উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা : সর্বোত্তম বিকল্পই নিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - দৈনিকশিক্ষা

উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা : সর্বোত্তম বিকল্পই নিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়

আমিরুল আলম খান |

অভিশপ্ত এক বছর ২০২০। সারা দুনিয়া স্থবির। ব্যক্তিগত জীবন থেকে রাষ্ট্রীয় কর্মচঞ্চলতা নেই। সামাজিক বন্ধন শিথিল হয়ে পড়েছে। কত মানুষ মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে তারও সঠিক কোন পরিসংখ্যান নেই কারো হাতে। নিতান্ত বাধ্য না হলে কেউ ঘরের বাইরে যাচ্ছে না এমন কি, সেসব দেশেও যেখানে করোনা তেমন মারাত্মক হয়ে ওঠনি। ভিয়েতনামে মাত্র একজন করোনায় মারা গেছে। পাশের দেশ থাইল্যান্ডে মাত্র ৫৯ জন। কিন্তু সেসব দেশে জীবন স্বাভাবিক ছন্দে ফিরে আসেনি। স্বাভাবিক ছন্দে ফিরতে আরও কতদিন লাগবে তাও কেউ সুনির্দিষ্ট করে বলতে পারছে না। করোনা থেকে সুস্থ হয়ে ওঠা মানুষজন দীর্ঘস্থায়ী শারীরিক ও মানসিক বিপর্যয়ের মুখে রয়েছে। তাদের মধ্যে বিপুল হতাশা। ভুগছে মানসিক অবসাদে। কবে নাগাদ তারা সম্পূর্ণ সুস্থ হবে কেই জানে না। বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা তাই করোনা থেকে সেরে ওঠা মানুষদের নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।

সবচেয়ে বেশি সতর্কতা নিতে হয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। কয়েকটি দেশে স্কুল খুলে দিয়ে করোনা ফিরে আসার কারণে আবার বন্ধ করে দিতে হয়েছে। পাঠদান চলছে অনলাইনে। পরীক্ষাও। কিন্তু সব দেশের সে সামর্থ্য নেই। আমাদের দেশেও খুব সীমিত পরিসরে চলছে অনলাইন শিক্ষাদান কর্মযজ্ঞ। অধিকাংশ শিক্ষার্থীর প্রয়োজনীয় গ্যাজেট (কম্পিউটার, স্মার্ট ফোন, নেট  ইত্যাদি)। বেশির ভাগ মানুষেরই সে সামর্থ্য নেই। আবার যাদের এসব গ্যাজেট কেনার সমার্থ্য আছে তাদের অনেকেরই আবার এগুলো ব্যবহারের দক্ষতা নেই। বাংলাদেশে অনলাইন শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে খুব বেশি হলে ২০ ভাগ শিক্ষার্থী। পাঠ গ্রহণে সামর্থ্য আর অনলাইনে পরীক্ষা দেওয়া এক নয়। আবার এ ধরনের পরীক্ষা গ্রহণ করে সে সব মূল্যায়নের জন্য প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি, প্রোগ্রাম, তা পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় প্রাযুক্তিক জ্ঞান আছে সীমিত সংখ্যক মানুষের। এছাড়া, বিপুল সংখ্যক পরীক্ষার্থীর উত্তরপত্র গ্রহণ, সংরক্ষণ ও মূল্যায়নের জন্য প্রয়োজনীয় প্রাযুক্তিক অবকাঠামো কিংবা জনবল কিছুই আমাদের নেই। থাকলেও তা এত অপ্রতুল যে তা দিয়ে যে কোন জাতীয় পরীক্ষা পরিচালনা অসম্ভব।  

এমন এক পরিস্থিতিতে সরকার চলতি বছরের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা না নেবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। পরীক্ষা না হলে মূল্যায়র কীভাবে হবে? এ প্রশ্ন ছিল সবার মনে। গতকাল শিক্ষামন্ত্রী তার একটি সমাধান ঘোষণা করেছেন। সবাইকে পাস ঘোষণা করেছেন। বলেছেন, জেএসসি ও মাধ্যমিক পরীক্ষার গড় ফলাফলের ভিত্তিতে সবাইকে মূল্যায়ন করা হবে। সেখানে গ্রেড পয়েন্ট এভারেজ (জিপিএ) নির্ধারণে জটিলতা না থাকলেও বিষয়ভিক্তিক গ্রেড পয়েন্ট (জিপি) নির্ধারণে বেশ কিছু জটিলতা আছে। জেএসসি ও মাধ্যমিকে বিষয়ের পার্থক্য আছে। আবার মাধ্যমিকের সাথে উচ্চ মাধমিকের কিছু বিষয়ের পার্থক্য আছে। মাধ্যমিকে বিজ্ঞান বিভাগে পাস করা কিছু শিক্ষার্থী আবার উচ্চ মাধ্যমিক মানবিক বা ব্যবসায় শিক্ষায় চলে যায়। সেখানেও জটিলতা আছে। সরকার বলছে, তারা এসব সমস্যা মোকাবেলায় কমিটি করেছেন এবং তাদের সুপারিশের ভিত্তিতে এসব সমস্যার সমাধান করা হবে। এজন্য চূড়ান্ত ফলাফল ঘোষণা করা হবে ডিসেম্বরে। 

