শেখ রাসেল সর্বার্থে ছিলেন নিষ্কলুষ, নির্বিবাদ, নির্বিরোধ, নিশ্ছিদ্র, নিষ্কপট, নিষ্কম্প, নিষ্ঠ, নির্ভীক এবং নীলাম্বুর ও নীলোলৎপলসম নিষ্পাপ মানব শিশু । সে যথার্থেই ছিল অপাপবিদ্ধ অমর শিশু । প্রভা বিকীরণ এবং শোভা ছড়ানোর আগেই পাপিষ্ঠ ও ঘৃণ্য এজিদ আর ষড়যন্ত্রের নিকৃষ্টতায় কীর্ণ মীরজাফরদের এদেশিয় নব্য সংস্করণ , জঘন্য, কদর্য-কুৎসিত, নিষ্ঠুর মোস্তাক খুনিচক্রের সম্মুখসারির পর্দাশূন্য চোখের , দয়াহীন-মায়াহীন সাংঘাতিক ঘাতক ঘটিরামদের গুলিতে তার প্রাণবায়ু নিভে যায়। এতে রাসেলের নশ্বর দেহ তিরোহিত হলেও বিপথগামীদের সর্বসিদ্ধি সর্বাংশে সাধিত হয় নি; বরং একযাত্রায় দুই বিপরীতমুখি ফলপ্রাপ্তির মতো হিতে-বিপরীতের প্রতিরূপ হিসেবে রাসেল এখন বাংলা মায়ের দুরন্ত ও দামাল শিশুদের মুখপাত্রে পরিণত হয়েছে । পরিগ্রহ লাভ করেছে অপাপবৃদ্ধ অমর সন্তানরূপে ।অমর ও অমৃতের সন্তানের মতো তার কোন বিলয় ও বিনাশ নেই । তাই এগারো বছরের তার সেই অম্লান-অপূর্ব –অসাধারণ মুখচ্ছবি ঘুরে ঘুরে ফিরে ফিরে পদ্মা -মেঘনা -যমুনার ফল্গুধারা হয়ে বাংলা মাকে অনুক্ষণ আবেশিত করে । ভাই হারানোর বেদনায় বিদীর্ণ করে বোন শেখ হাসিনা ও রেহানাকে ।
আজ থেকে ছাপান্ন বছর আগে আজকের এই দিনে গভীর নিশীথ রাত দেড়টায় ধানমণ্ডির ঐতিহাসিক বত্রিশ নম্বর বাড়ির দোতলার উত্তরপূর্ব দিকের ঘরে দুই ভাই, দুই বোনের উৎসাহ , উৎসুক্য , উৎকণ্ঠা আর দুই ফুফুর স্ফূর্ত উপস্থিতিতে ধরাধামে তার আগমন ঘটেছিল । বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফুটানোর তরে রাজনীতিতে তুমুল ব্যস্ত-সমস্ত প্রায় সংসারবিবাগী তার পিতা তখন স্বৈরাচার আইইয়ুব খানকে থামাতে ফাতেমা জিন্নাহর নির্বাচনী প্রচারকর্মে বারো আওলিয়ার পুণ্যভূমি চট্টগ্রামে । ‘বেশ বড়সড় হয়েছিলে’ সে; মাথাভরা ঘন কালো চুল । তুলতুলে নরম গাল’ তার । দীর্ঘ বিরতির পর তার এই শুভাগমন ‘চার ভাইবোনকে পরম পাওয়ার আহ্লাদে আঁটখানা করেছিল সে নিঃসীম দীঘল রাতে । তার বাবা-মা ছিলেন নোবেল জয়ী দার্শনিক, যুক্তিবিদ ,গণিতজ্ঞ ,ইতিহাসবেত্তা ও সুসাহিত্যক বার্ট্টাণ্ড আর্থার উইলিয়াম রাসেলের পার-ভক্ত । সে সময়ে যুদ্ধাংদেহী মার্কিন-রুশ প্রেসিডেন্টকে শান্তির টেবিলে সমবেত করে বিশ্ববাসীর মনে দারুণ আশা জাগিয়ে ছিলেন তিনি । তাঁর নামের সাথে মিল রেখে পূর্ব পুরুষদের ঐতিহ্য-সমৃদ্ধ পারিবারিক উপাধি শেখ যোগ করে তাঁরা ছেলের নাম রাখলেন