বেসরকারি শিক্ষকদের বঞ্চনা নিয়ে বহুদিন থেকে লেখালেখি করি। তাদের বঞ্চনা ও বৈষম্যের কোনো শেষ নেই। লিখতে লিখতে কালি নিঃশেষ হতে চলেছে, তবু এর শেষমাথা খুঁজে পাইনি। একটিমাত্র কাজ 'জাতীয়করণের মধ্যে সব সমাধান নিহিত আছে। সেটি সরকারের উচ্চ মহলে বোঝানোর মতো কোনো শিক্ষক নেতা নেই। কেউ বুঝতে চাচ্ছে না। আবার কেউ বুঝেও না বুঝার ভান করে আছে। ঠিক যেমন ঘুমন্ত মানুষকে জাগিয়ে তোলা গেলেও জাগ্রত মানুষকে জাগিয়ে তোলা একেবারে কঠিন কাজ। যারা শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণ করে দেবেন, তাদের অবস্থা জাগ্রত মানুষের মতো। এর কারণ কী হতে পারে ? আমি সাদাসিধে মানুষ। ঘুরিয়ে পেচিয়ে কিছু বলতে পারিনা। কেউ বললে বুঝতেও পারিনা। নিজে সহজ করে বলতে পছন্দ করি এবং অন্যের সহজ কথা অনায়াসে বুঝতে পারি। এজন্যই বলি, যাদের হাত দিয়ে শিক্ষাব্যবস্থা পর্যায়ক্রমে কিংবা অন্য যেভাবেই হউক জাতীয়করণ হবার কথা, তাদের সন্তানেরা হয়তো বিদেশে লেখাপড়া করে অথবা দেশে থেকে বিদেশি মাধ্যম বা ইংলিশ মিডিয়াম কিংবা বিশেষায়িত কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়ন করে। তাদের টাকা পয়সার অভাব নেই। তাই, এলিট কিংবা আমলা শ্রেণির জাতীয়করণ নিয়ে কোনো মাথা ব্যথা নেই। আবার সব জাতীয়করণ হয়ে গেলে শিক্ষক নেতাদের কাজ থাকবে না নেতৃত্ব থাকবে না সেই চিন্তাও আছে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু, এরা না চাইলে শিক্ষা জাতীয়করণ হবে কী করে? সাধারণ মানুষ যারা এর প্রত্যক্ষ ফলভোগী, তাদের কিছুই করার নেই।
শিক্ষক সমাজ মানে বেসরকারি শিক্ষকদের কথা কী আর বলবো ? তাদের মধ্যে দলাদলির শেষ নেই। তাদের নেতারও অভাব নেই। কিন্তু শতভাগ শিক্ষকের অভাব আছে। কেউ রাজনৈতিক দলের পদে, কেউ অন্য সংস্থায় নিযুক্ত আছেন। কিন্তু সাধারণ শিক্ষকদের মধ্যে কোনো বিভেদ নেই। কেবল গুটি কয়েক নেতার কারণে গোটা শিক্ষক সমাজের দূর্দশার অন্ত নেই। কেবল নিজেদের নেতৃত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য তাদের মধ্যে অর্ধ শতেরও বেশি সংগঠন। আমার মনে হয় কোনোটাই গণতান্ত্রিকভাবে গঠিত নয়। ফেসবুক আর বিবৃতিতের মাধ্যমে গঠিত কমিটির নিজেরােই সভাপতি নিজেরাই সম্পাদক। আবার কেউ কেই অবসরে যাওয়ার আগে নিজ নিজ পুত্র-কন্যাদের সমিতিতে স্থান করে দেন। স্বঘোষিত বা ফেসবুকীয় নেতাদের মধ্যে কেউ গোটা শিক্ষা ব্যবস্থা এক সাথে জাতীয়করণ চান। আবার কেউ দ্বাদশ ও কেউ দশম শ্রেণি পর্যন্ত মাধ্যমিক শিক্ষাস্তর জাতীয়করণ চেয়ে থাকেন। কেউ আবার শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তে শিক্ষক-কর্মচারীদের চাকুরি জাতীয়করণ প্রত্যাশা করে থাকেন। এভাবে তাদের মধ্যে বহুধাবিভক্তির কারণে জাতীয়করণের বিষয়টি সুদুর পরাহত হয়ে পড়ে আছে। কেউ আবার প্রতিষ্ঠান বেসরকারি পর্যায়ে রেখে কেবল চাকুরি সরকারি করার কথা বলে থাকেন। এসব নানাবিধ কারণে অনেক মানুষ জাতীয়করণের বিষয়টিকে