আমাদের স্নেহের ছাত্র মেজর (অব.) সিনহার অস্বাভাবিক মৃত্যুতে আমরা শোকাহত - দৈনিকশিক্ষা

আমাদের স্নেহের ছাত্র মেজর (অব.) সিনহার অস্বাভাবিক মৃত্যুতে আমরা শোকাহত

মাছুম বিল্লাহ |

মুক্তিযোদ্ধার সন্তান মেজর (অব.) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান রাজউক উত্তরা মডেল কলেজে শিক্ষার্থী থাকাকালীন অ্যাসিসট্যান্ট কলেজ প্রিফেক্ট ছিলেন। আমরা তাকে দেখেছি কত উচ্ছল, কত বিনয়ী, কত স্মার্ট এবং খেলাধুলায় সবার আগে থাকা স্মিতহাস্য একজন তরুণ।

সিনহা সমুদ্র ভালবাসতেন, সৈকতে বসে বই পড়ে সময় কাটানো ছিল তার বিনোদন। শৈশব থেকেই অ্যাডভেঞ্চারের ভক্ত ছিলেন সিনহা। সারা বিশ্বে ভ্রমণের এক প্রগাড় সাধ ছিল তার। আর তাই স্বেচ্ছায় সেনাাবাহিনী থেকে অবসর নিয়েছেন। হিমালয় জয় করার স্বপ্ন ছিল তার। হাইকিং পছন্দ করতেন, যেতে চেয়েছিলেন জাপানে একটা সাইকেল ট্যুরে।

২৬ জুলাই ছিল তার জন্মদিন। অনলাইন সার্ভিসের মাধ্যমে তার মা রিসোর্টে কেক পাঠিয়েছিলেন। কোরবানির ঈদে কক্সবাজারে গিয়ে ঈদ করতে বলেছিলেন। কিন্তু অসুস্থতার কারণে মা যেতে পারেননি। সিনহার ঈদ আর করা হলো না। পরপারে পারি জমিয়েছেন দুর্ভাগ্যজনক এক পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে।

সিনহা ৫১ বিএমএ লং কোর্সের সঙ্গে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কমিশন লাভ করেন। ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দে সৈয়দপুর সেনানিবাস থেকে তিনি স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করেন। তিনি প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তায় নিয়োজিত স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্সেও (এসএসএফ) দায়িত্ব পালন করেন। 

সিনহা ছিলেন অবিবাাহিত। তিনি ৩ জুলাই ঢাকা থেকে বক্সবাজারে আসেন ‘জাস্ট গো’ নামে ইউটিউব চ্যানেলের জন্য ট্রাভেল ভিডিও নির্মাণ করতে। সঙ্গে ছিলেন স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া বিভাগের তিনজনসহ মোটা চরাজন। ওঠেন মেরিন ড্রাইভ সড়কের হিমছড়ি ঝরণা এলাকার নীলিমা রিসোর্টে। প্রায় একমাস আগে তারা কক্সবাজার বিভিন্ন স্থানে শুটিং সম্পন্ন করেন।

৩১ জুলাই বিকেলে সঙ্গী সিফাতকে নিয়ে মেজর (অব.) সিনহা কক্সবাজার থেকে টেকনাফের শামলাপুর পাহাড়ে যান। এ সময় সাবেক এই সেনা কর্মকর্তার পরনে ছিল সামরিক পোশাক (কম্ব্যাট টি-শার্ট, কম্ব্যাট ট্রউজার ও ডেজাট বুট)। রাত্রিকালীন শুটিং শেষ করে তাঁরা রাত সাড়ে আটটার দিকে পাহাড় থেকে নেমে আসার সময় স্থানীয় কয়েকজন লোক ডাকাত ডাকাত বলে চিৎকার দেন এবং শামলাপুর পুলিশ ফাঁড়িতে খবর দেন।

পাহাড় থেকে নেমে মেজর (অব.) সিনহা সিফাতকে নিয়ে নিজস্ব প্রাইভেট কারে ওঠেন। রাত ৯টার দিকে তারা পৌঁছান শামলাপুর পুলিশ চেকপোস্টে। সেখানে আগে থেকেই ডাকাত প্রতিরোধে প্রস্তত ছিলেন পুলিশ পরিদর্শক লিয়াকত আলীসহ পুলিশের সদস্যরা। পুলিশের সংকেত পেয়ে মেজর (অব.) সিনহা গাড়ি থামান এবং নিজের পরিচয় দিলে প্রথমে তাঁদের চলে যাওযার সংকেত দেয়া হয়। পরে পরিদর্শক লিয়াকত আলী তাদের পুনরায় থামান এবং তাদের দিকে পিস্তল তাক করে গাড়ি থেকে নামতে বলেন। সিফাত হাত উঁচু করে গাড়ি থেকে নেমে গাড়ির পেছনের দিকে গিয়ে দাঁড়ান। মেজর (অব.) সিনহা গাড়ি থেকে হাত উঁচু করে নামার পরপরই পুলিশ পরিদর্শক লিয়াকত তাকে তিনটি গুলি করেন। গোয়েন্দা সংস্থার গোপন প্রতিবেদনে ঘটনার এভাবে বর্ণনা দেয়া হয়েছে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, গুলি করার পরপরই রাত পৌনে ১০টার থেকে ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন স্থানীয় জনগণ ও একটি গোয়েন্দা সংস্থার মাঠকর্মী সার্জন আইয়ুর আলী। তখনও গুলিবিদ্ধ সেনা কর্মকর্তাকে জীবিত অবস্থায় দেখতে পান তারা। সার্জন আলী ঘটনার ভিডিও রেকর্ড করতে চাইলে পুলিশ তার পরিচয় পাওয়ার পর হাত থেকে মুঠোফোন সেট ও তার পরিচয়পত্র ছিনিয়ে নেয়।

রাত ১০টার দিকে ঘটনাস্থলে আনা হয় একটি মিনিট্রাক। ট্রাকে ওঠানের সময়ও মেজর সিনহা জীবিত ছিলেন এবং নড়াচড়া করছিলেন। এরপর সিনহাকে নিয়ে ট্রাকটি কক্সবাজার সদর হাসপাতালে পৌঁছায় ১ ঘণ্টা ৪৫ মিনিট পর। তখন হাসপাতালের কর্তব্যরত চিকিৎক সিনহাকে মৃত ঘোষণা করেন। হাসাপতাল থেকে ঘটনাস্থলের দূরত্ব ১ ঘণ্টার অথচ অতিরিক্ত ৪৫ মিনিট ব্যয় করা হয় পুলিশের অপকৌশল হিসেবে আর ইচ্ছে করেই ঘটানো হলো এই মর্মান্তিক মৃত্যু!

জাফর নামের স্থানীয় এক জেলে বলেন, ‘গত এক বছরে মেরিন ড্রাইভে আইনশৃংখলা বাহিনীর গুলিতে অন্তত ২০০ লোক মারা গেছেন। কেউ প্রতিবাদ করার সাহস পাননি। এখন সেনাবাহিনীর একজন কর্মকর্তা মারা যাওয়ার পর তোলপাড় চলছে। সাদা পোশাকধারী বিভিন্ন সংস্থার লোকজন এলাকায় এসে ঘটনার তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করছেন। কিন্তু ক্রসফায়ারের আতঙ্কে মানুষ মুখ খুলছেন না।”

২০১৮ খ্রিষ্টাব্দের মে থেকে সারাদেশে মাদকবিরোধী অভিযান শুরু হয়। গত ৩০ জুলাই পর্যন্ত শুধু কক্সবাজার জেলায় পুলিশ, বিজিবি ও র‌্যাবের সঙ্গে একাধিক বন্দুক যুদ্ধের ঘটনায় নিহত হয়েছেন ২৮৭ জন। এর মধ্যে পুলিশের সঙ্গে ১৭৪ জন, বিজিবির সঙ্গে ৬২ জন, র‌্যাবের সঙ্গে ৫১ জন বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন। টেকনাফে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন ১৬১ জন।

৩১ জুলাই রাত ৯টায় টেকনাফ থেকে মেরিন ড্রাইভ সড়ক দিয়ে নিজস্ব প্রাইভেট কারে কক্সবাজারের দিকে যাচ্ছিলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান। সঙ্গে গাড়িতে ছিলেন সিফত নামের আরেকজন।

৮৪ কিলোমিটার দীর্ঘ কক্সবাজার টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কটির পশ্চিম পাশে উত্তাল বঙ্গোপসাগর, আর পূর্ব পাশে উঁচু সবজু গাছপালার পাহাড়সারি। সেনাবাহিনী কর্তৃক নির্মিত দৃষ্টিনন্দন মেরিন ড্রাইভ সড়কটি আগে পর্যটকদের ভ্রমণে উৎকৃষ্ট স্থান হলেও এখন আতঙ্কের এলাকায় পরিণত হয়েছে। এ সড়কে বন্দুকযুদ্ধে মানুষের মৃত্যুর সারি লম্বা হতে থাকায় সন্ধ্যার পর কেউ মেরিন ড্রাইভে উঠতে ভয় পান। সন্ধ্যা থেকে ভোররাত পর্যন্ত সড়কটি ফাঁকাই পড়ে থাকে। জনসাধারণকে, পর্যটকরদের নিরাপত্তা দেয়ার জন্য এই সুন্দর জায়গাটি নিরাপদ করার জন্য পুলিশের কোনো অবদান আমরা দেখতে পাই না, কিন্তু মুত্যুর সারি শুধু বড় হচ্ছে।

মেজর (অব.) সিনহার গাড়টি প্রথমে বিজিবির একটি চেকপোস্টে এসে থামে। পরিচায় পাওয়ার পর বিজিবি সদস্যরা তাদের ছেড়ে দেন। এরপর রাত ৯টার দিকে সিনহার গাড়িটি এসে পৌঁছায় দ্বিতীয় চেকপোস্ট টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর পুলিশ চেকপোস্টে। পুলিশের নির্দেশনা পেয়ে গাড়ি থেকে প্রথমে হাত উঁচু করে নামলেন সিফাত। এরপর নিজের পরিচয় দিয়ে হাত উচুঁ করে গাড়ি থেকে নামলেন মেজর (অব.) সিনহা।

সিফাতের ভাষ্য, কোনোরূপ জিজ্ঞাসাবাদ ছাড়াই সিনহার বুকে একে একে তিনটি গুলি ছোড়েন পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ পরিদর্শক লিয়াকত আলী। মুহূর্তেই তিনি মাটিতে ঢলে পড়েন। সিনহার ব্যক্তিগত পিস্তল থাকলেও সেটি গাড়িতে ছিল। একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনের ওই দিনের ঘটনা সম্পর্কে এমন বর্ণনা দেয়া হয়েছে।  

সিনহা ও সিফাতের বিরুদ্ধে ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলাও করেছে পুলিশ। উদ্ধার দেখানো হয়েছে ৫০ পিস ইয়াবা ও ২৫০ গ্রাম গাঁজা। পত্রিকার পাতায়, ফেসবুকে, টিভি সংবাদে অহরই দেখা যায় দেশের বিভিন্ন স্থানে সাধারণ মানুষকে ফাঁসানোর জন্য, তাদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করার জন্য কত শত প্রচেষ্টা ও মামলা, হয়রানি এবং মৃত্যু পর্যন্ত ঘটানোর ঘটনা। অথচ ইয়াবা, গাঁজা ফেনসিডিলসহ সব ধরনের মাদকের রাজত্বেও দেখি ফেসবুকে, টিভিতে। যারা নিয়ন্ত্রণ করবেন তারা যদি এসব অপকর্ম নিয়ে ব্যস্ত থাকেন তাহলে কীভাবে সম্ভব?

লেখক : মাছুম বিল্লাহ, শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও গবেষক, ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত ভাইস-প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ ইংলিশ ল্যাংগুয়েজ টিচার্স এসোসিয়েশেন (বেল্টা) এবং সাবেক ক্যাডেট কলেজ, রাজউক কলেজ ও উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।

স্কুল-কলেজ, মাদরাসা খুলবে ২৮ এপ্রিল - dainik shiksha স্কুল-কলেজ, মাদরাসা খুলবে ২৮ এপ্রিল সাত দিন বন্ধ ঘোষণা প্রাথমিক বিদ্যালয় - dainik shiksha সাত দিন বন্ধ ঘোষণা প্রাথমিক বিদ্যালয় তীব্র গরমে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসও বন্ধ ঘোষণা - dainik shiksha তীব্র গরমে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসও বন্ধ ঘোষণা প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ - dainik shiksha প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে ছাত্ররাজনীতি লাভজনক পেশায় পরিণত হয়েছে : ড. আইনুন নিশাত - dainik shiksha ছাত্ররাজনীতি লাভজনক পেশায় পরিণত হয়েছে : ড. আইনুন নিশাত কারিগরির সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটির প্রজ্ঞাপন জারি - dainik shiksha কারিগরির সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটির প্রজ্ঞাপন জারি মাদরাসায় ছুটির প্রজ্ঞাপন জারি - dainik shiksha মাদরাসায় ছুটির প্রজ্ঞাপন জারি দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0052018165588379