এক সঙ্গে এত শিক্ষক নিয়োগ ঐতিহাসিক ও ইতিবাচক - দৈনিকশিক্ষা

এক সঙ্গে এত শিক্ষক নিয়োগ ঐতিহাসিক ও ইতিবাচক

মাছুম বিল্লাহ |

আমাদের শিক্ষার দৈন্যদশার মধ্যে মাঝে মাঝে কিছু ধনাত্মক ঘটনা ঘটে, যেগুলো সেভাবে মিডিয়া কাভারেজ পায় না। কিন্তু শিক্ষার বৃহত্তর স্বার্থে এবং এর গুরুত্ব তুলে ধরতে বিষয়গুলো সবার দৃষ্টিতে আনা প্রয়োজন। ক’দিন আগে আমরা দেখলাম, বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ৩৬ হাজারের বেশি শিক্ষকপদে প্রার্থীরা আনুষ্ঠানিকভাবে নিয়োগ পেয়েছেন। যদিও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে সুপারিশ পাওয়া প্রার্থীরা আগেই সুপারিশপত্র পেয়েছিলেন। অনুষ্ঠানে বিভিন্ন সরকারি স্কুলের শিক্ষক পদে সরকারি কর্ম কমিশনের মাধ্যমে সুপারিশ পাওয়া ২ হাজার ৬৫ জন প্রার্থীকে ও বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এনটিআরসিএর মাধ্যমে সুপারিশ পাওয়া ৩৪ হাজার ৭৩টি পদে সুপারিশ পাওয়া প্রার্থীদের নিয়োগপত্র ও সুপারিশপত্র আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের হাতে তুলে দেয়া হয়। দেশের সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মিলিয়ে মোট ৩৬ হাজার শিক্ষক নিয়োগ পেয়েছেন। এর মধ্যে সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ২ হাজার ৬৫ জন ও বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ৩৪ হাজার ৭৩ জন। বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে বেসরকারি স্কুল, কলেজ ও মাদরাসায় শিক্ষক নিয়োগ দিতে গত বছরের ৩০ মার্চ নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। এর মধ্যে এমপিও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ৪৮ হাজার ১৯৯ জন ও নন-এমপিও প্রতিষ্ঠানে ৬ হাজার ১০৫ জন নিয়োগের পরিকল্পনা ছিল। পরে ৩৮ হাজার ২৮৩ জন প্রাথমিকভাবে নির্বচিত হন, যাদের ৩৪ হাজার ৭৩ জন নিয়োগ পেয়েছেন। বেসরকারিদের মধ্যে এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ৩০ হাজার ৯০৪ জন ও নন-এমপিও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ৩ হাজার ১৬৯ জন নিয়োগ পেয়েছেন। সরকারি মাধ্যমিক স্কুলে ২ হাজার ১৫৫ জন সহকারী শিক্ষক নিয়োগের জন্য গত বছরের ২৪ জানুয়ারি সরকারি কর্ম কমিশন সুপারিশ করে। স্বাস্থ্য প্রতিবেদন পাওয়ার পর ২ হাজার ৬৫ জনকে নিয়োগ প্রদান করা হয়েছে। শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে এই ধরনের আনুষ্ঠানিকতা একটি নতুন উদ্যোগ। এটি নিশ্চয়ই একটি উৎসাহব্যঞ্জক এবং কার্যকর পদক্ষেপ। তবে মিডিয়ায় বিষয়টি সেভাবে আসেনি।