শেখ রাসেল । সে ছিল স্বাস্থ্যবান , ‘বেশ নাদুস -নুদুস একটা শিশু’ । মায়া আর মমতায় মন্দ্রীভূত ছিল তার মুখটা । শুধু তার জন্য বত্রিশ নম্বর জনপথ সেদিন থেকে প্রকৃত -প্রফুল্ল মায়াকাননে কল্লোলিত হয়েছিল । পিতা-মাতা,ভাই-বোন ,জ্ঞাতি-স্বজ্ন , প্রিয়জন- পরিজন শুধু নয় ;জাপানের সম্রাট থেকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের এমন কেউই ছিল না ,যে তার অমন মায়ার ভেলায় ভাসেনি ।
রাসেলের সবকিছুতে বাড়ির সবার ছিল অসীম কৌতূহল । তার কান্না-হাসি,হামাগুড়ি দেয়া,হাঁটি হাঁটি পা-পা করে হাঁটতে শেখা, খাওয়া-দাওয়া ,খেলা-ধুলা ,ঘুম-নির্ঘুম ,আলস্য-অধীরতা , ইচ্ছা-অনিচ্ছা ,আগ্রহ-অনাগ্র্হ চাওয়া-পাওয়া,ব্যঞ্জনা-বাসনা ,পোষাক-পরিচ্ছদ , আশা- আকাঙ্ক্ষা, আকুতি-আর্জি-মর্জি সবার উপরে স্থান পেতো ।সে ছিলো সবার মধ্যমণি । ঢেঁড়স ভাজির সাথে চিনি দিয়ে রুটি খেতে বালক রাসেল খুব পছন্দ করত ;আর সারাক্ষণের কর্ম-সহযোগী আম্বিয়া বুয়ার কোলে বসে ঘুরে ঘুরে খাবার খেতে ভারি মজা পেত । কাজের লোকদের সাথে লাল ফুল আঁকা থালায় করে পিঁড়িতে পেতে খাবার খাওয়াতে অমৃতের স্বাদ পেতো সে । পোষা পাখিকে এতো ভালোবাসতো যে, নিজের হাতে পালা কবুতরের মাংস কেউ কোনদিন তাকে ভুলেও খাওয়াতে পারে নি । পোষা কুকুর টমির সাথে সে-কী ভাব ছিল তার !নিজের প্রিয় খাবার দিয়ে টমিকে আপ্যায়িত করতে ভালবাসত সে । অসম বয়সী সহায়ক কর্মী রমা এবং প্রতিবেশি দুই ভাই আদিল ও ইমরানের সাথে খেলতেও অনেক পছন্দ ছিল তার । পিঠাপিঠি বয়সের ভাগ্নে জয়ের সাথে খেলনা নিয়ে খুনসুঁটি করতে দারুণ মজা পেতো সে । তার বন্ধুপ্রিয়তা উপভোগ করার জন্য মুখিয়ে থাকতো টুংগিপাড়ার সমবয়সী বন্ধুকুল । লাঠি-লজেন্স শুধু নয় , তাদের জন্য জামা-কাপড় উপহার দেয়ার তরে মায়ের কাছে আবশ্যিক বায়না থাকতো তার ।তাদের উছ্বাসে ভরা খুশি দেখে দেয়ার আনন্দে আঁটখানা হয়ে যেতো সে । ছোট বোন শেখ রেহানা এক স্মৃতিকথায় লিখেছেন ,’রাসেল বরিশাল ,ফরিদপুর ,ঢাকার আঞ্চলিক ভাষা ও উর্দু মিশিয়ে এক টা নিজস্ব ভাষায় কথা বলত ।ও খুব দুষ্ট ছিল ।পিছন থেকে এসে ভয় দেখাত।তবে ওর হাসিটা খুব মিষ্টি ছিল ।বলা যায়, বাংলা মায়ের আদরের দুলাল ছিল সে ।
