ইডেন : হলের ৯০টি কক্ষ ছাত্রলীগ নেত্রীদের দখলে, আয় মাসে ২০ লাখ টাকা - দৈনিকশিক্ষা

ইডেন : হলের ৯০টি কক্ষ ছাত্রলীগ নেত্রীদের দখলে, আয় মাসে ২০ লাখ টাকা

নিজস্ব প্রতিবেদক |

কক্ষ নম্বর ৩১৬। জেবুন্নেছা ছাত্রীনিবাস, ইডেন মহিলা কলেজ। ৮ জন ছাত্রী থাকার কথা থাকলেও এখন বাসিন্দা ১০ জন। কক্ষটি ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ইফরাত জাহান ইতির দখলে। ১০ ছাত্রীর কাছ থেকে তিনি মাসে দেড় থেকে আড়াই হাজার টাকা করে নেন বলে অভিযোগ আছে।

৩১৬ নম্বর কক্ষের বাসিন্দা সাবরিনা আক্তার (ছদ্মনাম) নামের এক ছাত্রী জানান, মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে এই কক্ষে সিট নিয়েছেন প্রত্যেকে। তবে ইফরাত জাহান ইতির দাবি, ‘রুম আমার নিয়ন্ত্রণে নয়। ম্যাডামদের রিকোয়েস্ট করলে তাঁরা আমার পরিচিতদের এই রুমে সিট দেন।’

ইডেন মহিলা কলেজে ছাত্রীনিবাস মোট ছয়টি। এগুলোতে ছাত্রীদের জন্য কক্ষ আছে ৫৪২টি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ছয় ছাত্রীনিবাসের মোট ৯০টি কক্ষ এখন ছাত্রলীগের নেত্রীদের দখলে। এগুলো ‘পলিটিক্যাল রুম’ হিসেবে পরিচিত। একেকটি পলিটিক্যাল রুমে গড়ে ১২ থেকে ১৫ জন ছাত্রী থাকেন। এসব কক্ষে থাকা ছাত্রীদের কারও কাছ থেকে বছরে এককালীন ১০ থেকে ২৫ হাজার টাকা, আবার কারও কাছ থেকে মাসে দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা করে আদায় করা হয়। সে হিসাবে এই ৯০টি কক্ষ থেকে মাসে গড়ে ২০ লাখ টাকার মতো ওঠে। এই কক্ষগুলোর দখল ও টাকার ভাগ-বাঁটোয়ারাকে কেন্দ্র করেই কলেজ শাখা ছাত্রলীগের নেত্রীদের মধ্যে দুটি পক্ষ তৈরি হয়েছে। প্রতিপক্ষকে কুপোকাত করতে হামলা-মামলা, চরিত্র হননসহ বিভিন্ন পথ অবলম্বন করছেন তাঁরা।

কলেজ শাখা ছাত্রলীগের স্থগিত কমিটির এক সহসভাপতি নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, ‘প্রতিবার কমিটি হওয়ার পরই পদপদবি নিয়ে ক্ষোভ-বিক্ষোভ শুরু হয়। এবারও তেমনটা হয়েছে। তবে এবার শুধু পদপদবির জন্য দ্বন্দ্ব এই পর্যায়ে আসেনি, ৯০টা রুমের ভাগ-বাঁটোয়ারাই দ্বন্দ্বের মূল কারণ।’

এসব পলিটিক্যাল রুমের বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়েছিল ইডেনের অধ্যক্ষ অধ্যাপক সুপ্রিয়া ভট্টাচার্যের কাছে। গতকাল বৃহস্পতিবার তিনি বলেন, ‘ছাত্রসংগঠন করা নেত্রীরা যে রুমে থাকেন, সেটাকেই পলিটিক্যাল রুম বলা হচ্ছে। ঢালাওভাবে যে রকম বলা হচ্ছে, ইডেনের হলে এই হয় ওই হয়, এসবের আসলে কোনো ভিত্তি নেই।’ 

