করোনা সংক্রমণের হার ও মৃত্যুর সংখ্যা বাংলাদেশে এখনো অনেকটা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকলেও এর কারণে সৃষ্ট বিভিন্ন সমস্যা দিনে দিনে প্রকট হয়ে উঠছে। এর মধ্যে অন্যতম একটি সমস্যা হলো বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীর শিক্ষা কার্যক্রম। করোনার কারণে গোটা দেশের শিক্ষা কার্যক্রম একপ্রকার স্থবির হয়ে পড়েছে। মঙ্গলবার (৯ জুন) ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।
নিবন্ধে আরও জানা যায়, মার্চের শুরুর দিকে প্রথম করোনা ভাইরাস শনাক্ত হওয়ার পরপরই সংক্রমণের বিস্তার রোধে দেশের সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একই সঙ্গে জরুরি নয় এমন সব ব্যবসা-বাণিজ্য অনলাইনে পরিচালনার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো সীমিত পরিসরে চালু রেখে সরকারি সব অফিস-আদালত খোলার ঘোষণা দিয়েছেন। ২৬ মার্চ থেকে শুরু করে দীর্ঘ দুই মাসের অধিক সময় দেশের সমস্ত অফিস-আদালতে সাধারণ ছুটি পালন করার পর ঈদুল ফিতরের ছুটি শেষে সীমিত পরিসরে খুলেছে অফিস-আদালত। কিন্তু শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যঝুঁকি ও নিরাপত্তা বিবেচনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এখনো ছুটির আওতায়ই রয়ে গেছে। অবস্থার উন্নতি না হলে আগামী সেপ্টেম্বর পর্যন্ত স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকতে পারে বলে ইতিপূর্বে জানিয়েছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। এমতাবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দিয়েছে শিক্ষা কার্যক্রমের স্থবিরতা কাটানো। সেই লক্ষ্যে সরকারি-বেসরকারি বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইনে নিজেদের শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে নেওয়ার প্রয়াস নিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনলাইনে ক্লাস, পরীক্ষা, মূল্যায়ন ও ভর্তি কার্যক্রম পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তাছাড়া চলমান সেমিস্টার শেষ করতে অনলাইনের মাধ্যমে পরীক্ষা, খাতা মূল্যায়ন করার বিষয়টিও অনুমোদন করেছে বিশ্ববিদ্যালয় মুঞ্জরি কমিশন। আপাতদৃষ্টিতে এই প্রয়াসকে অনেকটা সময়োপযোগী ও প্রয়োজনীয়ই বলা যায়। কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তব প্রেক্ষাপট বিবেচনায় অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে বেশ কিছু জোরালো সমস্যা রয়েছে। এসব সমস্যা সমাধানের আগে অনলাইনে পাঠদান ঠিক কতটুকু যৌক্তিক হবে, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে।
সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে দেশে বর্তমানে ১৫০টি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা পড়াশোনা করেন, সেই শিক্ষার্থীদের ৫০-৬০ শতাংশই নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র কৃষক পরিবারের সন্তান। করোনার প্রাদুর্ভাবের শুরুতে সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করায় এদের অধিকাংশই বর্তমানে গ্রামের বাড়িতে অবস্থান করছে। অনলাইনে পাঠগ্রহণ ও শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য যে ধরনের ফিজিক্যাল ফ্যাসিলিটিজ প্রয়োজন, এর সংগতি অধিকাংশেরই নাগালের বাইরে। কম্পিউটার, ল্যাপটপ, স্মার্টফোন ও দ্রুতগতির ইন্টারনেট সেবা আয়ত্তের মধ্যে না থাকায় এদের পক্ষে কোনোভাবেই অনলাইন ক্লাসে যোগ দেওয়া সম্ভব হবে না। কেউ কেউ হয়তো ব্যক্তিগত উদ্যোগে ধারদেনা করে অনলাইন পাঠ সরঞ্জামের বন্দোবস্ত করতে পারবেন, কিন্তু এহেন করোনা পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের ওপর এই বাড়তি চাপ দেওয়া ঠিক হবে কি না, সেটাও ভেবে দেখার বিষয় বৈকি। সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া