উপাচার্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ : ইউজিসির গণশুনানি ও ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দের অ্যাক্ট - দৈনিকশিক্ষা

উপাচার্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ : ইউজিসির গণশুনানি ও ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দের অ্যাক্ট

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক (একাডেমিক নয় কি?) প্রধানকে বলা হয় ভাইস চ্যান্সেলর। আর চ্যান্সেলর হলেন রাষ্ট্রপতি (কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী)। ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সে যা-ই থাকুক না কেন, আক্ষরিক অর্থে একজন উপাচার্যের মর্যাদা রাষ্ট্রপতি কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে প্রধানমন্ত্রীর পরেই। কিন্তু শিক্ষকদের অপরাজনীতির প্রত্যক্ষ ফল হিসেবে এই পদটির মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত হতে হতে এমন স্তরে পৌঁছেছে যে, একজন উপাচার্যের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ তদন্ত করার জন্য অভিযুক্ত ও অভিযোগকারী- উভয় পক্ষের বক্তব্য শুনতে ইউজিসি গণশুনানির ব্যবস্থা করে। এই করোনার মধ্যেও সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি উভয় পক্ষকে ঢাকায় তলব করা হয়েছে। অভিযুক্ত উপাচার্য একে স্বাগত জানিয়েছেন। কারণ সম্ভবত তিনি তার সৎসাহসের দ্বারা চালিত হয়ে মনে করেছেন, এর মাধ্যমে তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগগুলোর যথাযথ জবাব প্রদান করে তিনি নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে সক্ষম হবেন। সন্দেহ নেই, এটি একটি ইতিবাচক স্পিরিট। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে ইউজিসির তদন্ত দল তাকে এভাবে ডাকতে পারে কিনা। কিংবা এরূপ ডাকে সাড়া দেওয়া শোভনীয় হবে কিনা? বুধবার (৯ সেপ্টেম্বর) সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত সম্পাদকীয়তে এ তথ্য জানা যায়।

সম্পাদকীয়তে আরও জানা যায়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত ১৯৭৩ সালের অ্যাক্ট দ্বারা পরিচালিত এবং এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যালেন্ডারেই পাওয়া যাবে কোনো উপাচার্যের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ তদন্ত ও বিচারের উপায়। ১৯৭৩ সালের অ্যাক্টকে উপেক্ষা করে ইউজিসি যে প্রক্রিয়ায় গণশুনানি করতে যাচ্ছে তা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য মানহানিকর। আদালতের দ্বারস্থ হলে উভয় প্রতিষ্ঠানের সম্পর্কের মধ্যকার স্বাভাবিক ছন্দ বিনষ্ট হতে পারে। তাই ইউজিসির উচিত তদন্ত দলকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রেরণ করা। কেননা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সুমহান মর্যাদা সুরক্ষা করা বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান হিসেবে ইউজিসির দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে।

যারা অভিযোগ উত্থাপন করেছেন, তারাও এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানীত শিক্ষক। গণশুনানিতে যাবেন কিনা এটা তাদেরও বিবেচনা করা জরুরি। কেননা ইতোপূর্বে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং গোপালগঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ে উদ্ভূত পরিস্থিতি তদন্ত করতে ইউজিসির তদন্ত দল ওই বিশ্ববিদ্যালয় দুটিতে গিয়েছিল, তলব করেনি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের যে কোনো দুর্নীতি-অনিয়ম নিয়ে কথা বলার উপযুক্ত ক্ষেত্র হচ্ছে একাডেমিক কাউন্সিল এবং সিনেট। একাডেমিক কাউন্সিল বলবৎ রয়েছে কিন্তু সিনেট অকার্যকর। এক্ষেত্রে সিনেটকে কার্যকর করার উদ্যোগ নেওয়া জরুরি ছিল। এটিই হতো নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রথম ধাপ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য মর্যাদাপূর্ণ। কিন্তু তা না করে ইউজিসির কাছে সরাসরি অভিযোগ উত্থাপন করা ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খাওয়ার মতো ব্যাপার হয়েছে। এর পেছনে প্রতিষ্ঠানটিকে দুর্নীতিমুক্ত করার সদিচ্ছার পরিবর্তে রাজনৈতিক সুবিধালাভের আকাঙ্ক্ষাটিই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

ইউজিসি কিন্তু বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত ১৯৭৩ সালের অ্যাক্টের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অভিযোগগুলো সিনেট গঠন করে সেখানে আলোচনার জন্য ফেরত পাঠাতে পারত। কিন্তু তারা তা করেনি। কেন করেনি তা অস্পষ্ট নয়। বিশেষজ্ঞ শিক্ষকগণ মনে করছেন, এর মধ্য দিয়ে ইউজিসির 'খবরদারি প্রতিষ্ঠানে' পরিণত হওয়ার ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটেছে।

মজার ব্যাপার হলো, এই তদন্তে কারা লাভবান হবেন কিংবা কী ফলাফল বয়ে আনবে তা সুস্পষ্ট না হলেও, কেউ কেউ ইতোমধ্যেই পরবর্তী উপাচার্য হওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন। যেহেতু বর্তমান উপাচার্যের মেয়াদ শেষের দিকে। উপাচার্য হওয়ার স্বপ্ন দেখা অস্বাভাবিক কিছু নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হওয়ার মতো যোগ্য প্রফেসর এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ডজন খানেকের বেশিই রয়েছেন। বর্তমানে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচজন প্রফেসর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে সুনামের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। তাছাড়া কেউই চিরদিন উপাচার্য থাকেন না।

ইউজিসিকে ব্যবহার করে কাউকে অপমান করে বিদায় করার পরিকল্পনা যারা করেছেন, ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, তারা সফল হলে পরিকল্পনাকারীর আজকের সারথি তিনি পদে বসার পরদিন থেকেই তার বিরুদ্ধেও একই সূত্র প্রয়োগ করবে। কেননা এ রাজচক্র! এর মর্মভেদ করা বড়ই কঠিন। সেজন্যই বলি, যে চেয়ারটাতে আপনি বসতে চাচ্ছেন, সেই চেয়ারটার মর্যাদা যেন আগেই নষ্ট হয়ে না যায় তা নিশ্চিত করা কি শ্রেয় নয়?

