আদর্শ শিক্ষার্থী হয়ে ওঠার ফর্মুলা - দৈনিকশিক্ষা

আদর্শ শিক্ষার্থী হয়ে ওঠার ফর্মুলা

শরীফ উল্যাহ |

স্কুল, কলেজ, মাদরাসা, বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, মেডিক্যাল কলেজ ইত্যাদি বিদ্যাপীঠসমূহের শিক্ষার্থীদেরকে বিভিন্ন শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। তন্মধ্যে এক শ্রেণির শিক্ষার্থীরা সাধারণত তুখোড় মেধাবী হয়ে থাকেন। এরা সবকিছুতেই যেন ওস্তাদ! মাঝে মাঝে এদেরকে ওস্তাদেরও ওস্তাদ মনে হয়! তবে একথা সত্য যে, এদের মধ্যে কিছু শিক্ষার্থী আল্লাহ বা সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত ঐশ্বরিক প্রতিভার অধিকারীও হয়ে থাকেন, যাদের সাথে অন্যদের তুলনা করা নির্বুদ্ধিতা। তবে একথাও অস্বীকার করার সুযোগ নেই যে, শিক্ষক শিক্ষকই এবং ছাত্র ছাত্রই। শিক্ষক আর ছাত্রের বয়স, মেধা ও অভিজ্ঞতায় অনেক পার্থক্য থাকে। যে ছাত্রটি অনেক মেধার অধিকারী এবং অনেক বেশি জানে বলে আমরা মনে করছি, তারও অনেক সীমবদ্ধতা বা ঘাটতি থাকে।

শিক্ষকদের সহায়তায় সে তার সেই সীমাবদ্ধতা বা ঘাটতিগুলো দূর করতে সমর্থ হয়। আবার আরেক শ্রেণির শিক্ষার্থী থাকে যাদেরকে একটু যত্ন নিলে, একটু দিক-নির্দেশনা দিলে তারা ধীরে ধীরে মাঝারি বা সাধারণ মানের শিক্ষার্থী থেকে ভালো শিক্ষার্থী হয়ে ওঠে। এছাড়া কিছু শিক্ষার্থী আছে তাদেরকে এই লাইনে আনাটা অনেক কঠিন। গুটিকয়েক শিক্ষার্থী অতি উদাসীন থাকে। তবে শিক্ষার বিভিন্ন স্তরে শিক্ষার্থীদের এই শ্রেণিবিভাগ সমূহের হার কমবেশি হয়ে থাকে। 

আমার এই আলোচনায় একজন মাঝারি মানের বা সাধারণ শিক্ষার্থী কীভাবে একজন আদর্শ শিক্ষার্থী হয়ে উঠতে পারে তার ওপরই মূলত আলোকপাত করার চেষ্টা করবো। আদর্শ শিক্ষার্থী হওয়ার লক্ষ্যে ঐশ্বরিক প্রতিভার অধিকারী শিক্ষার্থীরা বাদে বাকিরা নিম্নোক্ত বিষয়গুলো মনোযোগ সহকারে উপলব্ধি করবে এবং বাস্তবে রূপ দিবে বলে আমি বিশ্বাস করি।

১। দৈনন্দিন পড়াশুনায় মনোনিবেশ করা:
শিক্ষার যেই স্তরেই একজন শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করুক, তার ক্লাসের একটি পাঠ্যক্রম রয়েছে, তার কিছু নির্ধারিত বিষয় ও বই রয়েছে। সিলেবাস রয়েছে ৷ প্রতিষ্ঠানে ক্লাস নেয়ার সময় শিক্ষক প্রতিটি অধ্যায়ের প্রতিটি পাঠ দৈনিক ভালোভাবে বুঝিয়ে পড়িয়ে দিচ্ছেন। এসময় একজন শিক্ষার্থীকে সর্বোচ্চ মনোযোগী হতে হবে। শিক্ষকের ক্লাস চলাকালেই ভালোভাবে পাঠ বুঝে নিতে হবে। কোনো বিষয় বুঝতে সমস্যা হলে সাথে সাথে দ্বিধা না করে সাহস নিয়ে শিক্ষককে অনুরোধ করতে হবে পুনরায় বুঝিয়ে দেয়ার জন্য। পরবর্তীতে বাসায় তা সুন্দরভাবে পড়া ও অনুশীলনের মাধ্যমে পুরোপুরি আয়ত্তে নিয়ে আসতে হবে। মাঝে মাঝে এবং পরীক্ষার আগে ভালোভাবে রিভাইজ করতে হবে।