বহু শিক্ষার্থী টিউশনি করে ও খণ্ডকালীন বিভিন্ন কাজকর্ম করে নিজেদের শিক্ষা খরচের জোগান দেয়, অনেক সময় নিজেদের হাতখরচার টাকা বাঁচিয়ে কিছু পরিমাণ বাড়িতেও দরিদ্র বাবা-মায়ের কাছে পাঠিয়ে থাকে। এমতাবস্থায় অনলাইনে পাঠ গ্রহণের নিমিত্তে বাড়তি খরচের চাপে ফেলে দেওয়া কতটুকু যৌক্তিক হবে সেই প্রশ্ন থেকেই যায়। শহরকেন্দ্রিক বা উচ্চবিত্ত পরিবারের শিক্ষার্থীদের জন্য অনলাইন ক্লাসে কোনো প্রতিবন্ধকতা না থাকলেও বাকি যে ৫০-৬০ শতাংশ শিক্ষার্থী গ্রামে কিংবা বিভিন্ন মফস্সল শহরে অবস্থান করছে, তাদের বাইরে রেখে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে নেওয়া উচিত হবে বলে মনে হয় না।
অনলাইন শিক্ষার কার্যক্রম চালাতে গেলে যেসব উপাদান প্রয়োজন, তার কিছুরই সরবরাহ নেই। অনেক শিক্ষার্থীরই অনলাইন ক্লাস করার মতো ডিভাইস নেই, অনলাইন ক্লাস করতে গেলে যে ইন্টারনেট এক্সেস প্রয়োজন, তা নেই এবং গ্রামাঞ্চলে ইন্টারনেট কানেকশন খুবই দুর্বল। সবচেয়ে বড়ো কথা, এই মহামারির সময়ে অস্তিত্ব টিকিয়ে সুস্থ থাকাই যেখানে বড়ো চ্যালেঞ্জ, সেখানে ইন্টারনেটের ব্যয়বহুল খরচ একজন শিক্ষার্থী জোগাবে কীভাবে? এই সময়ে অনলাইন ক্লাস হয়রানিমূলক বলে মনে করছে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা। কারণ করোনাকালীন সেমিস্টার ফি পরিশোধের বাস্তবতা শিক্ষার্থীদের নেই। তাছাড়া ক্লাসে সরাসরি পাঠদান হতে সম্পূর্ণই আলাদা ভার্চুয়াল বা অনলাইন ক্লাস পদ্ধতি। এই মাধ্যমে যথাযথ মান বজায় রেখে শিক্ষাকার্যক্রম চালিয়ে নেওয়াও বেশ কঠিন। এতদিন ক্লাসরুমে শিক্ষকগণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সরাসরি বা সামনাসামনি পড়াশোনায় যতটা স্বাভাবিক ছিলেন, হঠাত্ অনলাইনের মাধ্যমে শিক্ষাদানে তারা প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছেন। ভার্চুয়াল ক্লাস পরিচালানার জন্য যে কারিগরি দক্ষতা প্রয়োজন, তারও সংকট রয়েছে কোনো কোনো ক্ষেত্রে। বহু শিক্ষকই পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশনে ততটা পারদর্শী নন। শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের আগে তারা বাড়িতে প্রস্তুতি নিয়ে আসতেন। কিন্তু অনলাইন ক্লাসের আগাম কোনো প্রশিক্ষণ ছাড়া আচমকাই শিক্ষক-শিক্ষিকাদের একটা বড়ো অংশ এই পদ্ধতিতে পড়াতে গিয়ে অসুবিধার মুখে পড়ছেন।
অনলাইন বা ভার্চুয়াল ক্লাস পরিচালনার বিষয়ে অতি উত্সাহী দেখা যাচ্ছে দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে। যে কোনো পরিস্থিতিতে তারা টাইম টু টাইম সেমিস্টার শেষ করাতে বেশি মনোযোগী। অথচ পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীদেরও একটি বিরাট অংশ নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে নেওয়ার সামর্থ্য তাদের নেই। অনেকেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে খণ্ডকালীন চাকরি করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সেশন ফি নির্বাহ করে থাকেন। করোনার প্রাদুর্ভাবের কারণে এদের অনেকেই বর্তমানে কর্মহীন দিন কাটাচ্ছেন। এমতাবস্থায় সেমিস্টার চালু রাখলে তাদের পক্ষে ফি পরিশোধ অত্যন্ত দুরূহ হয়ে পড়বে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, এসব মানবিক দিক বিবেচনায় না নিয়েই অধিকাংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীকে সেমিস্টার ফি সময়মতো পরিশোধের জন্য নানা ধরনের চাপ প্রয়োগ করছে। বিভিন্ন ইউনিভার্সিটি সেমিস্টার ফি জমা দেওয়ার যে নির্দেশ দিয়েছে, তা এই করোনার দুর্যোগকালে অনেকটা মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো। অনেকেই বাধ্য হয়ে ফলাফল বিপর্যয়ের আশঙ্কায় টেনেটুনে অনলাইন ক্লাসে অংশগ্রহণ করছেন, কিন্তু যারা করতে পারছেন না, তাদের কী হবে? কিছু শিক্ষার্থীর সামর্থ্য ও অনুকূল পরিবেশ নেই দেখে তাদেরকে বাইরে রেখেই অন্যদের নিয়ে পাঠদান চালিয়ে নেওয়া কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
একদিকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষার্থীদের অনলাইনে পাঠগ্রহণে একপ্রকার বাধ্য করছে; অন্যদিকে শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতাদি নিয়মিত পরিশোধে করছে গড়িমসি। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে প্রথম সারির কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া অধিকাংশই এপ্রিল-মে মাসের বেতন-ভাতাদি ঠিকমতো পরিশোধ করেনি। এমনকি কেউ কেউ করোনার ছুটি শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, সেই মার্চ মাসেই শিক্ষক, কর্মকর্তাদের বেতন আটকে দিয়েছে। ঈদুল ফিতরের বিশেষ বোনাস দিয়েছে, এমন বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা একেবারেই নগণ্য। অথচ দেশের ১০৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাসেবা দান করছেন বিপুল পরিমাণ মেধাবী শিক্ষক, অধ্যাপক। করোনার এই দুর্যোগের সময়ে শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতনভাতা নিয়মিত পরিশোধ না করা ভীষণ অমানবিক ও গর্হিত কাজ! অনতিবিলম্বে সব শিক্ষক-কর্মকর্তার সমুদয় বকেয়া বেতন-ভাতা পরিশোধের আহ্বান জানাই। অন্যথায় সরকারের নির্দেশে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন শিক্ষকদের বেতন-ভাতা নিয়ে গড়িমসি করা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেবে।
করোনার এই সংকট দেশের অর্থনীতিসহ বিভিন্ন খাতকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করছে। শিক্ষা খাতও এর বাইরে নয়। অন্যান্য খাতের মতো শিক্ষা খাতের এই ক্ষতিও স্বীকার করে নিতে হবে এবং দীর্ঘ মেয়াদে কীভাবে এই ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা যায় সেদিকে নজর দিতে হবে। তড়িঘড়ি করে অনলাইনে পাঠদানের নামে শিক্ষার্থীদের বাড়তি ঝামেলায় জড়িয়ে ফেলা উচিত হবে না। তাছাড়া শিক্ষাব্যবস্থার যে ক্ষতি, কেবল অনলাইন ক্লাস করে তা পোষাবে না বলেই মনে হয়। বিজ্ঞান ও গবেষণার ছাত্রদের পড়াশোনার পুরোটাই ল্যাবকেন্দ্রিক। অনলাইনে পাঠদান তাদের তেমন কোনো সুবিধা দিতে পারবে না। সার্বিক বিচারে দেশের বেশিরভাগ শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনলাইনে ক্লাস বা পড়াশোনার মতো সুযোগ-সুবিধা নেই। ডিজিটাল ক্লাসের যে মেথড, অনেক শিক্ষক সেই সম্পর্কেও এখনো অবহিত নন যথাযথভাবে। তবে ঘরবন্দি এই সময়টাতে শিক্ষার্থীরা যেন একাডেমিক পড়াশোনার বাইরে অন্যান্য পড়াশোনা, শিক্ষা, সংস্কৃতি, সাহিত্য, বিশ্বসাহিত্য নিয়ে অধ্যয়ন করে সে বিষয়ে তাদেরকে উদ্বুদ্ধ করা যেতে পারে, যাতে তাদের সময়টা নষ্ট না হয়ে যায়। যারা পড়াশোনা করতে চায়, তারা বাইরের পড়া পড়ুক।
সামগ্রিক বৈশ্বিক চিত্র বিবেচনায় এ কথা স্পষ্ট যে, করোনা পরিস্থিতির দ্রুত উপশমের কোনো পথ নেই। আগামী আরো বেশ কিছুদিন করোনার সঙ্গে যুদ্ধ করেই টিকে থাকতে হবে বিশ্বকে। এই সময় পরিস্থিতি যতটা নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়, ততই মঙ্গল। অর্থনীতিসহ শিক্ষা খাতের ক্ষতি পুষিয়ে ওঠার জন্যও সরকারের চেষ্টার কমতি নেই। শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারক পর্যায়ে যথাযথ বিশ্লেষণ, গবেষণা ও পরামর্শ করে পরবর্তী করণীয় ঠিক করতে দায়িত্বশীলতার সঙ্গে কাজ করছে সরকার। শেখ হাসিনার সরকার করোনার সংকট নিরসন ও নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। প্রত্যাশা করি, দ্রুতই একদিন করোনামুক্ত হয়ে সুস্থ হয়ে উঠবে আমাদের চারপাশ। আবার শিক্ষার্থীদের কলকাকলিতে মুখরিত হয়ে উঠবে পবিত্র শিক্ষাঙ্গন।
লেখক : ড. শরীফ এনামুল কবির, সাবেক উপাচার্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়