আইনের ডিগ্রি ছাড়াই প্রধান বিচারপতি, মিজানুর রহমান খানের লেখা - দৈনিকশিক্ষা

আইনের ডিগ্রি ছাড়াই প্রধান বিচারপতি, মিজানুর রহমান খানের লেখা

মিজানুর রহমান খান |

আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ সাংবাদিক প্রয়াত মিজানুর রহমান খান গুরুত্বপূর্ণ অনেক বিষয়েই লিখেছেন। সংবিধান ও আইন ছাড়াও আমলা ও রাজনীতিবিদদের নিয়েও প্রচুর লিখেছেন তিনি। ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের দুর্লভ অনেক নথির অজানা খবর আমরা জানতে পেরেছি তাঁর অনুসন্ধানী লেখনি থেকে। সমসাময়িক রাজনীতি ও রাজনৈতিক পালাবদল নিয়ে অনেক বিশ্লেষণধর্মী লেখা আছে তাঁর। বাংলাদেশের প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান ও সাবেক রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের কালজয়ী কর্মতৎপরতার বিশ্লেষণও আমরা জানতে পারি তাঁর লেখনী থেকে। ২০০৩ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকটের স্বরূপ’ শীর্ষক গ্রন্থে তিনি ১৯৯১ ও ১৯৯৬ এর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও ক্ষমতার পালাবদলের আলোকে তুলে ধরেছেন আত্মবিশ্লেষণি এক বিচারপতি, তত্ত্বাবধায়ক প্রধান ও রাষ্ট্রপতিকে। সেই লেখার চুম্বক অংশ পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো। 

স্বাগত বিচারপতি সাহাবুদ্দীন 

বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার ঘটনা একটি বিরাট ইতিবাচক ঘটনা। এরশাদের জাতীয় পার্টিকে নিয়ে তথাকথিত ঐকমত্যের সরকার গঠনের পর বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের রাষ্ট্রপতি পদে ফিরে আসাকে সুলক্ষণ বলতে হবে। এই অগ্রগতিকে সাধুবাদ জানাই । স্বাগত রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন। একই সঙ্গে ধন্যবাদ জানাই বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকেও।  

সাবেক প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দের অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে নেতৃত্ব দেন এবং এর মাধ্যমেই তিনি এদেশের সাধারণ মানুষের মনে আস্থা অর্জন করেন। তাঁর একটি নিরপেক্ষ ও পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তি এখনও পর্যন্ত মোটামুটি অটুট। কিন্তু নিশ্চিতভাবেই ১৯৯০ এবং ১৯৯৬-এই দুই পরিস্থিতি ও পরিবেশের মধ্যে আকাশ পাতাল ফারাক।

১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি সরকার প্রধানের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন কার্যরত প্রধান বিচারপতির মর্যাদায়। তখন তাঁর ব্যক্তিত্ব এবং রাষ্ট্রশাসনের অভিজ্ঞতা মুখ্য বিচার্য ছিল না। তিনি একই সঙ্গে দেশের প্রধান বিচারপতি এবং নির্বাহী প্রধানের পদে অধিষ্ঠিত হন। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় তিনি আসেন। এবার আওয়ামীলীগের মনোনয়ন নিয়ে অনেকটা নি:শব্দে তিনি পা রাখলেন জাতীয় রাজনীতিতে বা জাতীয় দায়িত্ব পালনে। প্রেসিডেন্ট হিসেবে তাঁর এই নির্বাচনকে অবশ্য প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ সকল রাজনৈতিক দল ও মহল মুক্তকণ্ঠেই অভিনন্দন জানিয়েছেন। রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর সাহাবুদ্দীন আহমদ যথার্থই বলেছেন, এখন আমি দেশের রাষ্ট্রপতি। কোন দলের নই।