২। বাসায় নিয়মমাফিক ও রুটিনমাফিক পড়াশুনা করা:
অনেক শিক্ষার্থী আছে তাদের মেধা যেমনই হোক না কেন তারা বাসায় নিয়মমাফিক বা রুটিনমাফিফ পড়াশুনা করছে না। তারা এখন জোড়াতালি দেয়া পড়াশুনায় অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে। যখন মন চায় পড়তে বসে, যখন মন চায় না পড়তে বসে না।

যে কোনো বিষয় বা পাঠ আয়ত্তে আনার জন্য প্রয়োজনীয় বা পর্যাপ্ত সময় তারা ব্যয় করে না। অন্যদিকে অহেতুক সময় নষ্ট করা, টিভি দেখা, আড্ডা দেয়া, বাসার বাইরে ঘোরাফেরা করা, ফেসবুকিং করা ইত্যাদিতে তারা ব্যাপক সময়ের অপচয় করে থাকে। এতে করে তাদের শিক্ষাজীবন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দিন দিন তারা পিছিয়ে পড়তে থাকে, তাদের দুর্বলতা বাড়তে থাকে এবং পড়াশুনা নিয়ে তাদের ভীতিও বাড়তে থাকে। 

৩। জীবনের লক্ষ্য বা স্বপ্ন ঠিক করে এগিয়ে চলা:
ছাত্রজীবনে লক্ষ্যস্থির করা বা ভবিষ্যতের জন্য সুন্দর স্বপ্ন দেখে সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে কাজ করাটা অত্যন্ত জরুরি। তাই প্রতিটি শিক্ষার্থীর উচিত সে ভবিষ্যতে কী হতে চায় বা ভবিষ্যতে তাকে কোন জায়গায় অথবা কোন অবস্থানে দেখতে চায় তা ঠিক করে সঠিকভাবে এগিয়ে চলা। তবেই একটা সময় সে তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছে যাবে।

৪। অগ্রাধিকার দেয়ার অভ্যাস তৈরি করা:
শিক্ষাজীবনে পড়াশুনার ক্ষেত্রে প্রতিটি বিষয়ই গুরুত্বপূর্ণ। তারপরও একজন শিক্ষার্থীর উচিত— যে কোনো বিষয়ের গুরুত্ব ভালোভাবে বুঝে কখন কোন বিষয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে, কোন বিষয়ে কম গুরুত্ব দিতে হবে সেটি বিবেচনা করে অগ্রাধিকার দেয়ার অভ্যাস গড়ে তোলা। এছাড়া পড়াশুনার সাথে সাংঘর্ষিক এবং দৈনন্দিন ব্যক্তিগত ও পারিবারিক অন্যান্য বিষয়েও অগ্রাধিকার দিয়ে কাজ করতে হবে। 

৫। নতুন কিছু শেখার বা জানার আগ্রহ এবং কৌতূহল থাকা:
শিক্ষাজীবনে নতুন নতুন জিনিস বা নতুন নতুন বিষয় শেখা, জানার আগ্রহ কিংবা কৌতূহল থাকা, আয়ত্তে আনা এবং বাস্তবে তা কাজে লাগানো অত্যন্ত জরুরি। এছাড়া এটি উপভোগ করতে হবে। এতে করে একজন শিক্ষার্থীর জ্ঞানের পরিধি বাড়ে এবং জ্ঞান বাড়ার সাথে সাথে আত্মবিশ্বাসও বাড়ে। 

