বাংলাদেশে শিক্ষার্থীরা প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে বিভিন্ন বিষয়ে মৌলিক জ্ঞান অর্জন শেষে উচ্চশিক্ষার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন। শিক্ষার্থীদেরকে প্রতিযোগিতামূলক ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে হয়। বর্তমানে দেশে উচ্চমাধ্যমিকে তিনটি শাখা বিদ্যমান। কিন্তু উচ্চশিক্ষার জন্য আছে ভিন্নতর শিক্ষালয়। যেমন, প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ, সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। এসব প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন নিয়মে এবং সময়ে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া হয়। এতে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন ধরনের ভোগান্তিতে পড়েন। রোববার (১৪ ফেব্রুয়ারি) জনকণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত উপসম্পাদকীয়তে এ তথ্য জানা যায়।
উপসম্পাদকীয়তে আরও জানা যায় শিক্ষার্থীদের দুর্ভোগ কমাতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি পরীক্ষা একই নিয়ম ও পদ্ধতিতে হওয়া জরুরী বলে মনে করছি। বিশেষ করে ডিজিটাল বাংলাদেশে কম্পিউটারভিত্তিক পরীক্ষা ব্যবস্থা এখন সময়ের দাবি। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শিক্ষা-চাকরিসহ বিভিন্ন পর্যায়ের প্রবেশিকা পরীক্ষা নেওয়া হয় আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর পদ্ধতিতে। মালেশিয়ায় উচ্চমাধ্যমিক স্কুল পর্যায়ে, শ্রীলঙ্কায় উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে, ইরানে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে, পাকিস্তানে মেডিকেল, ডেন্টাল ও প্রকৌশল কলেজ পর্যায়ে, চীনে কলেজ পর্যায়ে, ভিয়েতনামে জাতীয় উচ্চমাধ্যমিক স্কুলে ভর্তি পরীক্ষা কম্পিউটারভিত্তিক ভর্তি পরীক্ষা চালু আছে।
প্রচলিত ভর্তি পরীক্ষার সঙ্কট : চলতি বছরের আগে দেশের মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজ ছাড়া সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হতো তাদের নিজস্ব নিয়মে। প্রতিটা বিশ্ববিদ্যালয় নিজের কারিকুলাম তৈরি করে ভর্তি পরীক্ষার বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করত। এতে দেশের বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে চরম দূর্ভোগে পড়তে হতো শিক্ষার্থীদের। এই সনাতন পদ্ধতির ভর্তি পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের নানা ভোগান্তিতে পরতে হয়। দেশে ৪৬টির মতো বিশ্ববিদ্যালয় সনাতন পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার সময় নিজেদের সুবিধা মতো পরীক্ষার আয়োজন করার ফলে শিক্ষার্থীরা বিপাকে পড়েন। দীর্ঘদিন ধরে ভর্তি পরীক্ষা চলমান থাকার কারণে একই তারিখে একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা আরম্ভ হয়। অনেক সময় দেশের দুই প্রান্তের দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার দিন ১ বা ২ দিন পর হওয়ার ফলে যোগাযোগ সমস্যার কারণে ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও পরীক্ষায় অংশ নিতে পারে না অনেক শিক্ষার্থী। এতে উচ্চ শিক্ষার স্বপ্নের সমাপ্তি ঘটে। পাশাপাশি ব্যাপক অর্থ ও সময়ের অপচয় হয় লাখো শিক্ষার্থীর। এর সঙ্গে যোগ হয় অসহ্য শারীরিক ও মানসিক চাপ।
