রিয়াধীন ছিল। এর মধ্যে ১৬৩৩টি প্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্ত সম্পন্ন হয়েছে। তাছাড়া বাকি প্রতিষ্ঠানগুলোর তালিকাও আজ দৈনিক শিক্ষাডটকম পত্রিকায় দেখতে পেলাম। কোড নম্বর দিয়ে এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের এমপিওভুক্ত করার পদক্ষেপ নেয়ার জন্য অধিদপ্তরগুলো নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এগুলো ছাড়াও একাডেমিক স্বীকৃতি ও পাঠদানের অনুমতি প্রদানের প্রক্রিয়াধীন আছে দুই হাজারেরও বেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত শিক্ষক-কর্মচারীরা এখন বেতনের সরকারি অংশ পান না।
মারাত্মক অর্থ সংকটে আছেন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা। অবসরে যাওয়ার পর অনেকেই অর্থকষ্টে হতাশ হয়ে পড়েন। অপ্রিয় হলেও সত্য,অবসরের পর ২-৩ বছর অপেক্ষা করতে হয় টাকার জন্য। অনেকে নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। জীবদ্দশায় টাকা না পেয়েই ওপারে চলে যান। বর্তমান মহাদুর্যোগে মহাসংকটে আছেন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা। এ পর্যন্ত জমা হওয়া সকল আবেদনকারীকে সমুদয় টাকা প্রদান করা জরুরী হয়ে পড়েছে।
দেশের শতকরা ৯৭ ভাগেরও বেশি শিক্ষক-কর্মচারী চাকরি করছেন বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে।এর মধ্যে প্রায় ২৮ হাজার স্কুল, কলেজ, মাদরাসা এমপিওভুক্ত এবং এসব প্রতিষ্ঠানে প্রায় পাঁচ লাখ শিক্ষক-কর্মচারী কর্মরত আছেন। এ সকল শিক্ষক-কর্মচারীরা বেতন-ভাতার একটি অংশ সরকার থেকে পাচ্ছেন। বাকি অংশ প্রতিষ্ঠান থেকে পেয়ে থাকেন। সরকারি অংশ চালু থাকলেও প্রতিষ্ঠানের অংশ ইতিমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। তাছাড়া সরকারি নিয়মানুযায়ী শিক্ষকরা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের অতিরিক্ত ক্লাশ নিতেন এবং বাইরে কোচিং করাতেন তা এখন বন্ধ আছে। শিক্ষক-কর্মচারীরা পারিবারিকভাবে নানা উৎস থেকে অর্থ উপার্জন করতেন তাও হচ্ছে না। এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের শতকরা ৮০ ভাগ এভাবে আর্থিক সমস্যায় আছেন। আবার এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সব শিক্ষক-কর্মচারী এমপিওভুক্ত নন। তারা প্রতিষ্ঠান থেকে বেতন পেয়ে থাকেন। এ বেতন এখন বন্ধ আছে। তাছাড়া প্রতিষ্ঠানের স্বঅর্থায়নে পরিচালিত ইংলিশ ভার্শন স্কুল, ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল, কিন্ডারগার্টেন, এবতেদায়ী মাদরাসা, কওমি মাদরাসা-সহ অনেক প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
আমরা জানি, বিশেষ করে বেসরকারি শিক্ষকরা সবচেয়ে কম বেতনে চাকরি করেন। বেসরকারি শিক্ষকরা বাড়িভাড়া পান এক হাজার টাকা, উৎসব ভাতা ২৫ শতাংশ,চিকিৎসা ভাতা ৫০০ টাকা। তাছাড়া উচ্চতর স্কেল, বদলী, পদোন্নতি-সহ নানা বৈষম্যে জর্জরিত বেসরকারি শিক্ষকরা। শিক্ষকরা লাইনে দাঁড়িয়ে ত্রাণ নিতে পারেন না, টিসিবির ন্যায্যমূল্যের পণ্য কিনতে পারেন না।তারা আর্থিক দৈন্যের মধ্যে থাকলেও মর্যাদায় এগিয়ে আছেন প্রথম সারিতে। দীর্ঘদিন প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলে এবং বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকারি সহায়তা না পেলে শিক্ষকরা মানবিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে পারে। তাই দেশের এমপিওভুক্ত , ননএমপিও, প্রাইভেট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত প্রায় ১০ লক্ষ শিক্ষক-কর্মচারীদের ও অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আর্থিক সহায়তা প্রণোদনা থেকে বা অন্য কোথাও থেকে যতদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে ততদিন বিশেষ অর্থ সহায়তা প্রদানের ব্যবস্থা করা অতীব জরুরী হয়ে পড়েছে।
অনেকে বলে থাকেন, শিক্ষকরা তো বেতন পান। একথা যেমন সত্য, বেতন পান না তাও সত্য। অনেক শিক্ষক আছেন যারা আগে বেতন পেতেন এখন আংশিক পান, অনেকে আগে পেতেন এখন মোটেও পান না, আবার অনেক আছেন আগেও পেতেন না এখনো পান না। এর ব্যাখ্যা আমি ওপরে উল্লেখ করেছি। একজন শিক্ষক নিজের আসহায়ত্বের কথা প্রকাশ করতে পারে না। কারো কাছে হাত পাততে পারেন না। বরঞ্চ শিক্ষক অপরের জন্য নিজের সর্বস্ব বিলিয়ে দিতে পারেন। ইতিমধ্যে অনেক স্বচ্ছল শিক্ষক অসহায়দের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করেছেন।
তাই আমি আবারও বলব, ননএমপিও, এমপিওভুক্ত, প্রাইভেট-সহ সব ধরণের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষক-কর্মচারীদের আর্থিক সহায়তা প্রদান করতে হবে জরুরী ভিত্তিতে। এজন্য শিক্ষা পরিবারের অভিভাবক মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি ও মাননীয় শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নিকট উপস্থাপন করলে সহজে সমাধান হতে পারে।
লেখক : অধ্যক্ষ আবুল বাশার হাওলাদার, সভাপতি, বাংলাদেশ শিক্ষক ইউনিয়ন।