আমরা প্রতিদিন মনের ভাব-আদান প্রদান এবং প্রতিদিনকার যোগাযোগের জন্য সবচেয়ে বেশি পরিমাণে যে দক্ষতা এবং মাধ্যমটি ব্যবহার করি, সেটা হচ্ছে শ্রবণ। আমরা ৪০ শতাংশ যোগাযোগ শ্রবণের মাধ্যমে করি। দ্বিতীয় ম্যধ্যমটি হচ্ছে ‘কথা বলা’বা স্পিকিং। আমরা প্রতিদিনকার যোগাযোগের ৩৫ শতাংশ করে থাকি স্পিকিংয়ের মাধ্যমে। পড়ার মাধ্যম আমরা ১৬ শতাংশ এবং লেখার মাধ্যমে ৯ শতাংশ যোগাযোগ করে থাকি। অতএব দেখা যায়, ভাব-আদান প্রদান ও যোগাযোগের জন্য শ্রবণের ভুমিকা সবচেয়ে বেশি । তারপরই আসে কথা বলা বা স্পিকিং। অথচ আমাদের পুরো পরীক্ষা পদ্ধতি, অ্যাসেসমেন্ট সবকিছুর ক্ষেত্রে ৯ শতাংশ অর্থাৎ শুধু রাইটিং স্কিল নিয়ে ব্যস্ত । এই ৯ শতাংশ ও রিডিং স্কিল ১৬ শতাংশ অর্থাৎ ২৫ শতাংশের ওপর নির্ভর করে পাবলিক পরীক্ষায় গ্রেডিং অর্থাৎ একজন শিক্ষার্থীর মেধা যাচাই সবকিছুই নির্ভর করছে ২৫শতাংশ স্কিলের ওপর। আমরা শিক্ষার্থীদের বলে দিচ্ছি তুমি ইংরেজিতে এ প্লাস পেয়েছো অর্থাৎ ইংরেজিতে তুমি মাস্টার। যেখানে লিসেনিং ৪০ শতাংশ, স্পিকিং ৩৫ শতাংশ অর্থাৎ ৭৫ শতাংশ আমরা পড়ানো বা মান যাচাইয়ের ক্ষেত্রে টাচই করছি না, সেখানে কীভাবে আমরা শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করছি? বিষয়টি গভীরভাবে ভেবে দেখতে হবে। শ্রবণ অর্থাৎ লিসেনিং আমরা কেন বেশি করি?
১. আমরা সব সময় কথা বলার সুযোগ পাই না
২. সব সময় কথা বলিনা বা লেখারও সুযোগ পাই না
৩. আবার আমরা যখন পড়ি তখন শ্রবণও করি, তাতে সাড়াও দেই
৪. আমরা যখন লিখি তখনও শ্রবণ করি
৫. আমরা চুপচাপ থাকলেও শ্রবণ করি
৬. অর্ধজাগ্রত থাকলেও আমরা শ্রবণ করি
দ্বিতীয়টি হচ্ছে স্পিকিং। কোনো পরিচিত কিংবা অপরিচিত যে কারো সাথেই হোক, কথা বলে আমরা ভাব বিনিময় করি। ভাল কথা বলে অন্যের দৃষ্টি করতে চাই। কিন্তু আমাদের পরীক্ষা পদ্ধতিতে বা ইংরেজি পড়ানোর ক্ষেত্রে এই স্কিলটি একবারেই অবহেলিত। শিক্ষক নিজেও প্র্যাকটিস করেন না, শিক্ষার্থীদেরও করান না।এই স্কিলটি প্র্যাকটিস না করা এবং না করোনোর কারণ :
১. পরীক্ষা পদ্ধতিতে লিসেনিং বা স্পিকিং নেই
২. শিক্ষার্থীরা স্পিকিং বা লিসেনিংয়ের জন্য কোনো ধরনের চাপের মধ্যে থাকে না, আবার কোনো উৎসাহব্যঞ্জক অবস্থা বা পরিবেশও দেখে না যে, ইংরেজিতে কথা বললে তাকে পুরস্কৃত করা হবে। কোনো শিক্ষক কোনো প্রতিষ্ঠান বা কোনো প্রশাসক শিক্ষাথীীদের বলছেন না, ‘তোমাদের এই ক্লাসে অবশ্যই ইংরেজিতে কথা বলতে হবে।’ কিংবা কেউ বলছেন না, ‘তোমাদের অজস্র ধন্যবাদ ইংরেজিতে কথা বলার জন্য।’
৩. ইংরেজিতে কথা বলতে শিক্ষকরাও লজ্জা পান, শিক্ষার্থীরাও লজ্জা পায়।