সরকারের এ সিদ্ধান্তের পক্ষে-বিপক্ষে নানা মত প্রকাশিত হচ্ছে। সেটা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু মনে রাখতে হবে গোটা দুুনিয়া চলছে এক অস্বাভাবিক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে। কাজেই সনাতন ধারণা বা বিশ্বাস নিয়ে এ সমস্যার সমাধান সম্ভব ছিল না। সরকার যদি পরীক্ষা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিত তাহলে সেটি আরও বেশি সমালোচনার মুখে পড়ত। কেননা সেটা হয়ে উঠত জীবন-মরণের প্রশ্ন। সেক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হত মেয়েরা। ক্ষতিগ্রস্ত হত গরিব আর দুর্গম এলাকার পরীক্ষার্থীরা। বিপুল সংখ্যক পরীক্ষার্থী এ পরীক্ষায় অংশ গ্রহণই করতে পারত না। প্রত্যেক কলেজই পরীক্ষা কেন্দ্র ঘোষণা করেও পরীক্ষা সেবার ব্যবস্থা করা সম্ভব হত না। কেননা, উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে অধিকাংশ পরীক্ষার্থী মেধা ও সামর্থ্য অনুযায়ী দূরবর্তী ভাল কলেজে পড়ে। তারা আত্মীয়-স্বজনের বাড়ি, বাসা ভাড়া করে, কিংবা হোস্টেল বা মেসে থেকে লেখাপড়া করেছে। করোনায় মানুষের আয় কমে গেছে। ফলে বহু মানুষ ভাড়া বাসা ছেড়ে চলে গেছে। শুধু পরীক্ষার জন্য অল্প কিছুদিনের জন্য বাসা ভাড়া করার কঠিন হত। 

সবার উপর ছিল স্বাস্থ্য ঝুঁকি। পরীক্ষার সাথে পরীক্ষার্থী, পরীক্ষা গ্রহণ সংক্রান্ত কর্মকর্তা, অনেক ক্ষেত্রে অভিভাবকদের সংশ্লিষ্টতা থাকে। এর সাথে যুক্ত হয় বিপুল সংখ্যক পরিবহণ শ্রমিক। এবার প্রায় ১৩ লাখের বেশি পরীক্ষর্থীর উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবার কথা ছিল। তাই এ বিপুল কর্মযজ্ঞে সামিল হতে হত প্রায় ১৫/১৬ লাখ মানুষ। তার সাথে বিবেচনা করতে হবে আর্থিক বিষয়টিও। কর্মহীন হয়ে পড়ায় অনেক অভিভাবকের পক্ষে সে ব্যয় বহন করা কঠিন হত। 

বলা হচ্ছে, ও-লেবেল, এ-লেবেল পরীক্ষা নেয়া হল। তারা সব ধনীর সন্তান। অভিযোগটি কতখানি যথার্থ? প্রথমত, এই দুই পরীক্ষা নেয়া হয় অনলাইনে। যারা এ পরীক্ষায় অংশ নেয় তাদেও সে ঝুঁকি নেবার সামর্থ্য আছে। কিন্তু উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা অনলাইনে নেবার যে আদৌ কোন ব্যবস্থা এদেশে এখনও গড়ে ওঠে নি সে বাস্তবতা মানতেই হবে। উপরে তা সংক্ষেপে আলোচনা করেছি। 

এ কথা মানতেই হবে, পরীক্ষা না নেওয়ায় কিছু পরীক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অনেকে ভাবছে, তাদের স্বপ্ন চুরমার হয়ে গেছে। উচ্চ মাধ্যমিকে ভাল ফল করে তারা প্রত্যাশিত প্রফেশনাল গ্রাজুয়েট হতে পারত। এখন সেটা ঝুঁকির মধ্যে পড়ল। তবে মনে রাখতে হবে, আমাদেও দেশে উচ্চ শিক্ষার জন্য ভর্তি পরীক্ষা দিতে হয়। সে ক্ষেত্রে তারা ভর্তি পরীক্ষায় ভাল করে স্বপ্নের বিষয় নির্বাচনের সুযোগ পাবে। এখন যেটা করতে হবে, তাহল মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের ফলাফলের জন্য কোন ক্রেডিট না দেওয়া। শুধুমাত্র ভর্তি পরীক্ষার ভিত্তিতে ভর্তি করে এ সমস্যার সমাধান করা যাবে। 

তবে স্বীকার করতেই হবে, কোন কাজই সম্পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত হয় না। কাজেই ষোলোআনা ত্রুটিমুক্ত কিছু করা অসম্ভব।
তাই সরকারের এই সিদ্ধান্ত সর্বাঙ্গ ত্রুটিমুক্ত না হলে মন্দের ভাল বিকল্প।

 লেখক: আমিরুল আলম খান, শিক্ষাবিদ, সাবেক চেয়ারম্যান যশোর শিক্ষাবোর্ড। 

এমপিও কোড পেলো আরো ১৪ স্কুল-কলেজ - dainik shiksha এমপিও কোড পেলো আরো ১৪ স্কুল-কলেজ নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী হিটস্ট্রোকে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র তূর্যের মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র তূর্যের মৃত্যু পরীক্ষার নাম এসএসসিই থাকবে, ওয়েটেজ ৫০ শতাংশ - dainik shiksha পরীক্ষার নাম এসএসসিই থাকবে, ওয়েটেজ ৫০ শতাংশ ফরেনসিক অডিটে ফাঁসছেন দশ হাজার জাল সনদধারী - dainik shiksha ফরেনসিক অডিটে ফাঁসছেন দশ হাজার জাল সনদধারী কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের পিএইচডি ফেলোশিপ - dainik shiksha প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের পিএইচডি ফেলোশিপ সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি - dainik shiksha সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন - dainik shiksha জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা - dainik shiksha সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0038888454437256