অনার্স শিক্ষকদের প্রত্যাশা - দৈনিকশিক্ষা

অনার্স শিক্ষকদের প্রত্যাশা

মনিরুজ্জামান মোড়ল |

আজ ৫ অক্টোবর প্রথমবারের মতো সরকারিভাবে যথাযোগ্য মর্যাদায় উদযাপিত হতে যাচ্ছে বিশ্ব শিক্ষক দিবস। যা এযাবৎকাল আন্তর্জাতিকভাবে শিক্ষকদের অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৯৫ খ্রিষ্টাব্দ থেকে বিশ্ব শিক্ষক দিবস হিসেবে প্রায় একশটির মতো দেশে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে প্রতি বছর ৫ অক্টোবর উদযাপন করে আসছে। প্রতি বছর ইউনেস্কো কর্তৃক একটি প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করে দিবসটি উদযাপিত হয়। দেশে শিক্ষকদের সংগঠন বা ব্যাক্তি উদ্যোগে পালিত হয়ে আসছিলো, যদিও শিক্ষকসহ বিভিন্ন মহলের দাবি ছিল দিবসটি রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে উদযাপনের। অবশেষে সে উদ্যোগের জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যাক্তিদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই।

দেশে ১৯৯৩ খ্রিষ্টাব্দ থেকে গ্রাম তথা প্রত্যন্ত অঞ্চলের দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষা সহজলভ্য ও উৎসাহিত করার লক্ষে বেসরকারি কলেজগুলোতে অনার্স-মাস্টার্স কোর্স জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন লাভ করে এবং পাঠদান চালু করা হয়। সেই থেকে অনার্স-মাস্টার্স কোর্সে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি মোতাবেক শিক্ষক নিয়োগ ও অনুমোদন লাভ করে পাঠদান চলমান রেখেছে। যা কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন কর্তৃক সুপরিশকৃত জাতীয় শিক্ষা নীতি-২০১০ এ উল্লেখ রয়েছে- তিন বছরের ডিগ্রি কোর্স পর্যায়ক্রমে চার বছর মেয়াদি অনার্স কোর্সে রূপান্তর করা হবে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ বিধি এবং বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এর এমপিও নীতিমালা ও জনবল কাঠামো-২০২১ এ নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের এমপিওভুক্ত না হওয়া পর্যন্ত একজন এমপিওভুক্ত শিক্ষকের (প্রভাষক পদের সমমান) ন্যায় বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা প্রদানের নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এই শিক্ষকদের বিধি মোতাকেব বেতন প্রদান না করে বিভিন্ন কলেজে বিভিন্ন পরিমাণ যৎসামান্য ভাতা প্রদান করে থাকে। যেমন, কোনো কলেজে দু’হাজার টাকা, কোনো কলেজে পাঁচ হাজার টাকা, কোনো কলেজে ১০/১৫ হাজার টাকা আবার কোনো কলেজে মোটেও প্রদান করা হয় না। ফলশ্রুতিতে অনেক কলেজের শিক্ষকগণ অর্থকষ্টে বাধ্য হয়ে কলেজ ত্যাগ করে দিনমজুরের কাজ করে সংসার ব্যয় নির্বাহ করছে। এ সমস্ত শিক্ষকদের পরিবারের বৃদ্ধ পিতা-মাতা, স্ত্রী-সন্তান, ছোট ভাই-বোনদের নিয়ে দারুণ অর্থকষ্টে মানবেতর জীবনযাপন করে চলেছে। ছোট ভাইবোন ও সন্তানদের যথাযথভাবে লেখাপড়া ও পুষ্টিকর খাদ্যের ব্যয়ভার গ্রহণে অসমর্থ হয়ে পড়েছে। যা স্মারকলিপির মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রীসহ শিক্ষা বিভাগের বহু কর্তাব্যাক্তিদের নিকট আবেদন নিবেদন জানানো হয়েছে।

দুঃখজনক হলেও সত্য যে, ১৯৯৩ খ্রিষ্টাব্দ (শিক্ষক নিয়োগ) থেকে অদ্যাবধি অর্থাৎ ৩০ বছরকাল একজন শিক্ষককেও এমপিওভূক্ত করা হয়নি। ফলে এসমস্ত শিক্ষকগণ এমপিওর দাবিতে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়সহ শিক্ষা বিভাগের ও সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের লক্ষে শত শত আবেদন, মানববন্ধন, স্মারকলিপি, অনশন, সংবাদ সম্মেলন, র‌্যালিসহ আন্দোলন-সংগ্রাম করা হয়েছে। এছাড়া শিক্ষামন্ত্রী, সংসদ সদস্য, শিক্ষা সচিব, মাউশি মহাপরিচালক, শিক্ষা বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির মেম্বরগণ, বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের সাথে সরাসরি সাক্ষাৎ করে অবগতিসহ  বহু আবেদন-নিবেদন করে আসলেও তার কোনো সুরাহা হয়নি। একটি স্বাধীন দেশে শিক্ষকরা এভাবে বেতন-ভাতাহীন ৩০ বছর যাবৎ পাঠদান করে খাদ্য ও মনোকষ্টে ভুগতে হয়, তা উপলব্ধি করার মতো কেউ নাই বা সমাধানে কেউ এগিয়ে আসছে না ভেবে শিক্ষকরা  হতাশায় নিমজ্জিত রয়েছে। 