৪. পুরো পদ্ধতি ক্লাসের নীরবতাকে মূল্যায়ন করে সফল ক্লাস হিসেবে। তাই সবাই ইংরেজি ক্লাসেও নীরব থাকে। স্কুল প্রশাসন নীরবতাকে চমৎকার ক্লাস বলে আখ্যায়িত করেন। তাই কিছু আধুনিক/যুবক/প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক যদিও ইংরেজিতে কথা বলা এবং শিক্ষাথীদের বলানোর চেষ্ট করেন, প্রশাসনিক ও সহকর্মীদের সমালোচনার কারণে তারা আবার নীরবতা পালন করেন এবং বাংলাতেই চলে আসেন। অনেকেই মনে করেন, নীরব ক্লাসই সার্থক ক্লাস, যে ক্লাসে শিক্ষার্থীরা কথা বলে না, চুপচাপ থাকে, প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে না সেটিই হচ্ছে সার্থক ক্লাস।
৫. আর একটি কারণ হচ্ছে, ইংরেজিতে ক্লাস পরিচালনা করার জন্য একজন শিক্ষকের যে লেভেলে স্পিকিং দক্ষতা থাকার কথা, অনেক শিক্ষকদেরই তা নেই । কারণ তিনিও তো এই পরিবেশ বা এই অবস্থার মধ্যেই ইংরেজি শিখেছেন। তবে শিক্ষার্থীদের প্র্যাকটিস করালে নিজেরও অনেক উন্নতি হবে, এ বিষয়টি যারা বোঝেন তারা এতসব বাধা সত্ত্বেও ক্লাসে শিক্ষার্থীদের ইংরেজি প্র্যাকটিস করান। তাতে শিক্ষার্থীদেরও উপকার হয়, শিক্ষকের নিজেদের দক্ষতাও বৃদ্ধি পায়।
এসব কারণে ৪০ শতাংশ লিসেনিং, ৩৫ শতাংশ স্পিকিং হওয়া সত্ত্বেও ১৬ শতাংশ রিডিং এবং ৯ শতাংশ রাইটিং অর্থাৎ ২৫ শতাংশ নিয়েই পুরো পরীক্ষা পদ্ধতি, ব্যক্তি, সমাজ, প্রতিষ্ঠান এবং জাতীয় পর্যায়ের সংশ্লিষ্ট সবাই ব্যস্ত। আমাদের সকল কর্মকাণ্ড, পরীক্ষা, পড়াশোনা, মানযাচাই, ভাষা জানার মানদণ্ড এবং ফলাফল সব কিছুই এই ২৫ শতাংশকে ঘিরে। ফলে যেসব গ্রাজুয়েট আমাদের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হন, তারা স্পিকিংয়ে দুর্বল থাকেন।
রাষ্ট্র কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ের আগে আমরা ব্যক্তি পর্যায়ে এ অবস্থার পরিবর্তন কি শুরু করতে পারি না? অর্থাৎ সর্বোচ্চ ব্যবহৃত স্কিল লিসেনিং উন্নত করার জন্য আমরা কিছু একটা কি করতে পারি না?
শিক্ষার্থীদের লিসেনিং উন্নত করার জন্য সব সময়ই আমরা রেডিও টেলিভিশনে সংবাদ দেখার, ইংরেজি মুভি দেখার, বিবিসি, সিএনএন দেখা ও শোনার উপদেশ দিয়ে থাকি। শহর এলাকায় এবং কিছু কিছু গ্রাম এলাকায়ও ছাত্র-ছাত্রীরা বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে উপভোগ করে থাকে, তাদের লিসেনিং এবং স্পিকিং কিছুটা উন্নতও। তাদের রিসিপটিভ ক্যাপাসিটিও উন্নত। কিন্তু পাঠ্যবই, পরীক্ষা পদ্ধতি ও ফলাফলের সাথে এগুলো মেলাতে চায়। পরীক্ষা পদ্ধতিতে এগুলো নেই, দেখানোর কোনো ব্যবস্থাও নেই। তাহলে তারা কেন এটি প্র্যাকটিস করবে? এখানেই শিক্ষক হিসেবে আপনার দায়িত্ব। আপনি একদিকে শিক্ষার্থীদের লিসেনিং এবং স্পিকিং দক্ষতা বাড়াবেন, সাথে সাথে তাদের সিলেবাসও প্র্যাকটিস করাবেন। কীভাবে এটি করাবেন?
