একজন সত্যিকারের সাংবাদিকের জন্য ভালোবাসা - দৈনিকশিক্ষা

একজন সত্যিকারের সাংবাদিকের জন্য ভালোবাসা

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

মিজানুর রহমান খানের ধানমন্ডির ভাড়া ফ্ল্যাটে গতকাল ১১ জানুয়ারি সন্ধ্যায় যাই। ভাবি রোদন করছিলেন। বলছিলেন, ‘এই দরজা নিজে খুলে হেঁটে চলে গেলেন হাসপাতালে। আমরা বাসার সবাই করোনা পজিটিভ। ভাবলাম, উনি হাসপাতালে আছেন, ভালো আছেন। সেই যাওয়া যে শেষ যাওয়া হবে, কে ভেবেছিল?’ মিজান ভাইয়ের মেয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপত্যের প্রথম বর্ষের ছাত্রী আফসারা খান, আর ছেলে মাস্টারমাইন্ডের ক্লাস নাইনের ছাত্র আনান খান মায়ের চেয়ার ধরে দাঁড়িয়ে আছে। আফসারা বলছিল, ‘দুদিন আগেও বাবার কাছে ছিলাম, বাবা হাত ধরে ছিলেন, কিছুতেই আসতে দিচ্ছিলেন না।’ মিজান ভাইয়ের বড় ছেলে শাদমান কেবল এলএলবি শেষ করেছে, এশিয়া প্যাসিফিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বৃত্তি পেয়েছে, মাস্টার্স করবে। শাদমানের সঙ্গে দেখা হয়েছিল কালকে ভরসাঁঝে, যখন কেবল মিজান ভাইয়ের মৃত্যুর সংবাদ আমাদের কাছে আসে, তার পরপরই। মিজান ভাই আমার বছর দুয়েকের ছোট, শাদমানরা আমার সন্তানের মতো, আমি হাসপাতালের করিডরে ওকে জড়িয়ে ধরে থাকি। শাদমান কাঁদছে। কাঁদুক। কাঁদলে যদি বুকটা হালকা হয়। 

সাংবাদিক মিজানুর রহমান খান

আমরাও তো কাঁদছি। বুক হালকা হয় না। ভাবি বলেন, ‘উনি তো চলে গেলেন, আমাদের কার কাছে রেখে গেলেন?’

আমাদের মনে হয়, মিজানুর রহমান খান চলে গেলেন, বাংলাদেশের সাংবাদিকতায় সততা, প্রজ্ঞা, অধ্যবসায়, পরিশ্রম, নিষ্ঠা, নিরপেক্ষতার যে নজির তিনি স্থাপন করেছেন, সেইখানে যে শূন্যতাটা হলো, তা-ও তো আর পূরণ হবে না। আমাদেরও মনে হয়, গলা ছেড়ে কেঁদে বলি, বাংলাদেশের সাংবাদিকতাকে আপনি কার কাছে রেখে গেলেন?

মিজান ভাই ছিলেন আপাদমস্তক সাংবাদিক এবং ২৪ ঘণ্টার সাংবাদিক। হাতের মোবাইল ফোনটা সচল রেখে কারওয়ান বাজারের সড়ক থেকে তুললেন সেই বাসচাপা পড়া কাটা হাতের ছবি। করোনাকালে হাসপাতালের সামনে সারা রাত জেগে থেকে জানালেন ভেতরে কী ঘটছে। আবার চলে গেলেন ওয়াশিংটন ডিসিতে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমেরিকান দলিল ঘেঁটে লিখলেন বই, প্রতিবেদন। খবরের গবেষণার কাজে চলে গেলেন রাশিয়ায়। প্রথম আলোতে বিশেষ প্রতিবেদন, এক্সক্লুসিভ স্টোরিগুলোর অনেকগুলোই তো তাঁর। ১৭ ডিসেম্বর ২০২০ তিনি হাসপাতালে, প্রথম আলোয় আধা পৃষ্ঠাজুড়ে ছাপা হলো তাঁর প্রতিবেদন ‘মুক্তিযুদ্ধে মার্কিন গোয়েন্দা ব্যর্থতা’। ২৬ মার্চ ২০২০ প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপা হলো ‘ব্রিটিশ নথিতে মুজিব’, ১৭ মার্চ ‘উনসত্তরেই স্বাধীন “দেশ” ভেবেছিলেন মুজিব’, ২১ ফেব্রুয়ারি ‘নিক্সনকে বঙ্গবন্ধুর বাংলায় চিঠি’। অর্থাৎ পাঠককে বিশেষ কিছু দিতে হলেই আমাদের ছিলেন একজন মিজানুর রহমান খান। মার্কিন দলিলে মুজিব হত্যাকাণ্ডসহ একাধিক বইয়ের লেখক তিনি।