২৪ জানুয়ারি (২০২২) আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে সরকারি স্কুলে নিয়োগ পাওয়া দুই হাজারের বেশি প্রার্থীর নিয়োগপত্র ও বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সুপারিশ পাওয়া ৩৪ হাজার প্রার্থীর সুপারিশপত্র আনুষ্ঠানিকভাবে বিতরণ অনুষ্ঠানে ভার্চুয়াল মাধ্যমে যুক্ত হয়ে প্রধান অতিথি হিসেব বক্তব্য রাখেন শিক্ষামন্ত্রী। তিনি বলেন, শিক্ষক সংকট থাকায় ‘পুলিশ ভেরিফিকেশন’ প্রতিবেদন না নিয়েই নতুন শিক্ষকদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এই প্রতিবেদন চলমান রয়েছে। যেহেতু প্রয়োজনীয়তা আছে, শূন্যপদ পূরণ করা প্রয়োজন, সেজন্য ভেরিফিকেশন প্রতিবেদন না পাওয়া সত্ত্বেও তাদের নিয়োগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। প্রতিবেদনে বিরূপ কিছু থাকলে তাদের বাদ দেয়া হবে।’ তিনি আরও বলেন, শিক্ষকদের মানসম্মত শিক্ষা দেয়ার মতো দক্ষতা ও যোগ্যতা থাকতে হবে। আমরা শিক্ষার মানে যে পরিবর্তন আনতে চাচ্ছি, তার জন্য নতুন কারিকুলাম প্রণয়ন করা হয়েছে, পাঠ্যপুস্তকে পরিবর্তন আনা হয়েছে। কিন্তু এ কারিকুলাম বাস্তবায়নের সব চেয়ে বড় ভূমিকা শিক্ষকদের। শিক্ষকদের মানসম্মত হতে হবে, যোগ্যতা সম্পন্ন হতে হবে। মানসম্মত শিক্ষা দেয়ার জন্য যোগ্যতা ও দক্ষতা শিক্ষকদের থাকতে হবে। তাই বিভিন্ন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শিক্ষকদের আরও দক্ষতা অর্জন করতে হবে। এখন আমাদের দেশ প্রযুক্তিতে অনেক এগিয়েছে। আমাদের শিক্ষকদের প্রযুক্তিকে কাজের হাতিয়ার করে নিতে হবে, তাহলে আরও ভাল হবে।’

 এখানকার অনেকগুলো বিষয়ের সাথে আমরা একমত পোষণ করছি। সবচেয়ে মূল্যবান কথাটি হচ্ছে, ‘শিক্ষকদের মানসম্মত হতে হবে, যোগ্যতা সম্পন্ন হতে হবে’। শিক্ষকদের এখন শুধু দাবি-দাওয়া নিয়ে আলোচনা মিছিল করলে চলবে না। নিজেদের উন্নয়নের জন্য, এই যুগের উপযোগী শিক্ষক হিসেবে নিজেদের প্রমাণ করার জন্য প্রস্তুত করতে হবে। বিভিন্ন সোর্স থেকে জ্ঞান আহরণ করতে হবে, শিক্ষা সংক্রান্ত সর্বশেষ তথ্যাবলি সংগ্রহ করতে হবে। রাষ্ট্রের আশায় শুধু তাকিয়ে থাকলে হবে না, রাষ্ট্র কখন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করবে তখন প্রশিক্ষণ নিয়ে কিছু নতুন বিষয় তারা জানবেন। এই যুগে শিক্ষা উন্নয়নের, পেশাগত উন্নয়নের বহু প্লাটফর্ম আছে, শিক্ষকদের সেগুলোর সাথে যুক্ত হতে হবে। শিক্ষক সংগঠনগুলোকেও শুধু দাবি-দাওয়া আদায়ের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার না করে পেশাগত উন্নয়নের প্লাটফর্মেও  কাজ করতে হবে।

শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে আরও জানা যায়, প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত হলেও যে ৪ হাজার ১৯৮ জনের স্বাস্থ্যপরীক্ষার প্রতিবেদন পাওয়া যায়নি। তাদের প্রতিবেদন ৭ ফেব্রুয়ারির মধ্যে পাওয়া গেলে নিয়োগের সুপারিশ করা হবে। এছাড়া নিয়োগ পাওয়া কোনো শিক্ষক চাকরিতে যোগ না দিলে সেই পদে মেধাক্রমের পরবর্তী ব্যক্তিকে নিয়োগ দেয়া হবে। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ১৫ হাজার ২২৫টি পদে কে নো আবেদন পাওয়া যায়নি। এসব শূন্য পদে নিয়োগ দিতে আবার বিজ্ঞপ্তি দেয়া হবে। যেখানে আবেদন পাওয়া যায়নি, সেখানে প্রার্থী নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হয়নি। আবার কিছু ভুল তথ্যও ছিল। যেমন, নারীদের প্রতিষ্ঠানে শরীরচর্চা পদে পুরুষ প্রার্থী এসেছিল, তাদের সুপারিশ করা হয়নি। কিছু প্রতিষ্ঠান সরকারি হয়ে গেছে, সেখানেও নিয়োগ দেয়া হয়নি। অনুষ্ঠানে শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী বলেন, ‘করোনা পরিস্থিতির মধ্যেই অর্থনীতিতে একটা বিরূপ প্রভাব পড়েছে। বিদ্যালয়ে সশরীরে পাঠদান ব্যাহত হয়েছে। তবে ডিজিটাল বাংলাদেশের মাধ্যমে আমরা কার্যক্রম পরিচালনা করেছি। আজ যেসব শিক্ষক নিয়োগের সুপারিশ পাচেছন, এই যোগ্য শিক্ষকদের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার ন্যূনতম মান নির্ধারিত হবে বলে আমি মনে করি। এছাড়া শিক্ষার্থীদের শুধু পাঠক্রমের মধ্যে আটকে রাখলে হবে না, বরং গতানুগতিকতার বাইরে এসে শিক্ষার্থীদের শেখাতে হবে। তাদের উন্নত মানসিকতার দর্শন শেখাতে হবে। দক্ষ হতে হবে এবং টেকসইভাবে গড়ে তুলতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য, শারীরিক স্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দেয়া, তাদের প্রয়োজনীয় কাউন্সিলিং করা, তাদের আগামী জীবনের জন্য পরামর্শ দেয়ার দায়িত্ব শিক্ষকদের। আজ যারা নিয়োগ পাবেন, তারা সবাই এসব বিষয় মাথায় রাখবেন বলে আমি আশা করি।’