রাষ্ট্রপতি পদে মনোনয়ন নিয়ে আওয়ামী লীগের নীতি-নির্ধারকদের মধ্যে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নানা যোগ-বিয়োগ চলছিল। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন সম্পর্কে অনেক আগে থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তার প্রমাণ ছিল। বঙ্গভবনে শপথ গ্রহণের অনুষ্ঠান শেষে শেখ হাসিনা প্রথম ছুটে যান বত্রিশ নম্বরে এবং সেখান থেকে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের বাসভবনে। সচেতন মহল সেদিনই নিশ্চিত হন। কিন্তু পরে খবর বেরোতে থাকে যে, তিনি রাজি হননি, হবেন না। ছড়িয়ে পড়া এমন ধারণা সামনে রেখেই চোখ রাখা হয় আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতাদের ওপর। এক্ষেত্রে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদ এবং স্থানীয় সরকার মন্ত্রী জিল্লুর রহমানের নাম আলোচনা করা হয় সবচেয়ে বেশি। এর মধ্যে বর্ষীয়ান নেতা সামাদ আজাদ খুব আগ্রহীও ছিলেন। মিজান চৌধুরীর নামও রটে যায়। বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যাপারটি দলের অনেক শীর্ষস্থানীয় নেতার কাছেও দ্ব্যর্থহীন ছিল না। এক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর নজরদারি ছিল নিরঙ্কুশ। রাষ্ট্রপতি হতে অনিচ্ছুক থাকার ব্যাপারে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে জনাব সাহাবুদ্দীন বলেন, ‘সংসদীয় গণতান্ত্রিক সরকারে একজনকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হতে হয়। আর গণতান্ত্রিক ধারা অক্ষুণ্ণ রাখার জন্যেই রাষ্ট্রপতি হতে রাজি হয়েছি’। বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের এই মন্তব্যের সূক্ষ্ম বিশ্লেষণে কিন্তু একটা জাতীয় দৈন্য ফুটে ওঠে। বিচারপতি সাহাবুদ্দীন জাতিকে অনেক দিয়েছেন। কিন্তু নেতৃত্বের এই ঘোর আকালের দিনে, দলীয় দৃষ্টিভঙ্গির ঊর্ধ্বে উঠে প্রধানমন্ত্রী জাতিকে তাঁরই দ্বারস্থ করলেন। তাঁকে বেছে নেয়ার সিদ্ধান্ত যে রাজনীতি বিবর্জিত তা কিন্তু নয়। 

কেউ কেউ বলেছেন, পতিত স্বৈরাচার জেনারেল এরশাদকে নিয়ে ঐকমত্যের সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগের নৈতিক ভাবমূর্তি যেভাবে মলিন হয়ে পড়েছে তা থেকে উদ্ধার পেতে  বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের নিয়োগই যথার্থ। দলীয় যে কোন ব্যক্তিত্বের নিয়োগ হাসিনাকে কোন প্লাস পয়েন্ট দিত না। ১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর নেতৃত্বে অস্থায়ী সরকার গঠনের প্রস্তাব কিন্তু এসেছিল বংলাদেশ আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার তরফ থেকেই। আওয়ামী লীগ অবশ্য এ পদে এ কে খোন্দকারকে দেখতে চেয়েছিল। বিএনপি এবারের নির্বাচনে পরাজয়ের পর বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানকে উদ্দেশ্য করে পক্ষপাতিত্বের যে অভিযোগ উত্থাপন করে ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দে আওয়ামী লীগ তার পরাজয়ের পর বিচারপতি সাহাবুদ্দীনকে কিন্তু সেভাবে আক্রমনের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেনি। অবশ্য দুই বিচারপতির মধ্যে জনাব সাহাবুদ্দীনের ব্যবস্থাপনাকে অধিকতর দক্ষ বলে মনে করা হয়। তবু বহু আলোচিত সূক্ষ কারচুপির যে অভিযোগ সেদিন করা হয়েছিল তাতেও বিচারপতি সাহাবুদ্দীন টার্গেট ছিল না। অনেক স্মরণ করছেন যে, জামায়তের সমর্থনসহ একক গরিষ্ঠতা লাভের পরও ‘৯১ তে বিএনপিকে সরকার গঠনে বেশ ঝামেলা পোহাতে হয়। বিচারপতি সাহাবুদ্দীন মন্তব্য করেছিলেন যে, কে গরিষ্ঠতা পেয়েছে তা আমার কাছে স্পষ্ট নয়। সেদিন মুহূর্তেই ঝড় ওঠে। যে ধরনের ফলাফলের পরিপেক্ষিতে সরকার গঠন নিয়ে সেদিন বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছিল ঠিক সে ধরনের ফলাফল এবার হলেও সে জাতীয় বিতর্কের কিন্তু পুনরাবৃত্তি হয়নি। স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থা থেকে নির্বাচিত সরকারের উওরণের সেই নাজুক সময়ে জনাব সাহাবুদ্দীনের ওই মন্তব্য ‘সুবিবেচনাপ্রসূত’ বলে গণ্য হয়নি।
কোন মানুষই ভুল ত্রুটির ঊর্ধ্বে নন। এবং সময়ের আবর্তনে সে অবশ্যই ভিন্ন ভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আনতে পারে। ব্যক্তির এই স্বাধীনতা উপেক্ষা করার নয়। 