তার বেড়ে ওঠার দিনগুলিতে দল ও জনগণের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে নিয়োজিত পিতাকে একদম কাছে পেতো না সে । তাই দিনভর মা,ভাই,বোন,বুয়াদের কাছে থেকে রাতের বেলা কিছুতেই পিতাকে ছাড়তে চাইতো না সে । বাড়িতে মেহমান এলে সর্বর্স্ব বিলিয়ে দিয়ে আপ্যায়ন করতো সে ; এমন কী গৃহশিক্ষককে দারুণভাবে আপ্যায়িত করা হলো কী-না ,সেদিকে কড়া নজর থাকতো তার । বাংলাদেশের জন্য মেঘনাকাঁটা খ্যাত ছয়দফা ঘোষণার পর তার পিতা থাকতো হয় জেলের অন্দরে , নয় বাংলার নানা প্রান্তরে মানুষের দ্বারে দ্বারে জনমত গড়ে তুলতে । সেই ক্রান্তিকালে সারা বাড়ি পিতাকে খুঁজে ফিরতো সে । পিতার অবর্তমানে বেদনায় ভরা ভেজা চোখ দু’টি তার জলে নিমজ্জিত হয়ে থাকতো । পনেরো দিন অন্তর জেলখানায় পিতাকে দেখতে গিয়ে আর আসতে চাইতো না সে । বেশ কষ্ট করেই সেখান থেকে ফিরিয়ে আনতে হতো তাকে । পিতার অবর্তমানে ‘মাকেই আব্বা বলে ডাকতো’ সে । গণ-অভ্যুত্থানের জোয়ারে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা যেদিন ভেসে গেলো , নির্দোষ-মুক্ত মুজিব যেদিন বাড়ি ফিরলো , পুনরায় হারনোর ভয়ে সেদিন থেকে খেলার ফাঁকে ফঁকে বার বার পিতাকে দেখে যেতো সে । একাত্তরের উত্তাল মার্চের অসহযোগের দিনগুলিতে বাসার বারান্দায় দাঁড়িয়ে পুলিশকে ও ‘পুলিশ কাল হরতাল’ বলে তাদের উত্তেজিত করে দারুণ মজা পেতো । রয়ে রয়ে শ্লোগান দিতো- ‘জয় বাংলা’ । মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস পিতা ও ভাইদের জন্য বোবা কান্নায় বিভোর থাকতে দেখা গেছে তাকে । কান্নাভেজা চোখ কেউ দেখলে বা ‘কী হয়েছে জিজ্ঞাস করলে’ সে দৃষ্টি ফেরানোর জন্য বলতো–‘চোখে ময়লা’ । বন্দীদশাতেও নির্ভীকতার সাথে জানালা দিয়ে পাক সেনাদের অস্ত্র-সস্ত্র পরিস্কার করা পরখ করতো , এয়ার রেইড চলাকালে ‘ডগফাইট’ দেখে হাত তালি দিয়ে উল্লাস প্রকাশ করতো । তার সবচেয়ে আনন্দের দিন ছিল ১৯৭১ সালের ১০ জানুয়ারি । সদ্য স্বাধীন -মুক্ত দেশে পিতাকে কাছে পেয়ে সে কী আনন্দ তার ! সেদিন থেকে ‘পিতাকে ছায়ার মতো অনুসরণ করতো’ । পিতাও তাকে দেশ-বিদেশে ‘যেখানে যেখানে নেয়া সম্ভব ,সেখনেই নিয়ে যেতেন’ । আবার সে ‘মাকে ছেড়ে কোথাও থাকতে চাইত না’। বোন রেহানা সাথে থাকার পরও সে বার জাপান সফরকালে মায়ের শূন্যতা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছিল সে । ১৯৭৫ সালের ১৪ এবং ১৭ জুলাই বড় দু’ভাইয়ের বিয়েতে বোন ও জ্ঞাতিদের সাথে ভাইদের পাশাপাশি থেকে অনিঃশেষ আনন্দে মেতে ছিল সে । বিয়ের পর ‘ভাবীদের সাথে ঘুর ঘুর করে’ ঘুরে বেড়াতো সে ।