নিছক শিক্ষক-কর্মচারীদের একটি স্বার্থের বিষয় বলে মনে করে থাকে। এজন্য বিষয়টি নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে খুব একটা আগ্রহ নেই। প্রকৃতপক্ষে শিক্ষা জাতীয়করণে শিক্ষকদের চেয়ে দেশ ও জাতির বেশি লাভ। এ বিষয়টি আজ বুঝিয়ে বলা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। শিক্ষক সমিতিগুলোর সেভাবেই ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস চালিয়ে যাওয়া উচিত ছিলো। কিন্তু তা না করে নিজ নিজ স্বার্থ হাসিলে ব্যস্ত অধিকাংশই।
বেসরকারি কলেজের শিক্ষকদের স্বতন্ত্র্য কিছু বঞ্চনার বিষয় আছে। এর মধ্যে অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষকের এমপিও না পাবার ব্যাপারটি একান্ত অমানবিক। তাদের এমপিও না দেবার কারণে সেটি আজ জাতীয় লজ্জায় পরিণত হয়েছে। মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হবার গর্বকে এ বিষয়টি একেবারে ভেঙে চুরমার করে দেয়। এটি আমাদের সমষ্টিগত দীনতা ও রাষ্ট্রীয় অক্ষমতা প্রকাশ করে। উপযুক্ত বিধি মেনে তাদের নিয়োগটি হয়ে থাকলে, তাদের বেতন না দেবার বিষয়টি কোনো বিধি বিধানের মধ্যে পড়েনা। অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষকদের নিয়োগে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মহোদয়ের প্রতিনিধি ও মাউশি'র ডিজি মহোদয়ের প্রতিনিধি থেকে থাকলে তাদের বেতন ভাতা প্রাপ্তির বিষয়ে ভাইস চ্যান্সেলর ও ডিজি সাহেব কোনোভাবে দায় এড়িয়ে যেতে পারেন না। দায়িত্ব বাইপাস করার সুযোগ নেই। কাউকে নিয়োগ দিলেই বেতনের বিষয়টি অটোমেটিক চলে আসে। জনবল কাঠামোতে কী আছে না আছে, সেটি বড়ো কথা নয়।
বিধি মোতাবেক নিয়োগ হলেই বেতন দিতে হবে, সে রকম একটি নিয়ম বা আইন থাকা চাই। তা না হলে কাউকে নিয়োগ দিয়ে বেতন না দেয়াটা একটি প্রতারণার মতো হয়ে যায়। এটি এক সময় একেবারে তৃণমুল পর্যায়ে চলে আসবে। অনেকে কাজ করিয়ে শ্রমিকের পারিশ্রমিক দিতে চাইবেনা। ইসলাম ধর্মে ঘাম শুকিয়ে যাবার আগে পারিশ্রমিক মিটিয়ে দেবার স্পষ্ট তাগিদ আছে। অন্য কোনো ধর্মে মজুরি বা পারিশ্রমিক না দেবার কথা নিশ্চয় নেই। কিন্তু কেনো জানি, এই অমানবিক কাজটি আমাদের এখানে শিক্ষকদের সাথে করা হয়। পৃথিবীর কোথাও এরকমটি হয়ে থাকে বলে কোনোদিন শুনি নাই। শিক্ষামন্ত্রণালয়, মাউশি ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় তাহলে বেসরকারি কলেজে অনার্স-মাস্টার্স কোর্স খুলার অনুমতি কেনো দিয়েছিলো ? তারা অনুমতি না দিলেও তো পারতো। তাদের উপর কেউ জোর করেছে বলে শুনি নাই। যখন অনুমতি দিয়েছে, তখন তাদের মানবিক হওয়া উচিত ছিলো।