১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দের ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়ায় বিচারপতি সাহাবুদ্দীনকে রাষ্ট্রপতি করার প্রস্তাবে বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ উভয়ই কিন্তু রাজি ছিল। ক্ষমতাসীন বিএনপির কাছ থেকে অনুরোধও যায় তার কাছে। ১৯৯৫-এর ১ জানুয়ারি সংবাদপত্রকে দেয়া সাক্ষৎকারে তিনি নিজেই এই তথ্য প্রকাশ করে বলেছেন, শাসনতন্ত্রের আওতায় রাষ্ট্রপতির কবরস্থানে ফাতেহা পাঠ ছাড়া অন্য কিছুই করার নেই। সাংবাদিকরা তাঁকে এই উক্তি স্মরণ করিয়ে দিলে তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা একই রয়ে গেছে। তবুও একজনকে তো রাষ্ট্রপতি থাকতে হবে।’ একথা যেমন সত্য তেমনি এটাও সত্য যে ত্রয়োদশ সংশোধনী নির্বাচনকালীন নির্দলীয় কেয়ারটেকার সরকার গঠন কালীন সময়ে রাষ্ট্রপতিকে প্রভূত ক্ষমতা প্রদান করেছে। তিন মাসের জন্যে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় চলে যায় রাষ্ট্রপতির অধীনে। এ প্রসঙ্গে তাঁর মন্তব্য: এ নিয়ে চিন্তাই করি নাই। ৫ বছর পর দেখা যাবে। কিন্তু পর্যবেক্ষকরা ধরে নিচ্ছেন যে, রাষ্ট্রপতি হিসেবে সাহাবুদ্দীন আহমদ আগামী সাধারণ নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবেন।

বিচারপতিরা নিরপেক্ষ। তাঁরা আইনের রক্ষক। এই চিন্তা থেকেই এদেশের সাধারণ মানুষ বারংবার বিচারপতিদের স্বাগত জানিয়েছে। কিন্তু এটাও ঠিক যে রাজনীতিকরা মানুষের এই বিশ্বাস ব্ল্যাকমেইল  করতে বিচারপতিদের বর্ম হিসেবে ব্যবহার করতে সচেষ্ট হয়েছেন। পঁচাত্তরের নিষ্ঠুর পটপরিবর্তনের পর প্রধান বিচারপতি আবুসায়েম কে নিয়োগ করা হয়েছিল জনমনে আস্থা সৃষ্টি করতেই। স্বৈরাশাসক এরশাদ বিচারপতিকে টেনে এনেছিলেন ওই একই কারণে। এরশাদ নির্বাচন নামক ইনস্টিটিউশনকে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন বিচারকদের কাঁধে ভর দিয়েই। এটা ঠিক যে প্রত্যেকটির প্রেক্ষাপট পৃথক। কিন্তু দেখা যাবে সবাই নিজ নিজ সংকীর্ণ দলীয় দৃষ্টিভঙ্গী জনগনের কাছ থেকে আড়ালের চেষ্টা করেছে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি পদে প্রথম বিচারপতি হলেন আবু সাইদ চৌধুরী। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবও কিন্তু এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি পদটিকে দলের ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এক পর্যায়ে তাকে ঐ পদ থেকে অপসারণ করা হয়। তারপর রাষ্ট্রপতি পদটি তার গৌরব হারায়।

বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের প্রতি এদেশের মানুষের দরদ ও ভাবাবেগ অতুলনীয়। কিন্তু  বিচারপতি সাহাবুদ্দীন রাজনীতিকদের তো চিনেছিলেন ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দের সাধারণ নির্বাচনের আগেই। ‘৯১-র ১৫ জনুয়ারি তিনি জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে বলেন, ‘নিরপেক্ষতার অর্থ কি? আমর সাড়ে সাঁইত্রিশ বছরের কর্মজীবনে আমার নিরপেক্ষতা নিয়ে কোন প্রশ্ন উঠেনি। কিন্তু অস্থায়ী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ করার সঙ্গে সঙ্গে কেউ কেউ আমার নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। অথচ তাদের বক্তব্য থেকে নিরপেক্ষতার অর্থ স্পষ্ট নয়। কিন্তু আমাদের সরকার সম্পূর্ণভাবে নিরপেক্ষ। 

দেশের একজন শীর্ষস্থানীয় বিচার বিভাগীয় ব্যক্তিত্ব প্রশ্ন রেখেছেন, একজন নিরপেক্ষ ব্যক্তি হিসেবে জনাব সাহাবুদ্দীনের যে ইমেজ এতদিন ছিল, এবার তা ‘বিসর্জন’ দেয়া হলো। তবে কি বিচারপতি হাবিবুর রহমান পরবতী টার্মে দেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হবেন? তাঁর ভাষার, বিচারপতিদের নেতৃত্বে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বিবেচনায় রাখলে মনে হবে, এই দৃষ্টান্তের বিপজ্জনক দিক রয়েছে। ইতিপূর্বে বিচারপতি হাবিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি করার কথা উঠলে একজন কলাম লেখক ‘মর্নিং সান’ পত্রিকায় লিখেছেন, ‘যদি কোন তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধানকে কোনো দলের মনোনয়নে রাষ্ট্রপতি বানানো হয় তবে তা দেশের ভবিষৎ কেয়ারটেকার গঠন এবং তার অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচন আনুষ্ঠান নিয়ে সংশয় বৃদ্ধি পেতে থাকেবে। এই যুক্তিকে খাটো করে দেখার উপায় নেই। যদিও এটা ঠিক যে, রাষ্ট্রপতির নির্বাহী ক্ষমতা প্রয়োগের তেমন সুযোগ নাই।  বিচারপতি সাহাবুদ্দীন সরকার প্রধান হিসাবে বিদায় নিয়েছিলেন। ফিরে এসেছেন রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে।

একজন অফিসার হিসাবে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের উত্তরণ ঘটেছে কর্মময় জীবনে। আইনের ডিগ্রি না থাকা সত্বেও বিচার বিভাগে ,সর্বোপরি প্রধান বিচারপতি হিসাবে তিনি সাবলীল ও দক্ষভূমিকা রেখে গেছেন। জেনারেল এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে যে মামলায় রায়ের কারণে ধস নামে সেটা হল অষ্টম সংশোধনী সংক্রান্ত রায়। অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে হাইকোর্ট খণ্ডিত করে ছয়টি সার্কিট বেঞ্চ গঠন করা হয়। মওদুদ সাহেবের বই থেকে আমরা জেনেছি, জনৈক জেনারেলের বউ তালাকের ঘটনাকে কেন্দ্র করে এরশাদ সুপ্রীম কোর্ট খণ্ডিত করে দেশে ৬টি সার্কিট বেঞ্চের প্রবর্তন করেন। অষ্টম সংশোধনীর রায়ে এরশাদের এই কাজ অবৈধ হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়। জনাব সাহাবুদ্দীন আহমদ এই মামলার অন্যতম বিচারক ছিলেন। বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ এই মামলার রায়ে প্রাক ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দ থেকে শুরু করে ১৯৮৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত পাকিস্তান ও বাংলাদেশর রাজনৈতিক চালচিত্র তুলে ধরেন।

