পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে এত দিন সাধারণত ২০০ নম্বরের ভিত্তিতে শিক্ষার্থী নির্বাচন করা হতো। এর মধ্যে এসএসসি ও এইচএসসির সনদের ওপর থাকত ৮০ নম্বর। আর পরীক্ষা নেওয়া হতো ১২০ নম্বরে। কিন্তু এবার আর সেটা হচ্ছে না। ভর্তিতে সনদের ওপর তেমন কোনো নম্বর রাখতে চাচ্ছে না বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। এবার যেহেতু পরীক্ষা ছাড়াই আগের দুই পরীক্ষার ভিত্তিতে এইচএসসি ও সমমানের ফল প্রকাশ করা হয়েছে, তাই মেধা যাচাইয়ে কঠোর হচ্ছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। ভর্তিতে অনেকটা ‘মিনি ইন্টারমিডিয়েট’ পরীক্ষায় বসতে হবে শিক্ষার্থীদের।
তবে দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টার পর এবার এখন পর্যন্ত সাধারণ ও বিজ্ঞান-প্রযুক্তি এবং কৃষি নামে দুটি গুচ্ছে ২৬ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় আসতে রাজি হয়েছে। আরেকটি গুচ্ছে আরো চারটি বিশ্ববিদ্যালয় আসার কথা থাকলেও সেটা নিয়ে এখনো অনিশ্চয়তা রয়েছে। এ ছাড়া সরকারের অনেক চেষ্টার পরও বড় চারটি বিশ্ববিদ্যালয়কে কোনোভাবেই গুচ্ছে আনা সম্ভব হয়নি। ফলে এবার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিতে শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি কমলেও পিছু ছাড়ছে না।
সাধারণ ও বিজ্ঞান-প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় গুচ্ছের যুগ্ম আহ্বায়ক ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. মীজানুর রহমান বলেন, ‘করোনার কারণে ২০২০ সালের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব না হলেও তারা কিন্তু সিলেবাস শেষ করেছে। তাই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা হবে অনেকটা মিনি ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার মতো। উচ্চ মাধ্যমিকের সিলেবাসে যা সবার কমন ছিল, সেখান থেকেই প্রশ্ন করা হবে। আমরা এই ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমেই শিক্ষার্থীদের মেধা যাচাই করতে চাই।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমরা গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে একটি স্কোর দিয়ে দেব। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সিদ্ধান্ত নেবে, তারা সনদের ওপর আলাদা কোনো নম্বর রাখবে কি না।’
বড় চার বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এরই মধ্যে ১০০ নম্বরের ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এর মধ্যে এসএসসি ও এইচএসসির ফল থেকে নেওয়া হবে মাত্র ২০ নম্বর। অন্য তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ও আলাদা পরীক্ষা নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। তবে ভর্তি পরীক্ষার নম্বর বণ্টন এখনো প্রকাশ করেনি।
জানা যায়, দেশে প্রায় অর্ধশত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থাকলেও এবার ৩৯টিতে স্নাতক পর্যায়ে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হবে। এগুলোর মধ্যে ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশে পরিচালিত চার বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও জাহাঙ্গীরনগর) গুচ্ছ ভর্তিতে আসছে না। অন্যদিকে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (বিইউপি), বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এভিয়েশন অ্যান্ড এরোস্পেস ইউনিভার্সিটিও আলাদা পরীক্ষা আয়োজনের কথা জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে (ইউজিসি)। ফলে এই সাতটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গুচ্ছবদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
ইউজিসি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিয়ে একটি গুচ্ছ করার উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অসহযোগিতার কারণে তা এগোচ্ছে না। তবে রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (রুয়েট), চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট) এবং খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট) এতে সম্মত আছে। এই গুচ্ছে বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়কেও নিয়ে আসার পরিকল্পনা রয়েছে ইউজিসির। এ ছাড়া অ্যাফিলাইটিং বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয় এবং উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় আলাদা শিক্ষার্থী ভর্তি করাবে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজে সাধারণত পরীক্ষা ছাড়া জিপিএর ভিত্তিতে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়।