পাঠ্য বই থেকে ভাল ভাল প্যাসেজগুলো আপনি সুন্দর করে ভাল উচ্চারণসহ পড়ে প্রস্ততি নেবেন। ক্লাসে সেগুলো শিক্ষার্থীদের শোনাবেন। কয়েকটি ফোকাস প্রশ্ন বোর্ডে লিখবেন, যাতে শ্রবণ করার সময় তারা ওই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোাঁজে, আরও বেশি বোঝার চেষ্টা করে। এতে ক্লাস এক ধরনের আকর্ষণীয় হবে, একঘেয়েমি কাটবে, উন্নত হবে আপনার ডেলিভারি ক্ষমতা, শিক্ষার্থীদের শ্রবণ শক্তি উন্নত হবে, ক্লাস অ্যাকটিভ হবে আর তার সাথে শেষ হবে বিদ্যালয়ের নির্ধারিত সিলেবাসও।
সিলেবাসের পড়া শুধু লিখতে না দিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিন, তাদের উত্তর দিতে উদ্ধুদ্ধ করুন, না পারলে ইংরেজিতে বলে দিন। আপনার বলার দক্ষতা বাড়বে, ছাত্র-ছাত্রীরাও মজা পাবে, তাদের মুখস্থ করার প্রবণতা কমবে কারণ তারা ক্লাসে বার বার নিজেদের মধ্যে আলোচনা করার ফলে পাঠ্য বইয়ের ব্যাপারগুলো তাদের আয়ত্তে চলে আসবে। রিডিং স্কিল উন্নত করার জন্য পাঠ্যবইয়ের সাথে সাথে ইংরেজিতে আকর্ষণীয় আর্টিকেল বাছাই করে নিজে পড়ুন, ক্লাসে সেখান থেকে গ্রামারের বিভিন্ন আইটেম শেখান। দেখবেন তাদের আগ্রহ ক্লাসের প্রতি আরও বেড়ে যাবে। লেখার ক্ষেত্রেও ক্রিয়েটিভ পদ্ধতি ব্যবহার করুন। তাদের সম্মিলিত ধারণা একত্র করুন, সেই ধারণাগুলোকে ভাষা দেয়ার জন্য তাদের উৎসাহিত করুন।
আধূনিক যুগ সুষ্ঠু কমিউনিকেশনের যুগ। এ কমিউনিকেশন হচ্ছে ভাষাগত যোগাযোগ। ইংরেজির চারটি দক্ষতার মধ্যে ম্পোকেন ইংরেজি অন্যতম একটি দক্ষতা। যে কোনো অফিস, বেসরকারি সংস্থা এনজিওতে চাকরি পাওয়ার জন্য স্পোকেন ইংরেজি একটি গুরুত্নপুর্ণ শর্ত হিসেবে বিবেচিত হয। আসলেই এটি একটি প্রশংসনীয় গুণ। যিনি সুন্দরভাবে ইংরেজিতে কথা বলতে পারেন, তার কদর এবং চাহিদা প্র্যয় সর্বত্রই। এই সুবাদে দেশের আনাচে কানাচে গড়ে উঠেছে ইংরজি শেখানোর কোচিং সেন্টার। বিভিন্ন ধরনের আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে তারা প্র্যর্থীদের প্রলোভিত করার চেষ্টা করে। কেউ কেউ বলেন, ‘দ্বিতীয় ঘণ্টা থেকে অনর্গল ইংরেজিতে কথা বলূন।’ আবার কেউ কেউ বলেন, ‘দুই সপ্তাহে ইংরেজিতে কথা বলা শিখূন।’ আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত বাধ্যতামুলক বিষয় হিসেবে ইংরেজি পড়েছে, তার পড়েও তারা ইংরেজিতে দুর্বল থাকে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এসব কোচিং সেন্টার কীভাবে দুই ঘণ্টায় কিংবা দুই সপ্তাহে ইংরেজি বলার নিশ্চয়তা দেয়?