আমাদের সম্পাদক মতিউর রহমানকে তিনি মান্য করতেন পিতার মতো। শেষ শয্যায় শুয়ে তিনি মতিউর রহমান ভাইকে চিঠি লিখেছেন। মতি ভাইও তাঁকে চিকিৎসকদের উপদেশ মেনে চলার আদেশ দিয়েছেন। তিনি তা মান্য করেছেন অনুগত সৈনিকের মতো। বাংলাদেশের সেরা চিকিৎসকদের দিয়ে বোর্ড করে, এসকেএফ ফার্মাসিউটিক্যালস থেকে দুজন বিশেষজ্ঞকে সারাক্ষণ মিজান ভাইয়ের চিকিৎসার সঙ্গে যুক্ত রেখে প্রথম আলো পরিবার, তাঁর পরিবার, চিকিৎসক-সেবকেরা চেষ্টা করেছেন সাধ্যের সবটা উজাড় করে দিয়ে। কিন্তু বড় অসময়ে, বড় তাড়াতাড়ি মিজান ভাই আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন।

মৃত্যুর আগের দিন তাঁর বোনকে তিনি লিখে বলেছেন, ‘আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাও।’

সেই যাওয়া একেবারে শেষ যাওয়া। করোনা শুরুর দিনগুলোয় আমি একদিন মিজান ভাইয়ের টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে সাক্ষাৎকার নেওয়ার ভঙ্গিতে বলেছিলাম, ‘মিজান ভাই, আপনি কি মনে করেন, করোনায় প্রথম আলোর কেউ মারা যাবে?’ তিনি হেসে বললেন, ‘না, আমি মনে করি না।’

এই কথা মনে পড়লে আমার বুক ভেঙে আসে। সারা দেশে আজ পর্যন্ত প্রথম আলোর ৮২ জন কর্মী করোনায় আক্রান্ত হলেন। সবাই সুস্থ হয়ে গেলেন। একজন মিজানুর রহমান খান চলে গেলেন।

মিজান ভাই সাংবাদিকতায় বুঁদ ছিলেন, সংসারে তাঁর বাহুল্য ছিল না। পার্থিব সঞ্চয়ও কিছু নেই।

কিন্তু তাঁর অপার্থিব সঞ্চয় অতুল। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শোকের স্রোত বইছে, সবাই তাঁর সততা, নিষ্ঠা, পেশাদারি এবং প্রজ্ঞার প্রশংসা করছেন। আর তাঁর লেখাগুলো আমাদের ইতিহাস-সন্ধানীদের জন্য স্থায়ী সম্পদ হয়ে রইবে।

মিজান ভাইয়ের শোকাহত পরিবারের প্রতি আমাদের গভীর সমবেদনা। মিজান ভাই, আপনি ছিলেন একজন সত্যিকারের সাংবাদিক। আমাদের হৃদয়নিংড়ানো ভালোবাসা আপনার জন্য, সবটুকু। আমরা যেন আপনার কাছ থেকে কিছু শিখতে পারি। নিতে পারি।

 

লেখক : আনিসুল হক, সহযোগী সম্পাদক, দৈনিক প্রথম আলো ।

সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো

শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না - dainik shiksha সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু - dainik shiksha চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় - dainik shiksha প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট - dainik shiksha রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0073099136352539