সারাদেশে প্রায় ৩শ’টির মতো কলেজে প্রায় পাঁচ হাজার শিক্ষক বিধি মোতাবেক নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে পাঠদানে কর্মরত রয়েছেন। এ সমস্ত শিক্ষকগণ নিয়মিত পাঠদান করা, পরীক্ষা গ্রহণ, অন্তর্বর্তীকালীন ও বোর্ড পরীক্ষার খাতা মূল্যায়ন, দেশের বিভিন্ন নির্বাচনে ভোটগ্রহণ কাজে দায়িত্ব পালন করাসহ নিয়মিত সরকারি নির্দেশনা প্রতিপালন করে আসছে। যেখানে শিক্ষার্থীদের রেজাল্ট সরকারি কলেজের সমপর্যায়ে অবস্থান করছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা কলেজ র‌্যাংকিংয়ে বেসরকারি কলেজ সেরা দশে পাঁচের অধিক কলেজ স্থান দখল করে আছে। সেখানে এ সমস্ত শিক্ষকগণকে যুগের পর যুগ বেতন-ভাতা প্রদান না করে তথা এমপিওভুক্ত না করে তাদের অনাহারে-অর্ধাহারে রেখে রাষ্ট্রের সুনাম কতোটুকু সুমহান রাখা সম্ভব হচ্ছে তা আমার বোধগম্য নয়। এ সমস্ত শিক্ষকদের এই পেশায় থেকে যেখানে দু’বেলা খাদ্য জোগাড়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে, সেখানে পরিবারের স্ত্রী-সন্তান, বৃদ্ধ পিতা-মাতা ও শিক্ষার্থীদের কাছে, এমনকি সমাজের নিকট সামাজিক মূল্যবোধের জায়গায় দাঁড়িয়ে কতোটুকু মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকতে পারবে তার আশঙ্কা রয়েছে।

বর্তমান শিক্ষা নীতিমালা অনুযায়ী একজন অনার্স কোর্সের শিক্ষক এমপিওভুক্ত না হওয়ার কারণে তিনি সিনিয়রিটি পান না। ৩০ বছর যাবৎ চাকরি করলেও কোনো পদোন্নতি তো নাই, এমনকি শর্তানুযায়ী বেতন প্রদান করাও হয় না। যা চুক্তি আইনেরও সুস্পষ্ট লঙ্ঘন বলে মনে করি। দুঃখজনকভাবে এ সমস্ত শিক্ষদের ছাত্ররা কোর্স শেষে এখন একই কলেজে যোগদান করে এমপিওভুক্ত হয়ে সিনিয়র হয়ে যায়। একই ডিপার্টমেন্টে ছাত্রদের অধীনে শিক্ষকদের থাকা লাগে, ছাত্রদের নির্দেশনা অনুযায়ী শিক্ষদের চলতে হয় এবং সে বিভাগের প্রধান হয়ে যায়। এর থেকে অমানবিক ও অমানুষিক যন্ত্রণার আর কি হতে পারে? যা একটি সভ্য সমাজে কোনোদিন মেনে নেয়া সম্ভব নয়্। বিষয়টি দেশের বিভিন্ন শিক্ষাবিদ, সচেতন ও সুশীল সমাজ অবগত হয়ে শিক্ষকদের মূল্যায়ন সম্পর্কে আলোকপাত করতে যেয়ে বিভিন্ন দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার উদাহরণ তুলে ধরে দুঃখ প্রকাশ করেন এবং সরকারের নিকট দ্রুত সমাধানের অনুরোধ রেখেছেন। এটি আমাদের রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক দায়বদ্ধতা উল্লেখপূর্বক তা সমাধান  না হলে  জাতি কোনোদিন মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে না বলে উল্লেখ করেন। 