এটি অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বাংলাদেশে বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়েরই মান যুগোপযোগী নয় এবং এগুলো ক্রমেই দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে যাচ্ছে। নগর পুড়লে দেবালয় কি রক্ষা পায়? তারপরও সার্বিক বিচারে বাংলাদেশের অন্য যে কোনো প্রতিষ্ঠানের চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখনও স্বচ্ছতা বিদ্যমান। এদেশে সাবেক প্রধান বিচারপতিও দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত, বিচার চলছে। একাধিক সেনানায়ক সংবিধান লঙ্ঘন ও গণতন্ত্র হত্যা করে দীর্ঘ অপশাসন চালিয়েছেন। যারা দুর্নীতির মূলোৎপাটন করবে, সেই প্রতিষ্ঠান অর্থাৎ দুদকের কমিশনারের বিরুদ্ধেও গুরুতর অভিযোগ দেখেছি। নির্বাচন কমিশনের নির্বাচন পরিচালনা ব্যয়ের অবিশ্বাস্য গল্পও আমরা গণমাধ্যমের বদৌলতে অবগত হয়েছি। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের বালিশকাণ্ডের হোতা যে প্রকৌশলী তার বিচার তো হয়ইনি বরং জামিন পেয়েছেন। যে ঠিকাদার এইসব কাণ্ডের ভাগীদার তাকে কালো তালিকাভুক্ত করার পরিবর্তে আরও প্রকল্পের কাজ দেওয়া হয়েছে। আর করোনার বদৌলতে স্বাস্থ্য খাতের যে অবস্থা দেখলাম তাতে 'সেলফ নিউ নরমাল পলিসি'-ই ভরসা!


এই যখন দেশের চিত্র তখন একজন উপাচার্যের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিজ্ঞাপিত সংখ্যার অতিরিক্ত নিয়োগদান কি এমন গুরুতর অভিযোগ? যখনই কোনো নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হয়, তা ঝাড়ূদার পদেই হোক কিংবা অফিসার-শিক্ষক নিয়োগই হোক, ফোন আসতে থাকে নামে-বেনামে। রাজনৈতিক চাপ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বিভিন্ন গ্রুপের চাপ তো রয়েছেই। একজন উপাচার্যের এত চাপ মোকাবিলা করা কীভাবে সম্ভব? তাই সময় এসেছে এই চাপের সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসার। আর তা করতে হলে আমাদের ১৯৭৩ সালের অ্যাক্টকেই কার্যকর করতে হবে। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর থেকে রাষ্ট্রশক্তিতে আসীন সরকারগুলো এই অ্যাক্টকে লঙ্ঘন করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নিয়ন্ত্রণ করার যে সংস্কৃতি চালু করেছে, তা থেকে এই প্রতিষ্ঠানগুলো আর আত্মসম্মান নিয়ে বেরিয়ে আসতে পারেনি। সমস্যার গোড়াটা এখানেই।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে পরিশুদ্ধ করতে চাইলে এগুলোর স্বায়ত্তশাসন বজায় রাখার পাশাপাশি দ্রুত অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল প্রতিষ্ঠা ও কার্যকর করা জরুরি। আর এই কাউন্সিল অবশ্যই গঠন করতে হবে প্রথিতযশা শিক্ষাবিদদের নিয়ে। এতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক আমলা ও অন্যান্য বিশেষজ্ঞ সদস্য থাকতে পারেন; কিন্তু অবশ্যই বিশেষজ্ঞ শিক্ষকদের যেন ঠুঁটো জগন্নাথে পরিণত করা না হয়। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের গবেষণার উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি, আর্থিক প্রণোদনা ও গবেষণার সম্মানজনক স্বীকৃতির ব্যবস্থা করলে শিক্ষক রাজনীতির ধারাই পাল্টে যাবে। তখন আর ইউজিসিকে গণশুনানির ব্যবস্থা করতে হবে না।

লেখক : সৈয়দ মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন চৌধুরী, সভাপতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

মাধবীলতা নয়, স্কুলের নাম কচুগাড়ি পুনর্বহালের দাবি - dainik shiksha মাধবীলতা নয়, স্কুলের নাম কচুগাড়ি পুনর্বহালের দাবি খুদে শিক্ষার্থীর হাতে অস্ত্র কেনো! - dainik shiksha খুদে শিক্ষার্থীর হাতে অস্ত্র কেনো! এইচএসসির ফরম পূরণ শুরু আজ - dainik shiksha এইচএসসির ফরম পূরণ শুরু আজ মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষা হতে পারে জানুয়ারিতে - dainik shiksha মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষা হতে পারে জানুয়ারিতে মুজিবনগর দিবসে সব স্কুল-কলেজে আলোচনা - dainik shiksha মুজিবনগর দিবসে সব স্কুল-কলেজে আলোচনা মেয়াদোত্তীর্ণ শিক্ষক নিবন্ধন সনদের ফটোকপি পোড়ানো কেমন প্রতিবাদ! - dainik shiksha মেয়াদোত্তীর্ণ শিক্ষক নিবন্ধন সনদের ফটোকপি পোড়ানো কেমন প্রতিবাদ! কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0058391094207764