বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের 'ইএফটি'র মাধ্যমে বেতন দেয়া হবে, সেটি আনন্দের সংবাদ বটে। অনেকে মনে করেন, ইএফটি'র মাধ্যমে বেতন দেয়া হলে বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের চাকুরি সরকারিকরণের কাছাকাছি আরেক ধাপ এগিয়ে যাবে। প্রকৃতপক্ষে যেদিন থেকে তারা ইনক্রিমেন্ট ও বৈশাখি ভাতা পেতে শুরু করেছেন, সেদিন থেকে সরকারিকরণ তথা জাতীয়করণের স্বপ্নটি বাস্তবায়নের একদম দ্বারপ্রান্তে চলে এসেছেন। এখন অন্তত মাধ্যমিক শিক্ষা স্তরটি জাতীয়করণ করা সরকারের জন্য খুব একটা কঠিন কাজ নয়। আমাদের স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান যুদ্ধ বিধ্বস্ত অর্থনীতির ওপর দাঁড়িয়ে প্রাথমিক শিক্ষা স্তরটি জাতীয়করণ করেছিলেন।
আজ প্রায় চার যুগ পর এখন আমাদের সামর্থ্য বহুগুণ বেড়েছে। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তিতে আমরা এখন 'তলাবিহীন ঝুড়ি'র পরিবর্তে 'অপার সম্ভাবনার বাংলাদেশ'। বাংলাদেশ এখন 'বিশ্বের বিস্ময়'। তারপর কেন জানিনে, প্রাথমিক শিক্ষাস্তর জাতীয়করণের চার দশক পেরিয়ে আজও মাধ্যমিক শিক্ষাস্তরটি জাতীয়করণ করা হয় না? সেটি কোনো শ্রেণিবিশেষের চক্রান্ত কীনা, কে জানে? বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের অবস্থার একেবারে পরিবর্তন হয়নি, সেটি আমরা বলি না। এতদিনে তাদের যেটুকু পাবার কথা সেটুকু তারা পায়নি। আবার পেয়েছেনও অনেক। এক সময় তাদের ব্যাংক একাউন্ট ছিল না। এখন অনলাইন ব্যাংকিং সেবার কারণে তারা দেশের যে কোন প্রান্ত থেকে বেতন উঠাতে পারেন।
দূরের শিক্ষক-কর্মচারীদের ছুটিকালীন সময়ে বেতন তুলতে এখন আর কর্মস্থলের ব্যাংক শাখায় যেতে হয় না। এই যেমন করোনাকালীন সময়ে শিক্ষক-কর্মচারীগণ নিজের বাড়ির পাশের ব্যাংক থেকে বেতন তুলতে পারছেন। তা না হলে, যারা বাড়ি থেকে শত শত কিলোমিটার দূরে কাজ করেন তাদের আজ কী হতো? এখন এমপিওর কপি ঘরে থেকে পাওয়া যায়। মাত্র কয়েক মাস আগে সেটি পেতে ব্যাংকের লোকজনের পিছে পিছে হাঁটতে হতো। তিন মাস পর পর একবার বেতন পাওয়া যেত। সে সব কষ্ট এখন আর নেই। সেই দূর্গম পথ পেরিয়ে এখন 'ইএফটি'র মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীগণ অন্তত মাধ্যমিক শিক্ষাস্তরটি ঐতিহাসিক মুজিববর্ষে জাতীয়করণ হয়ে যাবার স্বপ্নটি দেখতেই পারেন। সেটি এখন আর 'আকাশের চাঁদ' জাতীয় কোন বিষয় নয়। সরকারের জন্যও কঠিন কোন কাজ নয়। থাক সে সব কথা।