১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দে শাসনতন্ত্র প্রণয়ন সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘এটা মেনে নেয়া হয় তখন যখন পূর্ব পাকিস্তান তার সংখ্যাগরিষ্ঠতার দাবি পরিত্যাগ করে এবং দুই অংশের মধ্যে সকল ক্ষেত্রে ‘সাম্যতা’ মেনে নেয়। কিন্তু এই শাসনতন্ত্রের ‘ফেয়ার ট্রায়াল’ হওয়ার আগেই ১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দে জেনারেল আইয়ুবের নেতৃত্বে সামরিক শাসন আমলে আইয়ুব খান রাষ্ট্রপতি হন এবং একটি নতুন শাসনতন্ত্র দেন। যাতে জনগণের ভোটাধিকার  কেড়ে নেয়া হয় এবং মৌলিক গণতন্ত্রের তত্ত্ব হাজির করা হয়। এই অবস্থায় পাকিস্তান পশ্চিম সামরিক ও বেসামরিক আমলা দ্বারা শাসিত হতে থাকে। এই শাসনতন্ত্রও অবশ্য বেশি দিন টেকেনি । ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দের মার্চে ইয়াহিয়া খান সামরিক শাসনের আওতায় পাকিস্তানের প্রথম ও শেষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের উদ্যোগ নেন। নির্বাচন পরবর্তীকালে নতুন শাসনতন্ত্র প্রণয়ন ছিল লক্ষ্য। নির্বাচনের ফলাফল আওয়ামী লীগের পক্ষে যায় এবং আওয়ামী লীগ ছয় দফা ভিত্তিতে সে শাসনতন্ত্র প্রণয়নে সচেষ্ট হয়। পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক ও বেসামরিক নেতৃবৃন্দ এ ধরনের কোনো শাসনতন্ত্র চাননি। শুরু হয় রাজনৈতিক ডামাডোল। পূর্ব পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দ এবং সরকার যখন রাজনৈতিক সমঝোতায় পৌছাতে চেষ্টা করছিল তখন ইয়াহিয়া খান এবং তার সেনাবাহিনী প্রতারণামূলকভাবে পূর্ব পাকিস্তানের নিরস্ত্র জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং শুরু করে ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যা।

বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের এই রায়ে বাংলাদেশ সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী সম্পর্কে তারা কঠোর সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ পেয়েছে। চতুর্থ সংশোধনী সম্পর্কে তিনি লেখেন: ‘সে পরিবর্তন ছিল এমনই মারাত্মক এবং আকস্মিক যে মিত্ররা হতভম্ব হয়ে পড়ে এবং স্বাধীনতার শত্রুরা খুঁজে পায় প্রতিশোধের পথ। সমালোচকরা উল্লাসের সঙ্গে এই মন্তব্য করেন যে, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা যেন ঘটালেন সামরিক অভ্যুত্থান। এরপর তিনি বলেন ‘সামরিক ফরমান দিয়ে শাসনতন্ত্রকে অন্তত দশবার খারাপভাবে দলিল করা হয়েছে। অন্যতম রাষ্ট্রীয় মৌলনীতি হিসাবে ধর্মনিরপেক্ষতা-সমাজতন্ত্রকে দেয়া হয়েছে তিন অর্থ’। (BCR,1989 Ad 78) উল্লেখ্য যে, বিচারপতি সাহাবুদ্দীন এই বিবরণ দিতে গিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদের পরিবর্তন সম্পর্কে কোন মন্তব্য করেননি।