২০১৬ সালের নভেম্বর থেকে আহ্বায়ক কমিটির মাধ্যমে চলছিল ইডেন শাখা ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ড। ওই কমিটিতে ছিলেন ১ জন আহ্বায়ক ও ১৫ জন যুগ্ম আহ্বায়ক। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী যুগ্ম আহ্বায়কদের প্রত্যেকে পেয়েছিলেন দুটি করে পলিটিক্যাল কক্ষের নিয়ন্ত্রণ। আর বাকি ৬০টির মতো কক্ষ ছিল আহ্বায়ক তাছলিমা আক্তার ও ১ নম্বর যুগ্ম আহ্বায়ক শাহনাজ আক্তারের দখলে। নেত্রীর সংখ্যা কম থাকায় সে সময় রুমের দখল নিয়ে খুব বড় কোনো সমস্যা হয়নি।

এবার হিসাব গেছে পাল্টে। গত ১৩ মে কলেজ শাখা ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হয়। এই কমিটিতে জায়গা পান ৪৪ জন নেত্রী। সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের বাইরে সহসভাপতি ৩০ জন, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ৫ জন আর সাংগঠনিক সম্পাদক ৭ জন।

ছাত্রলীগের নেত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক এর আগে ২০ থেকে ২৫টি করে কক্ষের নিয়ন্ত্রণ পেতেন। কমিটিতে থাকা বাকিরা পেতেন ২টি কক্ষের দখল। কিন্তু এবার ৪৪ জন নেত্রী হওয়ায় কোনোভাবেই কাউকে সন্তুষ্ট করা যাচ্ছে না। ৪২ জন সহসভাপতি, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং সাংগঠনিক সম্পাদকের প্রত্যেককে ২টি করে কক্ষ দিতে গেলে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের ভাগে আর বলতে গেলে থাকেই না। আবার সভাপতি-সম্পাদক তাঁদের ভাগ বুঝে নিলে অন্যদের খাতা শূন্য থেকে যায়।

এর বাইরে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে জায়গা পাওয়া চার নেত্রীও হলে থাকেন। তাঁরা প্রত্যেকে তিন-চারটি করে কক্ষ দখলে রেখেছেন। কমিটির সহসভাপতি ফেরদৌসী আশরাফ লুবণা বলেন, ‘কেন্দ্রীয় কমিটিতে চলে যাওয়া নেত্রীরাও রুমের দখল ছাড়তে চান না। সমস্যা তো এখানেই।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্থগিত কমিটির সভাপতি তামান্না জেসমিন রিভা একাই হলের ৩৮টি রুমের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আপনারা এসে তদন্ত করে দেখুন, এর কোনো সত্যতা পান কি না। প্রতিটা রুমের সবাই কলেজের অনুকূলে ব্যাংক ড্রাফট করে টাকা জমা দিয়ে উঠেছেন। আমাকে নাজেহাল করতে এসব অভিযোগ তোলা হচ্ছে।’ 

নেত্রীদের নিয়ন্ত্রণে কক্ষ থাকা মানে ওই কক্ষে যত ছাত্রী তোলা হবে, প্রত্যেকের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা আদায় হবে। পাশাপাশি ওই ছাত্রীরা নেত্রীর আজ্ঞাবহ অনুসারীতে পরিণত হবেন। অর্থাৎ যাঁর কক্ষ যত বেশি, তাঁর অনুসারীও তত বেশি। সাংগঠনিক যেকোনো অনুষ্ঠানে এই অনুসারীরা নেত্রীর সঙ্গে থাকেন।