রাসেলের আলাদা একটা ব্যক্তিত্ব ছিলো । সকল বিষয়ে ভীষণ সাবধানী ছিল সে । নিজের পছন্দের ওপর অগাধ আস্থা ছিল তার । স্বাধীন মত নিয়ে চলতে পছন্দ করতো । আর্মিতে চাকুরি করার অভিপ্রায় অইটুকুন বয়সেই স্থির করেছিল সে । নিজের সামনে বেড়ে ওঠা এবং তার সকল ভাবনার নিত্যসাথী বড় বোন শেখ হাসিনা দৃড়ভাবে বিশাস করতেন, ‘বড় হয়ে সে বিশেষ কেউ একটা হবে তাতে কোন সন্দেহ ছিল না’; কিন্তু ‘১৯৭৫ সালের পনেরো আগস্ট ঘাতকের নির্মম বুলেট কেড়ে নিল ছোট্ট রাসেল কে । মা,বাবা,দুই ভাই ,ভাইদের স্ত্রী ও চাচা সবার লাশের পাশ দিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে সবার শেষে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করল রাসেলকে ।‘কনিষ্ঠ ভাইয়ের অন্তিম প্রয়াণের মর্মন্তুদ বেদনায় লীন হয়ে বড় বোন শেখ হাসিনার আকাশ্চুম্বী আর্তনাদ –‘ওই ছোট্ট বুকটা কী তখন ব্যথায় কষ্টে বেদনায় স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল ! যাদের সান্নিধ্য স্নেহ-আদরে হেসে খেলে বড় হয়েছে , তাদের নিথর দেহগুলো পড়ে থাকতে দেখে ওর মনের কী অবস্থা হয়েছিল ? কী কষ্টই না ও পেয়েছিল ! কেন কেন কেন আমার রাসেল কে এত কষ্ট দিয়ে কেড়ে নিল ? আমি কী কোনদিন এই ‘কেন’র উত্তর পাব ? (ছোট্ট রাসেল সোনা , শেখ হাসিনা)
মূলত প্রভাতের শুভ্র নির্মলতা নিয়ে শিশু রাসেলের নিষ্পাপ জীবনের সূচনা ঘটেছিল । ঘাতকদের নিশীত রাতের কদর্য-কালিমায় তার নশ্বর দেহের প্রাণের লীলা সাঙ্গ হয়েছে বটে ;কিন্তু রাতের পর নতুন সূর্যের আলো যেমন উদ্ভাসিত হয় পুষ্পিত ও স্নিগ্ধ সৌরভ নিয়ে, তেমনি দিনান্তে নিশীতের তারা হয়ে ,অনন্যচিত্ত হয়ে, অবিচল স্নেহভরে রাসেল তার মনোহর মূর্তি আর নিরতিশয় প্রীতিপদ মুখচ্ছবি হয়ে বাংলার ঘরে ঘরে হাজার তারার দীপ হয়ে জ্বলছে । তার কোন মৃত্যু নাই , দিব্যধামে আর অমৃতলোকে তার বসবাস । সে অমর, অপাপবৃদ্ধ অমৃতের সন্তান । বাংলার আকাশ বাতাস আর বাঙালি সংস্কৃতি যতদিন থাকবে , ততদিন ‘আমাদের ছোট্ট রাসেল সোনা’ হয়ে বার বার পুনরুত্থান ও পুনর্জাগরণ ঘটতে থাকবে - আশৈশবের অপাপবিদ্ধ সৌম সৌন্দর্য- শিশুর মূর্ত প্রতীক হয়ে ,মায়া হয়ে ,আশার আলো হয়ে এবং আদর আর ভালোবাসার বিভাবনা হয়ে। কার্যত অমর শিশুর অমলিন অনন্ত আকুলতার আনন্দধামে বাংলাদেশের সব শিশুর স্মারক হয়ে রাসেল চির জাগরূক থাকবে বাংলার মুখচ্ছবি হয়ে ।
সেলিম আকন্দ: অধ্যাপক , গবেষক, প্রাবন্ধিক