১৯৯২ থেকে আজ ২০২০ খ্রিষ্টাব্দ চলছে। মাঝখানে পুরো ২৮ বছর। এর মাঝে অনেকবার জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালা আপডেট হয়েছে। একবারের জন্য সামান্য একটু মানবিক হলেই অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষকদের জনবল কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত করা যেতো। আমরা সেটি করি নাই কিংবা করতে পারি নাই। কবি গুরুর ভাষায় বার বার তাই গাইতে ইচ্ছে করে-'বাঙালী করেছো প্রভু, মানুষ করোনি'। আমার সাফ কথা এই, কোথাও যদি কেউ নিজের ইচ্ছায় কর্তৃপক্ষের অনুমতি না নিয়ে অনার্স-মাস্টার্স কোর্স খুলে থাকে কিংবা বিধি বিধান অমান্য করে শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে থাকে, তবে তাদের এমপিও দেবার দায় কারো নেই। কিন্তু অনুমতি নিয়ে যথা নিয়মে শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়ে থাকলে 'এমপিও না দেবার শর্তে' কিংবা 'শতভাগ বেতন ভাতা প্রতিষ্ঠান বহন করবে'- এ জাতীয় খোঁড়া যুক্তি দেখিয়ে এমপিও না দেয়াটি অতি জঘন্য একটি কাজ। এমন অনেক শিক্ষক আছেন, যারা বিনে বেতনে সুদীর্ঘ আটাশ বছর থেকে পরিবার পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। একটিবার তাদের কষ্টের বিষয়টি মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তা করে দেখুন। তাদের বৃদ্ধ বাবা-মা ও অবুঝ সন্তানের ন্যূনতম চাওয়াটুকু কী তারা আজ পূরণ করতে পারছেন ? মান মর্যাদার কথা বাদই দিলাম। পরিবার পরিজন নিয়ে দু' বেলা দু'মুটো ডাল-ভাত অন্তত খেতে না পারলে, তারা শিক্ষা কার্যক্রম কী করে চালিয়ে নেবেন ? ছিঃ ছিঃ ! এটি আমাদের জন্য খুবই লজ্জার একটি বিষয়। এই লজ্জা আমাদের দেশ ও জাতির লজ্জা। এই লজ্জা থেকে আমরা বাঁচতে চাই।
কেউ হয়তো বলবেন অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষকদের মধ্যে বিভেদ আছে। কদিন পর নেতা বদল হয়, ফেসবুকের ঘোষণার মাধ্যমে, লাখ লাখ টাকা চাঁদা তুলে ব্যাংকে ফেলে রেখেছে। সেই টাকার কিছু অংশ নয়ছয়ও হয়েছে। আবার রিট করে আইনজীবীকে ফি না দেয়াও অভিযোগ আছে। কিন্তু দলাদল যতই থাকুক, সব গ্রুপই এমপিওভুক্তি চায়।
এমপিও নীতিমালা ও জনবল কাঠামো সম্ভবত চুড়ান্ত হতে চলেছে। এটি চুড়ান্ত করতে করতে এর প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যাচ্ছে বলে অন্তত আমার কাছে মনে হয়। এতো দীর্ঘসূত্রিতার মানে কী ? বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের সবকিছুতে এ রকম ঢিলেমি ভাব। এটি সত্যি দুঃখজনক। বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের বদলি একটি মানবিক দাবি। এ নিয়ে নীতিমালায় দু' লাইন লিখে দিলে হবেনা।
বদলির বিষয়টি নিয়েও কতিপয় শিক্ষক ফেসবুকে কমিটি ঘোষণা করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের ছবি ব্যবহার করে কথিত টকশো এবং ইউটিউবে প্রতারণা করছে বলে দৈনিক শিক্ষায় প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে। এরপর থেকে বদলি নিয়ে বাণিজ্যে নামা কতিপয় শিক্ষক আর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে যেতে পারেন না, কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলাও বন্ধ হয়ে গেছে।