এসব কক্ষের সিট বাণিজ্যের টাকায় চলে নেত্রীদের বিলাসী জীবনযাপন। পাশাপাশি সংগঠনের বড় নেতা-নেত্রীদের উপহার দিতেও খরচ হয় বড় একটা অংশ।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সাংগঠনিক সম্পাদক বলেন, ‘সভাপতি সাধারণ সম্পাদক কোনো প্রোগ্রামে গেলে সঙ্গে দেড় শ থেকে দুই শ কর্মী নিয়ে যেতে হয়। না হলে তাঁর হ্যাডম থাকে না। এ জন্য কেন্দ্র থেকেই বলা হয়, সভাপতিকে বেশি রুম দিতে।’

ছাত্রলীগের অন্তঃকোন্দলে গত শনিবার রাত থেকে শুরু করে রোববার দিনভর উত্তপ্ত ছিল ইডেন কলেজ ক্যাম্পাস। রোববার সন্ধ্যায় দুই পক্ষের সংঘর্ষে কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি তামান্না জেসমিন ওরফে রিভা, সাধারণ সম্পাদক রাজিয়া সুলতানাসহ অন্তত ১০ জন আহত হন। এ ঘটনায় রোববার রাতে ইডেন কলেজ কমিটি স্থগিত ও সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের বিরোধীপক্ষের ১২ নেত্রীসহ ১৬ নেতা-কর্মীকে স্থায়ী বহিষ্কার করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ।

আর চাঁদাবাজি ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগে স্থগিত কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ আটজনের বিরুদ্ধে গত বুধবার আদালতে মামলা করেছেন কলেজ শাখা ছাত্রলীগের বহিষ্কৃত সহসভাপতি জান্নাতুল ফেরদৌস। তিনি সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধের ছাত্রীদের নানাভাবে হেনস্তা ও অনৈতিক কাজে বাধ্য করার অভিযোগও এনেছেন।

এসব অভিযোগের কোনোটাই মানতে চান না সভাপতি রিভা। তিনি বলেন, ‘আমাকে বিপাকে ফেলতেই অসত্য অভিযোগ করা হচ্ছে। অনৈতিক কাজের যে অভিযোগ করা হচ্ছে, এটা যদি কেউ প্রমাণ করতে পারে, আমাকে যেই শাস্তি দেবে আমি মাথা পেতে নেব।’

এদিকে জান্নাতুলের অভিযোগের পর থেকে সামাজিকভাবে বিদ্রূপের শিকার হচ্ছেন ইডেনের শিক্ষার্থীরা ৷ তাঁরা বলছেন, রিভাকে আক্রমণ করতে গিয়ে জান্নাতুল ইডেন কলেজের অসম্মান করেছেন।

জেবুন্নেসা ছাত্রীনিবাসের শিক্ষার্থী নাদিয়া সুলতানা বলেন, ‘মাত্র ৪০টা মেয়ের জন্য আমরা ইডেনের ৪০ হাজার ছাত্রী ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের শিকার হচ্ছি। বাসা থেকে হল ছাড়তে বলা হচ্ছে।’

ছাত্রলীগের পাল্টাপাল্টি হামলার ঘটনায় দুটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন অধ্যক্ষ সুপ্রিয়া ভট্টাচার্য। তবে তদন্ত কমিটিতে থাকা কারও নাম প্রকাশ করতে চাননি তিনি। সুপ্রিয়া ভট্টাচার্য বলেন, ‘কমিটিকে আমরা তিন দিনের সময় বেঁধে দিয়েছিলাম। তবে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি পরীক্ষা থাকায় তারা কাজ শেষ করতে পারেনি। আশা করছি ১৫ দিনের আগেই আমরা তদন্ত প্রতিবেদন পাব। তার ভিত্তিতে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

স্কুল-কলেজ খুলছে রোববার, ক্লাস চলবে শনিবারও - dainik shiksha স্কুল-কলেজ খুলছে রোববার, ক্লাস চলবে শনিবারও নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল - dainik shiksha ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি - dainik shiksha সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ - dainik shiksha বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি - dainik shiksha সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা - dainik shiksha ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস - dainik shiksha এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0035538673400879