অধ্যাপক গোলাম আযমের নাগরিকত্ব মামলা সম্পর্কে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন মনে করেন যে, আওয়ামী লীগ সরকারের নেয়া আইনানুগ ব্যবস্থা ত্রুটিপূর্ণ ছিল বলেই আদালতের কিছু করার সুযোগ ছিল না।
যোগাযোগমন্ত্রী এবং জাতীয় পার্টির মহাসচিব আনোয়ার হোসেন মঞ্জু সর্বজনশ্রদ্ধেয় ব্যক্তিকে রাষ্ট্রপতি করায় উদ্বেলচিত্তে গভীর সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। কিন্তু নেতা এরশাদ কি বলবেন। ১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দে কোন পরিস্থিতিতে তাকে কারাগারে ঢোকানো হয় তা জনাব সাহাবুদ্দীন ছাড়া আর কে ভালো জানেন?

১৫ জানুয়ারি ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দে জাতির উদ্দেশে ভাষণে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন বলেন, ‘প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি এক বিবৃতিতে যখন বললেন, তিনি শিগগিরই ক্ষমতায় ফিরে আসছেন তখনই জনগণের রোষাগ্নি আবার জ্বলে উঠল। জাতীয় নিরাপত্তার খাতিরে তাঁকে ক্যান্টনমেন্ট থেকে পুলিশ কাস্টডিতে গুলশানের এক বাড়িতে অন্তরীণ রাখা হল। এদিকে দেশবাসীর রোষ প্রাক্তণ রাষ্ট্রপতি এবং তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে বাড়তে লাগল। ঢাকার প্রধান মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে প্রাক্তণ রাষ্ট্রপতি একজন নিকটতম আত্মীয়সহ ৮ সদস্যের একটি কমিটির সম্মুখে তার ক্যান্টনমেন্টের বাসার মালামাল পরীক্ষা করা হল। উদ্ধারকৃত মালের মধ্যে নগদ টাকা ছিল এক কোটি একানব্বই লাখ আর ৮ টি লাইসেন্সবিহীন আগ্নেয়াস্ত্র। এই অবস্থায় ক্ষুব্ধ জনসাধারণ, ছাত্র এবং রাজনৈতিক দলসমূহ তাঁকে জেলে পাঠানোর জন্য এবং কয়েকদিনের মধ্যে বিচারকার্য সম্পন্ন করে তাঁকে শাস্তি দেয়ার দাবি করে। কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যে তার বিচার সম্পন্ন সম্ভব ছিল না। আমি একজন বিচারক। বিচার হবে আইন অনুযায়ী। আইন সবার বেলায় সমভাবে প্রযোজ্য। আইন চলে এর নিজস্ব গতিতে। 

জেনারেল এরশাদ এখন প্যারোলে মুক্ত। এ দুর্ভাগ্য এবং এ ট্র্যাজেডি কার-সমগ্র জাতির না বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের আমরা তা জানি না। তবে আমরা প্রত্যক্ষ করছি, বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের রাষ্ট্রপ্রধান হিসাবে দায়িত্ব নেয়ার মুহূর্তে ‘আইন সবার বেলায় সমভাবে প্রযোজ্য’ একথা খাটছে না । দুটি দুনীর্তির মামলায় কুড়ি বছরের দণ্ড মাথায় নিয়ে সেই জেনারেল সাংবাদিকদের বলছেন, আই এ্যাম নট এ কনভিকটেড বাট এন আন্ডার ট্রায়াল প্রিজনার। এই মুহূর্তে এরশাদের চেয়ে অনেক কম অপরাধে অথবা বিনা অপরাধে সাজা পেয়ে কারাগারে আছে অসংখ্য নিরীহ মানুষ। এরশাদ এমন আশাও করছেন যে, সে কেন্দ্রীয় কারাগারে একদিন বিচারপতি সাহাবুদ্দীন তাঁকে ঢুকিয়েছিলেন তিনি আর সেখানে ফিরে যাবেন না। এরশাদের মুক্তির প্রশ্নে নবনির্বাচিত রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন বলেন, এটা বিচার বিভাগের হাতে। আর প্যারোলে মুক্তি সরকারের হাতে। প্রেসিডেন্টের ক্ষমা প্রদর্শনের বিষয়টিও হতে হবে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে। আমরা কি তবে এমন দৃশ্য কল্পনা করতে পারি যে, প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে সাবেক প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন এরশাদের মুক্তির পরোয়ানায় সই দিয়ে সংসদীয় গণতন্ত্রের অনুশীলন বিকশিত করবেন? বিচারপতি সাহাবুদ্দীন বলেছেন, সরকারকে উপদেশ দেব। না শুনলে আমার কিছু করার নেই। তিনি অবশ্য এও বলেন যে, ‘মতের মিল না হলে বাড়ি চলে যাব।’