বিভিন্ন উদ্দেশে পড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কিংবা সাধারণভাবে জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাফল্যের জন্য অত্যাবশ্যক। শিক্ষার্থীর সামাজিক এবং আবেগীয় উন্নয়নের জন্য পড়ার ভূমিকা অনেক। শিক্ষার্থীরা যদি বিভিন্ন ধরনের পড়ার বিষয় বা ম্যাটেরিয়ালস না পড়ে, তাহলে তারা অনেক গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক স্কিল অর্জন থেকে দূরে থাকবে। পড়ার মাধ্যমে তারা তাদের আত্মবিশ্বাস জাগ্রত করতে পারে। পড়া বিভিন্ন বিষয় যেমন গণিত, ইতিহাস, বিজ্ঞান, সাহিত্য এবং ভুগোল সম্পর্কে জানার দ্বার উন্মোচন করে। এভাবে পড়ুয়ারা এসব বিষয়ে সহজেই সাফল্য অর্জন করতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, ছোট সময় থেকেইপড়ার অভ্যাস মানুষকে অনেক বেশি পজিটিভ বা ইতিবাচক বিষয় দান করে। তাই ছোট সময় থেকেই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। আর এ বিষয়টি খেয়াল রাখবেন অভিভাবক ও শিক্ষকগণ।
বইয়ের পাতায় ডুবে থাকা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অথচ সহজতম আনন্দের উপায়। বই আপনার কল্পনাকে এমনভাবে ব্যস্ত ও নিয়োজিত রাখে, যা কোনো সিনেমা কিংবা মুভিও পারে না। গল্পের বই হলো লেখকের কথার সাথে আপনার নিজের ইমেজ জুড়ে দেয়ার চেষ্টা করা। বিশেষ এক ধরনের অনুভূতির জন্ম হবে আপনার মধ্যে। আপনি নতুন পৃষ্ঠায় যাবেন। নতুন কিছু আবিষ্কার করবেন অর্থাৎ বই পড়া মানে অনেক নতুন নতুন বিষয়ের সাথে পরিচিত হওয়া। আপনি যদি ভাল এবং মনোযোগী পড়ুয়া হন, তাহলে আপনি পঠিত বিষয়ের মধ্যে লেখার গাঁথুনি আবিষ্কার করবেন এবং আপনার নিজের লেখায় তা ব্যবহার করতে পারবেন। সেখান থেকে আপনি নতুন নতুন ধারণা খুঁজে পাবেন। সেগুলোর ব্যবহারও খুঁজে পাবেন। উপসংহারে বলা যায়, একজন ভাল পাঠক কোনো লেখার ও লেখকের উদ্দেশ্য আাবিষ্কার করতে পারেন এবং নিজের লেখায় তা ব্যবহার করতে পারবেন। অর্থাৎ একজন ভাল পাঠক একজন ভাল লেখক হতে পারেন। শিক্ষা গবেষকগণ আবিস্কার করেছেন, পড়া এবং ভোকাবিউলারি বাড়ানোর মধ্যে একটি গভীর সম্পর্ক রয়েছে। যাদের শব্দভাণ্ডার বেশি, বুঝতে হবে তারা ভাল পাঠক। আপনি যদি আপনার শব্দভাণ্ডার বাড়াতে চান, আপনাকে ব্যাপক পড়াশোনা করতে হবে।
শ্রেণিকক্ষে একজন শিক্ষক জ্ঞানের উৎস। তার সাথে শিক্ষার্থীর বই পড়া এবং সেখান থেকে আহরিত বিষয় যদি সমন্বয় করা হয় শ্রেণীকক্ষে, তাহলে জ্ঞান বিনিময়ের নতুন ক্ষেত্র তৈরি হবে। শুধু পাঠ্যপুস্তক নিয়ে সব সময় ব্যস্ত থাকলে চলবে না, কারণ তা শিক্ষার্থীদের সব সময় আনন্দ দিতে পারে না আর পরিপূর্ণ জ্ঞানও দান করতে পারে না।
লেখক : মাছুম বিল্লাহ, ইংলিশ টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইট্যাব)