কম্পিউটারভিত্তিক পরীক্ষা পদ্ধতি : প্রচলিত পরীক্ষা পদ্ধতির বিকল্প হিসেবে কম্পিউটারভিত্তিক পরীক্ষা ব্যবস্থাপনা প্রযুক্তিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। কোভিড-১৯ এর প্রাদুর্ভাবের কারণে এই পদ্ধতির ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। কম্পিউটারভিত্তিক পরীক্ষা ব্যবস্থাপনা দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করছে। পদ্ধতিটি সাশ্রয়ী, নিরাপদ ও নির্ভরযোগ্য। বর্তমানে মোবাইল, ট্যাব বা স্মার্টফোন দিয়ে গ্রহণযোগ্য হাই-স্টেইক্স পরীক্ষা না হলেও লো-স্টেইক্স পরীক্ষা প্রচলিত রয়েছে। হাই-স্টেইক্স কম্পিউটারভিত্তিক পরীক্ষা মূলত দু’ধরনের: ১. একটি কমপ্লায়ান্ট পরীক্ষা পরিবেশে ডেস্কটপ অথবা ল্যাপটপ কম্পিউটার দিয়ে সার্ভারভিত্তিক অফলাইন পরীক্ষা। এখানে তদারকি হয় সি-সি-টি-ভিতে ধারণকৃত ডি-ভি-আর রেকর্ডিং বিশ্লেষণের মাধ্যমে। ২. একটি কমপ্লায়ান্ট পরীক্ষা পরিবেশে ডেস্কটপ অথবা ল্যাপটপ কম্পিউটার দিয়ে ইন্টারনেটভিত্তিক অনলাইন পরীক্ষা। এখানে তদারকি হয় সরাসরি সার্টিফাইড রিমোট প্রক্টর (সি-আর-পি) এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশাল ইন্টেলিজেন্সের (এ-আই) যৌথ তত্ত্বাবধানে। প্রশ্নপত্রের নিরাপত্তা এ-আই এক্সিপশন এবং ডিক্রিপশন ট্র্যাকিং-এর মাধ্যমে নিশ্চিত করা হয়। প্রশ্ন যদি বাস্তবনির্ভর বা অব্জেক্টিভ প্রশ্নভিত্তিক হয়– যেমন এম-সি-কিউ, সত্য-মিথ্যা, ম্যাচিং কলাম আর ফিগারেটিভ বা চিত্রলেখা– তাহলে পরীক্ষা শেষে তাৎক্ষণিক ফলাফল ও সংখ্যাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ পাওয়া যায়। ব্যাখ্যা ও ভাবপূর্ণ বা সাব্জেক্টিভ প্রশ্নভিত্তিক প্রশ্নপত্রের ফলাফল ও সংখ্যাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ সঙ্গত কারণেই পরে পাওয়া যায়।
পরীক্ষা তত্ত্বাবধান পদ্ধতি : পরীক্ষার শুরুতে কগ্নিটিভ এ-আই বায়োমেট্রিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে অনুমোদিত, সত্যায়িত ও বৈধ পরিচয়পত্রের সঙ্গে পরীক্ষার্থীর চেহারা মিলানো হয়। মিলে গেলে কিছু চ্যালেঞ্জ প্রশ্ন করা হয় এ পদ্ধতিতে। তারপর একজন সার্টিফাইড এপ্রুভার পরীক্ষা অনুমোদন দেওয়া বা না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। অনুমোদিত পরীক্ষার্থীকে পরীক্ষাকালীন আচরণবিধি ভালভাবে বোঝানো হয়। পরীক্ষার প্রারম্ভে পরীক্ষার্থীর স্ক্রিন ও ব্রাউজার অন্যান্য নেভিগেশন এবং এ্যাপ্লিকেশন থেকে বিচ্ছিন্ন করে তার পরীক্ষাকালীন আচরণের সমস্ত গতিবিধি অনুসরণ ও রেকর্ড করা হয়। কগ্নিটিভ এ-আইয়ের প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণে সন্দেহজনক আচরণ দেখা গেলে সেটা তৎক্ষণাৎ ফ্ল্যাগ করে সঙ্গে সঙ্গে পরীক্ষায় সাময়িক বিরতি দেয়া হয়। ম্যানেজ-বাই-এক্সেপশন বা ব্যতিক্রমভিত্তিক ব্যবস্থাপনায় সার্টিফাইড প্রক্টরের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে প্রাথমিক স্তরেই পরিস্থিতির সমাধান হয়ে গেলে আবার পরীক্ষা শুরু হয়। সমাধান না হলে পরবর্তী স্তরে পরীক্ষার ধারণকৃত ভিডিও অনুসন্ধান সাপেক্ষে পরীক্ষা স্থগিত রাখা হয়। সেই অনুসন্ধানের বিবরণ অনুযায়ী পরীক্ষা আবার শুরু অথবা বাতিল করা হয়। কম্পিউটারভিত্তিক পরীক্ষা ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি বিভিন্ন মানের হলেও মূলত একই অনুক্রম বজায় রাখে। বেশিরভাগ সল্যুশন প্রোভাইডার শুধু বিভিন্ন মানের সফটওয়্যার বিতরণের মাঝেই নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখে। আবার বিশেষ কিছু সার্ভিস প্রোভাইডার সফটওয়্যার, প্ল্যাটফর্ম ও প্রশিক্ষণসহ শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সব পরীক্ষা-ব্যবস্থাপনা সম্পন্ন করে।