৬। শিক্ষককে উত্তম বন্ধু বানানো:
একজন শিক্ষার্থীর উচিত একজন শিক্ষককে তার পড়াশুনায় মনোনিবেশ, সুন্দর আচার-ব্যবহার, কাজ-কর্ম, শিক্ষকের দিক-নির্দেশনা মেনে চলা প্রভৃতি ও শিক্ষককে যথাযথ শ্রদ্ধা প্রদর্শনের মাধ্যমে তার কাছে প্রিয় হয়ে ওঠা। তাকে একজন উত্তম বন্ধু বানিয়ে ফেলা। তাহলেই পাঠদান ও পাঠগ্রহণ সহজ ও সুন্দর হয়ে উঠে। এছাড়া এর ফলে শিক্ষক তাঁর বন্ধুসূলভ আচরণের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শিক্ষার বিষয়টি সুসমন্বয় করতে পারে।

৭। অহেতুক আড্ডা বা সময় নষ্ট করা থেকে বিরত থাকা:
একজন শিক্ষার্থীর উচিত— অহেতুক সময় নষ্ট করা, টিভি দেখা, আড্ডা দেয়া, বাসার বাইরে ঘোরাফেরা করা, মোবাইলে দীর্ঘ সময় কথা বলা, ফেসবুকিং করা ইত্যাদিতে সময়ের অপচয় করা থেকে বিরত থাকা। এগুলো শিক্ষাজীবন ধ্বংসে অনেক বেশি দায়ী।

৮। পরিমাণমতো খেলাধুলা ও সুস্থ বিনোদন করা:
একজন শিক্ষার্থী শুধু দিনরাত পড়াশুনা করলেই হবে না। এতে করে তার একঘেয়েমি আসবে, ব্রেইনে অনেক প্রেশার পড়বে এবং তার ক্ষতিও হতে পারে। সেজন্য খেলাধুলার জন্য দিনের সবচেয়ে উপযুক্ত সময়ে যৌক্তিক একটা সময় তাকে কিছু পরিমাণ খেলাধুলা ও সুস্থ বিনোদন করতে হবে। এতে তার ব্রেইন সতেজ হয়ে উঠবে, মন ভালো হবে এবং পড়াশুনায় পুনরায় মনোযোগ স্থাপন করা সহজ হবে।

৯। অন্যকে ছাড়িয়ে যাওয়ার মানসিকতা লালন করা:
একজন শিক্ষার্থী সবসময় নিজ প্রচেষ্টার মাধ্যমে অন্য সহপাঠীদেরকে ছাড়িয়ে যাওয়ার একটা মানসিকতা পোষণ করতে হবে এবং সে লক্ষ্যে করণীয় নির্ধারণ করে কাজ করতে হবে। এছাড়া সবসময় নিজের সামর্থ্যের বিষয়ে আত্মবিশ্বাস রাখতে হবে।

১০। ব্যর্থতা ও ভুল থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা:
একজন শিক্ষার্থী শিক্ষাজীবনে ব্যর্থ হতেই পারেন, ভুল করতেই পারেন। তখন হতাশ, চিন্তিত বা অধৈর্যশীল না হয়ে সেই ব্যর্থতা বা ভুল থেকে তাকে শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে এবং সেই শিক্ষা ভবিষ্যতের জন্য কাজে লাগাতে হবে। তবেই তার উন্নতি অবশ্যম্ভাবী।

১১। নৈতিকতা ও মূল্যবোধ চর্চা করা:
একজন শিক্ষার্থীকে অবশ্যই নৈতিকতা ও মূল্যবোধ চর্চায় অনেক বেশি গুরুত্ব দিতে হবে এবং যত্নশীল হতে হবে। শিক্ষাজীবনে এগুলো অত্যন্ত প্রয়োজনীয় গুণাবলি।  

১২। দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে কষ্ট স্বীকার করা:
আমাদের অনেক শিক্ষার্থী পড়াশুনার ক্ষেত্রে তাদের দুর্বলতাগুলো কাঠিয়ে ওঠার জন্য যে পরিমাণ সময় দেয়া দরকার, যে পরিমাণ কষ্ট বা ত্যাগ স্বীকার করা দরকার, তা করেন না। এবিষয়টি গুরুত্বসহকারে উপলব্ধি করতে হবে এবং বাস্তবে প্রয়োগ করতে হবে। 

১৩। সময়ের কাজ সময়ে করা:
সময়ের কাজ সময়ে না করা অনেক মানুষের একটা মারাত্মক খারাপ অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। কিন্তু এ থেকে আমাদের শিক্ষার্থীদেরকে অবশ্যই মুক্ত থাকতে হবে। তাদেরকে সময়ের কাজ সময়ে করতে হবে। প্রতিদিনের পড়াশুনা প্রতিদিন সম্পন্ন করতে হবে।

১৪। ফেসবুক আসক্তি থেকে বিরত থাকা:
ফেসবুক আসক্তি অত্যন্ত ভয়াবহ অভ্যাস। এই অভ্যাসে অভ্যস্ত হয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের জন্য মোটেও সুখকর নয়। এর থেকে যত বেশি দূরে থাকা যাবে, ততই তাদের জন্য মঙ্গলজনক হবে।

১৫। খারাপ সঙ্গ পরিহার করা:
শিক্ষার্থীদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো খারাপ সঙ্গ পরিহার করা। খারাপ সঙ্গের কারণেই অনেক মেধাবী ছাত্র-ছাত্রী পড়াশুনা থেকে দূরে সরে যায় এবং তাদের শিক্ষাজীবন ধ্বংস হয়ে যায়। 

১৬। নিজের অবস্থা মূল্যায়ন ও করণীয় নির্ধারণ:
একজন শিক্ষার্থীর উচিত সময়ে সময়ে তার প্রকৃত অবস্থা মূল্যায়ন বা আত্মমূল্যায়ন করা এবং করণীয় নির্ধারণ করা। তাহলে প্রত্যাশিত উন্নতি অর্জন সহজ হয়।

প্রসঙ্গক্রমে আমার পরিচিত কয়েকজন শিক্ষার্থীর কথা এখানে উল্লেখ করতে চাই, এক শিক্ষার্থী ক্লাস নাইনের প্রথম সাময়িক পরীক্ষায় ইংরেজি ১ম পত্রে ৩৬ ও ইংরেজি ২য় পত্রে ৩৯ পেয়েছিল। কিন্তু সে তার ভুলগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে চেষ্টা ও পরিশ্রমের মাধ্যমে ২য় সাময়িক পরীক্ষায় ইংরেজি ১ম পত্রে ৭৮ ও ইংরেজি ২য় পত্রে ৭৯ নম্বর পেয়েছিল! পরবর্তী সময়ে সে আর কখনো ইংরেজিতে ৮০ নম্বরের নিচে পায়নি! এসএসসি ও এইচএসসি দুটি পরীক্ষাতেই সে গোল্ডেন এ+ পেয়েছিল। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো একটি সাবজেক্টে ভর্তি হয়ে মাস্টার্স সম্পন্ন করেছে। আরেকজন ছাত্র ক্লাস এইটের জেএসসি পরীক্ষায় মাত্র ৩.০০ জিপিএ পেয়েও নিজের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে পরবর্তীতে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় এ+ পেতে সক্ষম হয়! আরেকজন ছাত্রী এসএসসির টেস্ট পরীক্ষায় খারাপ ফলাফল করার পর মনোযোগসহকারে পড়াশুনা করে এসএসসি পরীক্ষায় গোল্ডেন এ+ ও এইচএসসিতে এ+ পায় এবং মেডিক্যাল কলেজে ভর্তির সুযোগ পায়। সেদিন এক স্কুলের অষ্টম শ্রেণির এক ছাত্রী বলেছিল— এক স্কুলে একটি শ্রেণিতে তার ভর্তি রোল ছিলো ১২৪ এবং সে ছিলো ভর্তিকৃত শেষ শিক্ষার্থী!  

লেখক: উপজেলা নির্বাহী অফিসার, লোহাগাড়া, চট্টগ্রাম।

শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না - dainik shiksha সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু - dainik shiksha চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় - dainik shiksha প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট - dainik shiksha রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0043380260467529