তবে, দুচারজন শিক্ষকের প্রতারণা ও প্রচারণার সঙ্গে কোনো সাধারণ শিক্ষক নেই। সাধারণ শিক্ষকরা বদলির বিষয়টি সুষ্পষ্ট করার দাবি জানাচ্ছেন। এক হাজার টাকায় কোথাও বাড়ি ভাড়া পাওয়া দূরে থাক, বস্তি ঘরের বারান্দায়ও এক হাজার টাকায় এক মাস একজনের কেবল দাঁড়িয়ে থাকার সুযোগটিও কেউ দেবে না। মাত্র এক হাজার টাকা বাড়ি ভাড়া দিয়ে কী হবে ? যতদিন বদলি চালু করতে না পারেন, ততদিন কম করে দশ হাজার টাকা করে বাড়ি ভাড়া দিন। তা না হলে শিক্ষকতায় মানুষ আসতে চাইবে না। যারা আছেন, তারাও আর থাকতে চাইবেন না। বদলির জন্য একক ও অভিন্ন একটি নিয়োগ কর্তৃপক্ষ তৈরি করা একান্ত প্রয়োজন। সেটি করতে পারলে বদলি কার্যকর করা সহজ হবে। এতে অর্থের বিষয় জড়িত নয়। কেবল একটি আদেশই যথেষ্ট। তাতে হাজার হাজার বদলি প্রত্যাশি শিক্ষক ও তাদের পরিবার পরিজনের মুখে হাসি ফুটে উঠবে।
ইন্টারমিডিয়েট কলেজের প্রভাষকদের জন্য সিনিয়র প্রভাষকের পদ চালু হচ্ছে বলে শোনা যাচ্ছে। এটি আবার কী ? এসব আমার একেবারে বোধগম্য হয়না। কেউ ভালো করে বুঝে থাকলে দয়া করে একটু বুঝিয়ে দিন। কলেজের প্রভাষকদের পদোন্নতির পথ চিরতরে রুদ্ধ করে দেবার এটি আরেক ষড়যন্ত্র। অনুপাত প্রথাকে 'যেই লাউ, সেই কদু'-র মতো শতকরায় নেয়া হচ্ছে। পদোন্নতি ফিফটি ফিফটি করা হচ্ছে। এসব অন্য সকলে মানলেও আমি একদম মানিনা। আমি একটি প্রতিযোগিতামুলক পরীক্ষার মাধ্যমে প্রভাষকদের পদোন্নতির পথ উন্মুক্ত দেখতে চাই। ধাপে ধাপে তারা যাতে নিজের কর্মদক্ষতা ও অভিজ্ঞতার মাধ্যমে অধ্যক্ষ পর্যন্ত যেতে পারেন, সে পথটি খোলা রাখা দরকার।
মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে যে শিক্ষক দশ বছরের অভিজ্ঞতা নিয়ে সহকারি প্রধান শিক্ষক হবেন, তিনি সহকারি প্রধান থেকে তিন বছরের অভিজ্ঞতা নিয়ে প্রধানের পদে যেতে বার বছরের সহকারি শিক্ষকের অভিজ্ঞতা কোথা থেকে অর্জন করবেন ? দশ বছর থেকে বার বছর কী করে হবে ? নাকি দুই বছরের অভিজ্ঞতা ধার কর্জ করা যাবে? ইচ্ছায় নাকি অনিচ্ছায় সেটি হয়েছে, সেটি আমার জানা নেই। এই গ্যাপটি দূর হওয়া দরকার। এমপিও নীতিমালা ও জনবল কাঠামোয় আর যেনো কোনো অসঙ্গতি না থাকে, সেটি আমরা চাই। শিক্ষা ও শিক্ষকের স্বার্থ পরিপন্থি কোনো ধারা যেনো এতে আর কেউ খুঁজে না পায়। ঐতিহাসিক মুজিববর্ষে শিক্ষা ও শিক্ষকের সব বঞ্চনার অবসান হোক। করোনার দুঃসময় অতিক্রম করে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা প্রাণোচ্ছাস নিয়ে অতি শীঘ্র ফিরে আসুক নিজ নিজ বিদ্যাপীঠে। কলকাকলিতে আবার মুখরিত হয়ে উঠুক প্রতিটি শ্রেণিকক্ষ। প্রাণ ফিরে পাক প্রিয় শিক্ষালয়গুলো। সেই কামনায় আজ এখানেই শেষ করি। আসুন, করোনার দ্বিতীয় ঢেউটি সমন্বিত প্রয়াসে সতর্কতার সাথে অতিক্রম করি। পরম করুণাময় সৃষ্টিকর্তা তাঁর অপার রহমত নিয়ে আমাদের সাথী হউন।
লেখক : অধ্যক্ষ মুজম্মিল আলী, চরিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, কানাইঘাট, সিলেট।