উচ্চশিক্ষা গ্রহণের লক্ষ্যে ২০১৯ সালে বাংলাদেশ থেকে বিদেশের বিভিন্ন গন্তব্যে পাড়ি জমানো শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৪৪ হাজারের কিছু বেশি। একই সময়কালে প্রতিবেশী দেশ নেপাল থেকে উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশ যান ৯০ হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থী। অর্থাৎ জনসংখ্যায় বাংলাদেশের পাঁচ ভাগের এক ভাগেরও কম হওয়া সত্ত্বেও নেপাল থেকে বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য যাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাংলাদেশের দ্বিগুণ। জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কোর তথ্য বলছে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে উচ্চশিক্ষায় বিদেশযাত্রার প্রবণতা সবচেয়ে কম বাংলাদেশে। শনিবার (২৭ নভেম্বর) বণিক বার্তা পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন সাইফ সুজন।
প্রতিবেদনে আরও জানা যায় বিদেশে উচ্চশিক্ষার গন্তব্য বিষয়ে প্রতি বছর ‘গ্লোবাল ফ্লো অব টারশিয়ারি লেভেল স্টুডেন্টস’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করে ইউনেস্কো। সংস্থাটির সর্বশেষ প্রতিবেদনে বিভিন্ন দেশ থেকে উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে বিদেশ যাওয়া শিক্ষার্থীর হার তুলে ধরা হয়েছে। এতে দেখা যায়, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য বিদেশযাত্রার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি ভুটানে। ভুটানের উচ্চশিক্ষা প্রার্থীদের ৩৮ দশমিক ৪ শতাংশই বিদেশে পাড়ি জমান। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা দেশ মালদ্বীপ থেকে বিদেশে উচ্চশিক্ষা নিতে যাওয়া শিক্ষার্থীর হার ২১ দশমিক ৮ শতাংশ। এরপরের অবস্থানে থাকা নেপালে এ হার ২১ দশমিক ৪ শতাংশ। আর সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা বাংলাদেশে এ হার মাত্র ১ দশমিক ২ শতাংশ। পাশের দেশ ভারতে এ হার ১ দশমিক ৩ শতাংশ। অন্য দেশগুলোর মধ্যে শ্রীলংকায় ৮ দশমিক ৮, আফগানিস্তানে ৮ দশমিক ২ ও পাকিস্তানে ২ দশমিক ৩ শতাংশ।
বিশ্লেষকরা বলছেন, নেপাল, ভুটান ও মালদ্বীপের মতো দেশগুলোতে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা অনেক কম। এজন্য উচ্চশিক্ষার ডিগ্রি নিতে দেশগুলোর শিক্ষার্থীদের এখনো বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর নির্ভর করতে হয়। এজন্যই এসব দেশ উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে বিদেশযাত্রার প্রবণতা বেশি। অন্যদিকে বাংলাদেশে গত দুই দশকে ডজনে ডজন বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন দিয়েছে সরকার। দেশের মধ্যে উচ্চশিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি হওয়ার কারণে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিদেশমুখিতা অনেক কমে গেছে।
এ প্রসঙ্গে ইউজিসির সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল মান্নান বলেন, গত কয়েক বছরে দেশের উচ্চশিক্ষা খাত ব্যাপক আকারে বিকশিত হয়েছে। এর অন্যতম একটি সুফল হচ্ছে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিদেশমুখিতা কমেছে। একটা সময় ছিল উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য দেশের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষার্থী পাশের দেশ ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমাতো। তবে দেশে নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে ওঠার কারণে এ হার অনেকটাই কমে গেছে। তবে গত কয়েক বছরে দেশের উচ্চশিক্ষার মান নিয়ে যেভাবে প্রশ্ন উঠছে, তাই এ বিষয়ে ভাববার প্রয়োজন রয়েছে। অন্যথায় শিক্ষার্থীরা পুনরায় বিদেশমুখী হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
এদিকে সংখ্যা বিবেচনায় দক্ষিণ এশিয়ার দেশেগুলোর মধ্যে উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী যায় ভারত থেকে। ইউনেস্কোর ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৯ সালে ভারত থেকে সর্বমোট ৪ লাখ ৬১ হাজার ৭৯২ জন শিক্ষার্থী বিদেশ যান। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা নেপাল থেকে বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য যান ৯৩ হাজার ৯২১ জন। তৃতীয় অবস্থানে থাকা পাকিস্তান থেকে বিদেশে পাড়ি জমান ৫৯ হাজার ৭৮৪ শিক্ষার্থী। এছাড়া ওই বছর বাংলাদেশ থেকে ৪৪ হাজার ৩৩৮, আফগানিস্তান থেকে ৩১ হাজার ৫২২, শ্রীলংকা থেকে ২৮ হাজার ৫৮৩, ভুটান থেকে ৫ হাজার ৮৬ ও মালদ্বীপ থেকে ৩ হাজার ১১২ শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশ যাত্রা করেন।
উচ্চশিক্ষার জন্য বাংলাদেশীদের শীর্ষ গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র। ২০১৯ সালে বিদেশ যাওয়া ৪৪ হাজার ৩৩৮ জনের মধ্যে ৮ হাজার ১২২ জনই যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গেছেন। এছাড়া মালয়েশিয়ায় ৬ হাজার ৯০৪, অস্ট্রেলিয়ায় ৬ হাজার ১৯১, কানাডায় ৩ হাজার ৭৩৫, জার্মানিতে ২ হাজার ৯২০, যুক্তরাজ্যে ২ হাজার ৬৪৫, জাপানে ২ হাজার ৪৩৬, ভারতে ২ হাজার ২৫৮, কোরিয়া রিপাবলিকে ১ হাজার ১২১ ও সৌদি আরবে ১ হাজার ৬২ জন উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য পাড়ি জমান।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী বলেন, গত এক দশকে দেশের উচ্চশিক্ষার আকার আগের তুলনায় দ্বিগুণ হয়েছে। উচ্চশিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি সরকারি অর্থায়নের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগেও বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলা হয়েছে। এ সময়ে শুধু দক্ষিণ এশিয়া নয়; অন্য কোনো দেশের উচ্চশিক্ষায় এ বিকাশ হয়নি। যেহেতু দেশের মধ্যে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ তৈরি হয়েছে, তাই স্বাভাবিকভাবে শিক্ষার্থীদের বিদেশযাত্রা কমে গেছে। তবে উচ্চশিক্ষার বিকাশের পাশাপাশি আমাদের এখন গুণগত মানের দিকে বেশি নজর দিতে হবে। গ্র্যাজুয়েটদের মাল্টিস্কিলড করে গড়ে তুলতে হবে।