'ইএফটি' নিয়ে আজকের লেখাটি শুরু করেছি। জাতীয়করণ নিয়ে অনেক লিখেছি। ভবিষ্যতে আরো লিখবো। আজ তাই, ইএফটি'র মধ্যে লেখাটি সীমাবদ্ধ রাখতে চাই। গতদিন দৈনিক শিক্ষায় 'ইএফটি' চালু করার জন্য কতিপয় তথ্য হাল নাগাদ করার জন্য মাউশি অধিদপ্তরের একটি নির্দেশনা আমরা দেখলাম। ইএফটি চালু হবার সংবাদে শিক্ষক-কর্মচারীদের মধ্যে উৎসাহ দেখা দিয়েছে বটে। কিন্তু, তথ্য হালনাগাদ নিয়ে কারো কারোর মধ্যে উৎকন্ঠা ও উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। অনেক শিক্ষক-কর্মচারীর শিক্ষা সনদ, জাতীয় পরিচয়পত্র ও এমপিও শীটে নামের বানানে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। আমার মনে হয়, সাড়ে পাঁচ লক্ষ শিক্ষক-কর্মচারীর অধিকাংশের ক্ষেত্রে এই সমস্যাগুলো রয়েছে। বেশির ভাগ এমপিও শীটে নামের বানানে ভুল রয়েছে। এমপিওভুক্তির সময় নির্ধারিত ফরমে নামের বাংলা ও ইংরেজি বানান স্পষ্ট করে লিখে দিলেও এমপিও শীটে ইংরেজি বানানটি যে কারণে হউক দু'-একটি অক্ষর এদিক সেদিক হয়ে আছে। কেউ ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় সেটি করতে পারে। অনেকের নামের 'Z' এর স্থলে 'J' কিংবা 'G' হয়েছে। আবার কারো 'U'-র জায়গায় 'O' কিংবা 'I'-র জায়গায় 'E' হয়েছে। এভাবে শত কিংবা হাজার নয়, লক্ষের উপরে শিক্ষক-কর্মচারীর নামের বানানে এ জাতীয় ভুল রয়েছে। কারো কারো শিক্ষা সনদ ও এমপিও শীটে কোন ভুল না থাকলেও আইডি কার্ডের নামের বানানে এক দু' অক্ষরে বেমিল আছে।
এ রকম অসংখ্য শিক্ষক-কর্মচারীর শিক্ষা সনদ, এমপিও শীট ও আইডি কার্ডের নামের বানানের ভিন্নতার কারণে 'ইএফটি' কার্যক্রম বিঘ্নিত হবার আশংকা দেখা দিয়েছে। বেসরকারি শিক্ষক সমাজ 'ইএফটি'কে স্বাগত জানিয়েছেন। কিন্তু, নামের বানানে ভিন্নতার কারণে এই প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করতে সমস্যার সম্মুখীন হবেন বলেও আশংকা করছেন। এই কারণে 'ইএফটি' প্রক্রিয়াটি যেন বাতিল কিংবা বন্ধ না হয়, সেটি আমরা চাই। এমপিও শীট সহজ পদ্ধতিতে সংশোধনের সুযোগ দেয়া দরকার। এ ক্ষেত্রে একজন শিক্ষক কিংবা একজন কর্মচারী তার সবগুলো ডকুমেন্ট সংশোধন করা সময় সাপেক্ষ একটি জটিল কাজ। তাই, সহজ উপায়ে এই জটিলতাগুলো সমাধানের একটি পন্থা বের করা উচিত যাতে দ্রুত সময়ে তা' করে 'ইএফটি' চালু করা সম্ভব হয়। আমরা চাই, বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীগণ 'ইএফটি'র মাধ্যমে বেতন পাওয়ার সুযোগটি যেন পান। কিন্তু, সেটি পেতে গিয়ে তাদের যেন হয়রানির শিকার হতে না হয়। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সহযোগিতার হাত প্রসারিত করার আহ্বান জানিয়ে আজ এখানেই শেষ করছি।
লেখক : অধ্যক্ষ মুজম্মিল আলী, অধ্যক্ষ, চরিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, কানাইঘাট, সিলেট।