তবে করোনার সময়ে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে শর্তসাপেক্ষে এই শিক্ষকদের নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। তাই প্রত্যেককে অবশ্যই নিরাপত্তা ছাড়পত্র দিতে হবে। নিরাপত্তা ছাড়পত্র নেয়ার ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা যাতে পালন করা হয়, মন্ত্রণালয় থেকে এ ধরনের স্পষ্ট নির্দেশনা থাকতে হবে। আমরা শুনেছি এবং অনেকেই জানি যে,  ‘পুলিশ ফেরিকেশনের’ নামে অবৈধ অর্থের লেনদেন হয়, রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার কথা সামনে এনে প্রার্থীদের হয়রানি করা হয়। সেটি যাতে না হয়। এদেশের নাগরিক হিসেবে উপযুক্ত প্রার্থীরা যাতে তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি পায সে ব্যবস্থা রাষ্ট্রকে করতে হবে। সরকারিকরণ হয়ে যাওয়া, মেয়েদের প্রতিষ্ঠানে শরীরচর্চা শিক্ষক পদে কয়েকজন নিয়োগ পাওয়ায় কয়েকজন প্রার্থী নিয়োগের চূড়ান্ত সুপারিশ করা হয়নি। তাদেরও অন্য পদে নিয়োগ সুপারিশ করা হবে। এটিও একটি চমৎকার সিদ্ধান্ত।

এক সাথে এত সংখ্যক শিক্ষকদের নিয়োগ দেয়া, সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষক, এমপিও ও নন-এমপিওভুক্ত বিদ্যালয়ে একত্রে নিয়োগ দেয়া, নিয়োগপত্র শিক্ষামন্ত্রীকর্তৃক প্রদান এবং একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা, এই চারটি বিষয়ই নতুন, চারটি বিষয়ই অত্যন্ত প্রশংসনীয় এবং শিক্ষকদের জন্য একটি বিরাট ওরিয়েন্টেশন। এসব বিষয়কে আমি অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে এবং অত্যন্ত মূল্যবান বিষয় হিসেবে দেখছি। শিক্ষকদের জন্য এটি দরকার। কোথায় কীভাবে নিয়োগ হয়, কেউ কোনো খবর রাখে না। কিন্তু এভাবে একত্রে শিক্ষক নিয়োগদানে একটি নতুন ধরনের অধ্যায় সৃষ্টি হলো। এাঁ অত্যন্ত ইতিবাচক একটি বিষয়। নতুন শিক্ষকগণ দুই শিক্ষামন্ত্রী ও সচিবের সাথে অন্তত ছবিতে, অনলাইনে যুক্ত হতে পেরেছেন এটি সত্যিই একটি আনন্দের বিষয় এবং শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে একটি নতুন দিক। আরও এক দু’জন শিক্ষাবিদদের এখানে যুক্ত করে তাদের কিছু মতামত প্রদান করার সুযোগ দিলে হয়তো আরও ভাল হতো। তারপরেও, যা হয়েছে এটি আমি বলব একটি ঐতিহাসিক বিষয়। ধন্যবাদ শিক্ষামন্ত্রণালয়কে, ধন্যবাদ শিক্ষামন্ত্রীকে।

লেখক : মাছুম বিল্লাহ, ইংলিশ টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইট্যাব)

শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না - dainik shiksha সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু - dainik shiksha চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় - dainik shiksha প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট - dainik shiksha রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0071640014648438