বিশ্বে কম্পিউটারভিত্তিক পরীক্ষা পদ্ধতি : কোভিড-১৯ মহামারীর প্রেক্ষাপটে কম্পিউটারভিত্তিক পরীক্ষা ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির ব্যাপক প্রসার ঘটলেও এই পদ্ধতিকে শুধু করোনাকালীন জরুরী অবস্থার গণ্ডিতে বেঁধে রাখা অসম্ভব। সঙ্গত কারণেই এই পদ্ধতির গ্রহণযোগ্যতা, জনপ্রিয়তা ও প্রবৃদ্ধি প্রায় দুই দশক ধরে প্রসারিত হচ্ছে। উন্নত ও উন্নয়নশীলসহ সারা পৃথিবীর ১৬০টি দেশের প্রথম সারির প্রায় ১২০০ শিক্ষা, সরকারী, পেশাদারী ও ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে এই পদ্ধতি প্রচলিত রয়েছে। প্রতিবেশী দেশ ভারতে এই পদ্ধতিতে ২০০৬ সাল থেকে পরীক্ষা নেয়া হচ্ছে। আই-আই-এম আর আই-আই-টির মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সকল গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা এখন কম্পিউটারভিত্তিক হচ্ছে।
ভারত : প্রতিবেশী দেশ ভারতে এই পদ্ধতিতে ২০০৬ সাল থেকে পরীক্ষা নেয়া হচ্ছে। প্রশাসনিক আই-সি-এস এবং প্রায় সব কর্পোরেট পরীক্ষাসহ আই-আই-এম আর আই-আই-টির মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা এখন কম্পিউটারভিত্তিক হচ্ছে। এ সমস্ত পরীক্ষা সরকারী ন্যাশনাল টেস্টিং এজেন্সির (এন-টি-এ) নির্দেশনা ও তত্ত্বাবধানে পি-পি-পি মডেলে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। প্রতিবছর শুধু কম্পিউটারভিত্তিক পরীক্ষা বাবদ ভারতে ৭৫ কোটি মার্কিন ডলার (৬ হাজার কোটি সাড়ে ৩৭ লাখ টাকা) খরচ হয়। অন্যদিকে কাগজভিত্তিক সনাতন পরীক্ষায় সবমিলে খরচ হয় ১৬৫ কোটি মার্কিন ডলার।
সিঙ্গাপুর : সিঙ্গাপুরে কম্পিউটারভিত্তিক পরীক্ষা শুরু হয় ২০০৪ সালে ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরের উদ্যোগে। তাদের প্রায় ২০ বছরের অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, সহজতর পদ্ধতি, কম খরচ, নিরাপত্তা, তাৎক্ষণিকভাবে সমম্বিত ফলাফল প্রকাশ এবং অন্যান্য সঙ্গত কারণে পরীক্ষার্থী-পরীক্ষক ও প্রতিষ্ঠানগুলো এখন সনাতন পদ্ধতি বিমুখ।
অস্ট্রেলিয়া : গতবছর অস্ট্রেলিয়ার মোনাশ বিশ্ববিদ্যালয় তাদের শতকরা ৮০ ভাগ পরীক্ষা অনলাইনে নিয়ে ব্যয় কমিয়েছে ৭০ লাখ অস্ট্রেলীয় ডলার।
মালয়েশিয়া : মালেশিয়ার উচ্চমাধ্যমিক স্কুল পর্যায়ের পাবলিক পরীক্ষা নেওয়া হয় কম্পিউটারভিত্তিক পদ্ধতিতে। দেশটিতে কারিগরি শিক্ষা সংশ্লিষ্ট পরীক্ষার মাধ্যমও কম্পিউটারনির্ভর। কম্পিউটারভিত্তিক এ মাধ্যমে দেশটিকে প্রায় ১০ লাখ শিক্ষার্থী প্রতি বছর অংশ নেয়।
কম্পিউটারভিত্তিক পরীক্ষা পদ্ধতির উপকারিতা : কম্পিউটারভিত্তিক পরীক্ষা পদ্ধতিতে পরীক্ষার্থীদের দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসে নির্দিষ্ট পরীক্ষা কেন্দ্রে যোগ দিতে হয় না। এতে শিক্ষার্থীদের সময় ও অর্থের অপচয় কমে। ফলে শারীরিক ও মানসিক প্রশান্তি লাভ হয়। ভালভাবে প্রস্তুতি নিয়ে পরীক্ষায় আরও ফল অর্জনের সুযোগ বৃদ্ধি পায়। সার্বিক নির্ভরযোগ্যতা ছাড়াও কম্পিউটারভিত্তিক পরীক্ষা ব্যবস্থাপনা পদ্ধতিতে নেওয়া পরীক্ষার ৪টি উপকারিতা রয়েছে। ১. কম খরচ: কাগজ, মুদ্রণ, দক্ষ লোকবল, পরিকাঠামো ও পরিবহন খরচসহ অন্যান্য অপ্রত্যাশিত খরচের ঝুঁকি কম। ২. সময় বাঁচে: পরিকল্পনা, তফসিলীকরণ, সমন্বয়, মূল্যায়ন, ফলাফল প্রকাশ, ফলাফল বিশ্লেষণ ও সনদ প্রদানে সময় কম লাগে। ৩. নিরাপত্তা বৃদ্ধি: সি-আর-পি (সার্টিফাইড রিমোট প্রক্টর) ও এ-আই যৌথ নজরদারির কারণে প্রশ্নপত্র ফাঁস, ছদ্মবেশ ও নকলের ঝুঁকি কমে নিরাপত্তা জোরালো হয়।
কম্পিউটারভিত্তিক পরীক্ষা ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি শিক্ষা ব্যবস্থার আধুনিকায়নে আমূল পরিবর্তন নিয়ে আসবে। ফলস্বরূপ শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবকসহ সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থা লাভবান হবে।
লেখক :অধ্যাপক ড. সাজ্জাদ হোসেন, সদস্য, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) এবং পরিচালক, বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেড