আমার স্বামীকে হত্যা করা হয়েছে : কুয়েট শিক্ষক সেলিমের স্ত্রী - দৈনিকশিক্ষা

আমার স্বামীকে হত্যা করা হয়েছে : কুয়েট শিক্ষক সেলিমের স্ত্রী

খুলনা প্রতিনিধি |

খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. সেলিম হোসেনের স্ত্রী বলেন, ‘৬ বছরের প্রেম ছিল আমাদের। পারিবারিকভাবে বিয়ে হয়। তারপর কেটে গেছে আরও ১০ বছর। সংসারের কোনো কাজই তাকে বলা লাগত না। সেই মানুষটার এমন মৃত্যু আমি সইতে পারছি না’ 

সেদিন মুখে হাসি নিয়েই কুয়েট ক্যাম্পাসে গিয়েছিলেন খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ সেলিম হোসেন। তবে বাসায় ফিরেছেন ‘বিধ্বস্ত’ হয়ে—এমনটাই জানিয়েছেন তার স্ত্রী সাবিনা খাতুন রিক্তা।

ছবি : সংগৃহীত

শুক্রবার (৩ ডিসেম্বর) তিনি অভিযোগ করে বলেন, “আমার স্বামীকে হত্যা করা হয়েছে। আমি আমার স্বামী হত্যার বিচার চাই। হত্যায় জড়িতদের ফাঁসি চাই। আমার ৬ বছরের মেয়েকে এতিম করল, আমাকে স্বামী হারা করল। আমি আমার মেয়ের সুন্দর ভবিষ্যৎ চাই।”

৩০ নভেম্বরের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে সাবিনা খাতুন রিক্তা বলেন, “গত ৩০ নভেম্বর সকালে আমার স্বামী হাসি মনে কুয়েটে যান। আর বেলা ১টা ৩৫ মিনিটের দিকে বাসায় আসেন। তখন তাকে খুবই বিমর্ষ দেখাচ্ছিল।”

তিনি জানান, বাসায় এসেই অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ সেলিম হোসেন স্ত্রীকে জানান ছাত্ররা তাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার কথা। দায়িত্ব ছেড়ে দেবেন বলেও জানান। এরপর তিনি গোসল করতে বাথরুমে ঢোকেন। কিন্তু বের হতে দেরী হলে তার স্ত্রী দরজায় নকল করেন। কিন্তু কোনো সারা না পেয়ে চিন্তায় পরেন।

সাবিনা খাতুন রিক্তা বলেন, “কোনো সারা না পেয়ে চিন্তা বাড়লে চিল্লাপাল্লা করি। তখন আশপাশের লোকজন ছুটে আসে। এরপর বাথরুমের দরজা ভেঙে তাকে বসা অবস্থায় দেখি। কিন্তু চোখ বন্ধ। মুখ দিয়ে ফ্যানা বের হচ্ছিল। মুখে পানি ছিটা দিলে চোখ খোলেন। কিন্তু কথা বলতে পারেন না। তাকে দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া হয়।”

তিনি বলেন, “৬ বছরের প্রেম ছিল আমাদের। পারিবারিকভাবে বিয়ে হয়। তারপর কেটে গেছে আরও ১০ বছর। সংসারের কোনো কাজই তাকে বলা লাগত না। বাসায় রাতের মশারীও তিনিই টাঙাতেন। বাসায় থাকাকালে কোনো কাজই করতে দিতেন না। চাকরিতে চলে গেলেও বাসার খোঁজ খবর রাখতেন সব সময়। সেই মানুষটার এমন মৃত্যু আমি সইতে পারছি না।”

স্বামী হারানো সাবিনা কান্নায় ভেঙে পড়ে বলেন, “৮ বছর আগে পিএইচডি করতে অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে আমায় সঙ্গে নিয়েই যান। সেখানে ৪ বছর থাকার পর দেশে ফিরে এসে কুয়েটে যোগদান করেন। করোনাভাইরাসের মধ্যে তিনি প্রফেসর হিসেবে পদোন্নতি পান। একই সঙ্গে হলের প্রভোস্ট হন।”

তিনি বলেন, “কুয়েট কর্তৃপক্ষ এ ঘটনা নিয়ে মামলা না করলে আমি নিজেই বাদী হয়ে মামলা করব। আমার স্বামী হত্যার বিচার চাইব। কন্যাকে এতিম করা হয়েছে। জড়িতদের ফাঁসি চাই। ক্ষতিপূরণ চাই।”

কুয়েট শিক্ষক সমিতির সভাপতি প্রতীক চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, “সেলিমের মৃত্যুর পর সাধারণ সভা করে আমরা এ ঘটনায় দ্রুত আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য কুয়েট কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি জানাই। পাশাপাশি শিক্ষক সেলিমের নিয়মিত পাওনা প্রদানের বাইরে ক্ষতিপূরণ হিসেবে অতিরিক্ত ১ কোটি টাকা সেলিমের পরিবারকে প্রদানের দাবি জানিয়েছি।”

শিক্ষক ও ছাত্রদের অভিযোগে জানা গেছে, কুয়েট ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদমান নাহিয়ান সেজান তার লোকজন নিয়ে ৩০ নভেম্বর ড. মোহাম্মদ সেলিমের দাপ্তরিক কক্ষে প্রবেশ করে শিক্ষকের সঙ্গে অশালীন আচরণ ও তাকে মানসিক নির্যাতন করেন। পরবর্তীতে শিক্ষক ড. সেলিম হোসেন দুপুরে খাবারের জন্য ক্যাম্পাস সংলগ্ন বাসায় যান। সেখানে বেলা ৩টায় তিনি ইন্তেকাল করেন।

অভিযোগে বলা হয়, সাধারণ সম্পাদক সেজানসহ উপস্থিত লোকজন তাদের মনোনীত প্রার্থীকে ডাইনিং ম্যানেজার নির্বাচন করার জন্য হল প্রভোস্ট ড. মোহাম্মদ সেলিম হোসেনকে নিয়মিত হুমকি দিয়ে আসছিলেন। তারই ধারাবাহিকতায়, ৩০ নভেম্বর দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে সাদমান নাহিয়ান সেজানের নেতৃত্বাধীন ছাত্ররা ক্যাম্পাসের রাস্তা থেকে ড. মোহাম্মদ সেলিম হোসেনকে জেরা করা শুরু করে। পরবর্তীতে তারা শিক্ষককে ধরে নিয়ে তার ব্যক্তিগত কক্ষে (তড়িৎ প্রকৌশল ভবন) প্রবেশ করেন।

সিসি টিভি ফুটেজে দেখা যায়, তারা আনুমানিক আধা ঘণ্টা ওই শিক্ষকের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন। পরবর্তীতে, শিক্ষক ড. মোহাম্মদ সেলিম হোসেন দুপুরে খাবারের উদ্দেশ্যে ক্যাম্পাস সংলগ্ন বাসায় যান। বেলা ২টার দিকে তার স্ত্রী লক্ষ্য করেন তিনি বাথরুম থেকে বের হচ্ছেন না। পরে তিনি দরজা ভেঙে তাকে উদ্ধার করেন এবং খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেন। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

কুয়েট ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক সাদমান নাহিয়ান সেজান ২ ডিসেম্বর খুলনা প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “কুয়েটের ইইই বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ সেলিম হোসেনের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়। যা রাজনৈতিকভাবে ভিন্ন খাতে প্রভাবিত করে সাধারণ ছাত্র ও ছাত্রলীগের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করা হচ্ছে।”

তিনি প্রকৃত ঘটনা উল্লেখ করে বলেন, “শিক্ষক অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ সেলিম হোসেন গত ১১ মাস আগে কুয়েটের লালন শাহ হলের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। কুয়েটের হলগুলোতে যখনই কোনো নতুন প্রভোস্ট নিয়োগপ্রাপ্ত হন ছাত্রকল্যাণ কমিটির পক্ষ থেকে প্রভোস্টর সঙ্গে হলের ফাইনাল ব্যাচের শিক্ষার্থীদের আনুষ্ঠানিকভাবে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়, যেন হলের বিভিন্ন কর্মসূচী অ্যানুয়াল ফিস্ট ক্রীড়া অনুষ্ঠান, জাতীয় দিবস উদযাপন এবং সার্বিক কর্মকাণ্ড ছাত্র-শিক্ষক সমন্বয়ে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা যায়। সেই কারণবশত, ৩০ নভেম্বর দুপুর ১২টায় প্রভোস্ট নিজ অফিস কক্ষে একটি মিটিং নির্ধারণ করেন। শিক্ষার্থীদের একাডেমিক কার্যক্রম শেষ করে পূর্বনির্ধারিত মিটিং এ যোগ দিতে আনুমানিক ৪০ মিনিট বিলম্ব হয়।”

তিনি আরও বলেন, “ঘটনাক্রমে আমাদের দেরি হওয়ায় পথিমধ্যে স্যারের সঙ্গে দেখা হয়। এ সময় তিনি আমাদের বলেন, ‘এই তোমরা এখন আসছো? আমি তো বের হয়ে আসছি।’ তারপর, আমাদের বিলম্বের কারণ জানালে স্যারই আমাদের তার কক্ষে আসতে বলেন।”

সাদমান নাহিয়ান সেজান বলেন, “ঘন্টা খানেক পর, দুপুর বেলায় স্যারের অসুস্থতার সংবাদ পাওয়া মাত্র হলে থাকা ছাত্ররা সিটি মেডিকেলে যায় এবং সেখানে যেয়ে জানতে পারে তিনি নিজ বাসায় স্ট্রোক করেছিলেন। তখন তাকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় কুয়েট মেডিকেল সেন্টারে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানকার কর্তব্যরত চিকিৎসকরা তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য সিটি মেডিকেলে রেফার করেন। কিন্তু, সিটি মেডিকেলের ডাক্তাররা জানান, পথিমধ্যেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। এরপর, স্যারের মৃতদেহ নিয়ে খুলনা মেডিকেলে গিয়ে মৃত্যু সনদ সংগ্রহ করা হয়, যেখানে মৃত্যুর কারণ হিসেবে স্ট্রোকের কথা উল্লেখ ছিল।”

তিনি বলেন, “অথচ তার এই মৃত্যুকে কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরেই একটি কুচক্রী মহল সাধারণ শিক্ষার্থীদের জড়িয়ে সোশাল মিডিয়াসহ দেশের মেইনস্ট্রিম মিডিয়াগুলোতে যে নেক্কারজনক নোংরা রাজনীতিতে লিপ্ত হয়েছে এবং কোনো ধরনের তথ্যপ্রমাণ ব্যতিরেকে প্রাণপ্রিয় শিক্ষকের মৃত্যুর সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সংশ্লিষ্টতার যোগসূত্র ঘটিয়ে আমাদেরকে যে মানসিক ট্রমার মধ্যে ধাবিত করেছে, তা এক কথায় জঘন্য এবং ঘৃণিত কর্মকাণ্ডের শামিল। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এই কর্মকাণ্ডের প্রতি তীব্র নিন্দা এবং ঘৃণা জ্ঞাপন করছি। একইসঙ্গে তথ্য-প্রমাণ ব্যতিরেকে কাউকে দোষী সাব্যস্ত করে সংবাদ পরিবেশন না করার জন্য সাংবাদিক ভাই-বোনদের প্রতি অনুরোধ জানাচ্ছি।”

স্কুল-কলেজ খুলছে রোববার, ক্লাস চলবে শনিবারও - dainik shiksha স্কুল-কলেজ খুলছে রোববার, ক্লাস চলবে শনিবারও নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল - dainik shiksha ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি - dainik shiksha সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ - dainik shiksha বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি - dainik shiksha সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা - dainik shiksha ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস - dainik shiksha এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0038440227508545