দেশে গুচ্ছ পদ্ধতির পরীক্ষার প্রবর্তক হচ্ছে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। গত বছরই তারা অভিন্ন পরীক্ষা নিয়েছে। এবার এই গ্রুপে যুক্ত হয়েছে ছয়টি প্রতিষ্ঠান। আর ২০টি সাধারণ ও বিজ্ঞান-প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় একসঙ্গে অভিন্ন গুচ্ছে পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত এরই মধ্যে জানিয়ে দিয়েছে। এই গুচ্ছভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় এরই মধ্যে দুটি বৈঠক করেছে। পরবর্তী বৈঠক আগামী ৪ ফেব্রুয়ারি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত হবে।
জানা যায়, ২০২০ সালের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় ১৩ লাখ ৬৭ হাজার ৩৭৭ জন শিক্ষার্থীর সবাই উত্তীর্ণ হয়েছে। এর মধ্যে জিপিএ ৫ পেয়েছে এক লাখ ৬১ হাজার ৩৭৭ জন। ফলে আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে, সব শিক্ষার্থীর জন্য উচ্চশিক্ষার আসন রয়েছে কি না।
ইউজিসি সূত্র জানায়, উচ্চশিক্ষায় নিয়োজিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে স্নাতক সম্মান, স্নাতক পাস ও সমমান কোর্সে ১৩ লাখ ২০ হাজারের মতো আসন রয়েছে। এর মধ্যে ৩৯টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬০ হাজার ৯৫টি, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই লাখ তিন হাজার ৬৭৫টি, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে আট লাখ ৭২ হাজার ৮১৫টি, ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬০ হাজার, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ৭৭ হাজার ৭৫৬টি, দুটি আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪৪০টি এবং মেডিক্যাল ও ডেন্টাল কলেজে সাড়ে ১০ হাজার আসন রয়েছে।
এ ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সাত কলেজে ২৩ হাজার ৩৩০টি, চারটি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ৭২০টি, ছয়টি টেক্সটাইল কলেজে ৭২০টি, সরকারি ও বেসরকারি নার্সিং ও মিডওয়াইফারিতে পাঁচ হাজার ৬০০টি, ১৪টি মেরিন অ্যান্ড এরোনটিক্যাল কলেজে ৬৫৪টি, ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সাড়ে তিন হাজার এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত প্রতিষ্ঠানে ২৯০টি আসন রয়েছে বলে ইউজিসি জানিয়েছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, যেহেতু অনেক শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষায় ভর্তিই হয় না, তাই আসনের তেমন কোনো সংকট হবে না। তবে মানসম্পন্ন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বড় অভাব রয়েছে। এবার যেহেতু জিপিএ ৫ পেয়েছে দেড় লাখেরও বেশি শিক্ষার্থী, তাই তাদের সবার পক্ষে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ নেই। এমনকি অনেকেই ভালো কোনো প্রতিষ্ঠানেও পড়ার সুযোগ পাবে না।
ইউজিসির সদস্য (পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়) অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আলমগীর বলেন, ‘ইতিমধ্যে দুটি গুচ্ছে ২৬টি বিশ্ববিদ্যালয় আসতে রাজি হয়েছে। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গুচ্ছে বুয়েট না এলেও বাকি তিনটি থাকবে বলে জানিয়েছে। চলতি সপ্তাহেই বুয়েট তাদের সিদ্ধান্ত জানাবে। চলতি বছর উচ্চশিক্ষায় ভর্তিতে আসনের ক্ষেত্রে কোনো সংকট হবে না। প্রায় সব শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার সুযোগ পাবে। তবে পছন্দের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বিষয়ে ভর্তিতে তীব্র প্রতিযোগিতা হবে। সত্যিকার অর্থে মেধাবী না হলে এবার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পাবে না।’
গত শনিবার এইচএসসির ফল প্রকাশ অনুষ্ঠানে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেন, ‘উচ্চ মাধ্যমিক পাস করা সব শিক্ষার্থীর জন্য এবার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিতে পর্যাপ্ত আসন না-ও থাকতে পারে। তবে সবাইকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে হবে তাও তো নয়। আমাদের আরো নানা রকম উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। কারিগরি শিক্ষার অনেক জায়গা আছে। সেখানে আসন খালি থাকে, কিন্তু আমরা শিক্ষার্থী পাই না। এবার আশা করি, সেদিকে অনেকেই যেতে উদ্বুদ্ধ হবে। এটা তাদের জন্য ভালো, দেশের জন্যও ভালো।’