বর্তমানে বেসরকারি কলেজ পর্যায়ে উচ্চশিক্ষা নিয়ে বেশ কিছু উপর মহলের কর্মকর্তাদের নিরুৎসাহ দেশের জন্য কোনো মঙ্গল বয়ে আনবে কিনা তা নিয়ে শিক্ষাবিদসহ জনসাধারণের মনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। একজন ব্যক্তি উচ্চশিক্ষিত হলে তার যে কোনো কাজে স্বল্প বা অশিক্ষিতি ব্যক্তির তুলনায় সফলতার হার সর্বাধিক হবে এটাই সর্বজনবিদিত। একজন লোক অশিক্ষিত বা স্বল্পশিক্ষিত হলে তার দ্বারা কোনো আধুনিক প্রযুক্তি বা পরিকল্পনা বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়। কিন্তু উচ্চশিক্ষিত হলে তার দ্বারা সহজে উক্ত পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সহজ হয়, সেটি কৃষি কাজ থেকে শুরু করে শিল্প পর্যায় পর্যন্ত যে কোনো কাজে। কারণ তার মানসিক বিশ্লেষণ ক্ষমতা একজন স্বল্পশিক্ষিত বা অশিক্ষিত ব্যক্তির তুলনায় সর্বাধিক থাকে। তাহলে শিক্ষা বিভাগের উচ্চমহল থেকে উচ্চশিক্ষাকে নিরুৎসাহিত করা বা সে কোর্সের শিক্ষকদের বিধি মোতাবেক নিয়োগ দেয়া সত্ত্বেও বেতন-ভাতা/এমপিওভুক্তকরণে গড়িমসি করা কোনো মানবাধিকারের পর্যায়ে পড়ে কিনা তার হাজার প্রশ্ন উত্থাপিত হচ্ছে। আর কোনো কোর্স রাখা হবে কিনা সে প্রশ্নের সাথে শিক্ষকদের সম্পর্কিত করাও কোনো যৌক্তিকতা রয়েছে কিনা তাও আমার বোধগম্য নয়। বেসরকারি কলেজে অনার্স-মাস্টার্স কোর্সে যখন বিধি মোতাবেক শিক্ষক নিয়োগ প্রদান করা হয়েছে, তখন বেতন দিতে হবে- এটিই মানবাধিকার ও কর্তব্য। অন্য অজুহাতে বেতন-ভাতা থেকে যুগের পর যুগ শিক্ষকদের বিরত রাখা চরম মানবাধিকার লংঘন হিসেবে বিবেচিত ।

তাই বিশ্ব শিক্ষক দিবসের মর্যাদা ও প্রতিপাদ্য সমুন্নত রাখতে হলে সর্বাগ্রে শিক্ষকদের আর্থিক দুঃখ-কষ্ট ও মান-মর্যাদা এমনকি মানসিক অবস্থার উন্নয়নসহ তা সুসংহত রাখা অতি জরুরি। তা নাহলে শিক্ষার্থীদের মনেও এর সুদূরপ্রসারী বিরূপ প্রভাব বিস্তার লাভ করবে বলে আমি বিশ্বাস করি।

এ সমস্ত শিক্ষকদের বৃদ্ধ পিতা-মাতা ও স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে সম্মানের সাথে যাতে কলেজে পাঠদান করাসহ সমাজে মাথা উচুঁ করে চলতে পারে তার সুব্যবস্থা করার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রীর নিকট জোর আবেদন রাখছি।

লেখক : মনিরুজ্জামান মোড়ল, প্রভাষক, সভাপতি, বাংলাদেশ বেসরকারি কলেজ অনার্স মাস্টার্স শিক্ষক ফেডারেশন

স্কুল-মাদরাসা বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বন্ধ রাখার নির্দেশ হাইকোর্টের - dainik shiksha স্কুল-মাদরাসা বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বন্ধ রাখার নির্দেশ হাইকোর্টের ঢাকাসহ ১৩ জেলার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কাল বন্ধ - dainik shiksha ঢাকাসহ ১৩ জেলার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কাল বন্ধ প্রাথমিকের তৃতীয় ধাপের মৌখিক পরীক্ষা শুরু ৯ মে - dainik shiksha প্রাথমিকের তৃতীয় ধাপের মৌখিক পরীক্ষা শুরু ৯ মে বেসরকারি শিক্ষকদের বদলি নীতিমালা প্রণয়নের নির্দেশ হাইকোর্টের - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষকদের বদলি নীতিমালা প্রণয়নের নির্দেশ হাইকোর্টের প্রাথমিকের তৃতীয় ধাপে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha প্রাথমিকের তৃতীয় ধাপে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের নতুন নির্দেশনা টেম্পু চাপায় কলেজছাত্রী নিহত - dainik shiksha টেম্পু চাপায় কলেজছাত্রী নিহত কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0090348720550537