নতুন রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে আমার অভিনন্দন জানাই আবারও। মাননীয় রাষ্ট্রপতি, আপনার মুখ থেকেই জাতি একদা শুনেছে যে, এরশাদের অগণতান্ত্রিক সরকার বিচার বিভাগকে তছনছ করে দিয়েছে (৫ এপ্রিল’ ৯১ সালের সংসদে উদ্বোধনী ভাষণ)। রাষ্ট্রপতি হিসেবে এবার আপনার অবস্থান রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের উর্ধ্বে। আর রাষ্ট্রপতি হিসেবে আপনি দেশের বিচার বিভাগেরও প্রধান। সংবিধানের বইরে আপনি যাবেন না। কিন্তু সংবিধানে দেয়া অন্তর্নিহিত সবটুকু ক্ষমতা জনকল্যাণে প্রয়োগ করবেন-সেই আশা আমরা করছি। ভারতের রাষ্ট্রপতির শাসনতান্ত্রিক অবস্থান আপনার চেয়ে বেশি কিছু উন্নত বা পাকাপোক্ত নয়।  ভারতের রাষ্ট্রপতিরা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অনেক অসঙ্গত সরকারি সিদ্ধান্ত, এমনকি সংসদের পাস করা বিলেও অনুমোদন দিতে অস্বীকৃত জানিয়ে জনগণের প্রশংসা কুড়িয়েছেন। আপনি বলেছেন, বাংলাদেশের সরকার ব্যবস্থা ওয়েস্ট মিনিস্টার মডেল। রানীর মতোই রাষ্ট্রপতির সংবিধানিক মর্যাদা। আর সেই আলোকেই শাসনতন্ত্রবিদরা মনে করেন, নির্বাহী সরকারের সঙ্গে আলোচনা করা, তাকে উৎসাহিত করা, সতর্ক করা এবং প্রয়োজনীয় পরামর্শ প্রদান করা রাষ্ট্রপ্রধানের এখতিয়ার। কবরস্থানে ফাতেহা পাঠের মধ্যে আপনার কার্যক্রম সীমিত থাকুক- এ আমরা চাই না। আমাদের সংবিধানে রাষ্ট্রপতির পরামর্শে মন্ত্রিসভার বিশেষ বৈঠক বসার বিধান রয়েছে। রাষ্ট্রপতি বিশ্বাস এই বিধান প্রয়োগ করেননি। আপনি করবেন। এটাই প্রত্যাশিত। রাষ্ট্রপতি বিশ্বাস রাষ্ট্রপ্রধান হিসাবে বিশ্বের কোনো দেশে রাষ্ট্রীয় সফরে যাননি। আপনি যাবেন। এতে উন্নত গণতান্ত্রিক বিশ্বে বাংলাদেশের মর্যাদা বাড়বে। রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চ্যান্সেলর হিসেবে আমরা আপনাকেই অভিষিক্ত দেখতে চাই।  

স্কুল-কলেজ খুলছে রোববার, ক্লাস চলবে শনিবারও - dainik shiksha স্কুল-কলেজ খুলছে রোববার, ক্লাস চলবে শনিবারও নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল - dainik shiksha ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি - dainik shiksha সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ - dainik shiksha বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি - dainik shiksha সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা - dainik shiksha ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস - dainik shiksha এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0047791004180908