করোনা নিয়ন্ত্রণে অনুসরণ করুন উহান মডেল - দৈনিকশিক্ষা

করোনা নিয়ন্ত্রণে অনুসরণ করুন উহান মডেল

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

সারা বিশ্বে যখন করোনাভাইরাসের কারণে প্রায় ১৫ হাজার ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে এবং ১৯২টি দেশে যখন প্রায় সাড়ে ৩ লাখ ব্যক্তি এতে আক্রান্ত হয়েছে, তখন এ প্যানডেমিক পরিস্থিতির পরিণতি অতি স্পষ্ট। বৃহস্পতিবার (২৬ মার্চ) যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।

নিবন্ধে আরও জানা যায়, এমন মুহূর্তে বাংলাদেশে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ৩৩ এবং মৃতের সংখ্যা ৩ হলেও এর বিস্তার জানতে আমাদের আরও ২ সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হবে। অবস্থাদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, সরকারে যারা উচ্চপর্যায়ে আছেন তারা যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে কাজটি করতে পারছেন না এবং এর ভয়াবহ প্রকৃতির বিষয়টি অনুধাবন করতে সক্ষম হচ্ছেন না।

বিদেশ ফেরত এবং তাদের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের ট্র্যাকিং, টেস্ট, আইসোলেশন বা কোয়ারেন্টিনের দায়িত্ব যাদের দেয়া হয়েছিল, তারা যথাযথ যোগ্যতার সঙ্গে তা করতে পারেননি।

এতে আগামী ১৪ দিন পর যদি দেশে করোনার সংক্রমণ এবং করোনায় মৃত্যুর হার বৃদ্ধি পায় বা নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বিদেশ ফেরতদের দেশে আনার কারণে দেশের সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তার দায়দায়িত্ব মুখ্য করোনা নিয়ন্ত্রক সংস্থার।

যারা যথাযথ টেস্ট, স্ক্রিনিং বা কোয়ারেন্টিন ছাড়া বিদেশ ফেরতদের নির্বিচারে জাতীয় বিমানে এনে ওই বিমানের সব আরোহী ও ক্রুসহ দেশের বিমানবন্দরের কর্মী ও গণমানুষকে ঝুঁকিতে ফেলল, তাদের বিশাল দায়টি বুঝতে হবে।

প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত ও অভিজ্ঞতার আলোকে এটি নিশ্চিতভাবে বলা যায়, করোনাভাইরাস নামক আরএএন ভাইরাস, যা কোল্ড ভাইরাস নামে পরিচিত, তা অত্যন্ত ছোঁয়াচে; এটি যেমন হাঁচি-কাশির মাধ্যমে মাইক্রোড্রপলেট আকারে ছড়ায়, তেমনি রোগীর ব্যবহার্য, পরিবেশে বিদ্যমান কাপড়, প্লাস্টিক, ধাতব ও অন্যান্য ফোমাইটের মাধ্যমে ছড়িয়ে থাকে।

মাইক্রোড্রপলেট আকারে বাতাসে ভাসমান ভাইরাস প্রায় ৩-৪ ঘণ্টা জীবিত থাকলেও ধাতব ও প্লাস্টিকসহ অন্যান্য ফোমাইটে আঠার মতো লেগে তা ৩ দিন পর্যন্ত টিকে থাকতে পারে। এ কারণে এটি প্রতিরোধে বহুমুখী ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন।

আক্রান্ত ব্যক্তির লক্ষণ যাচাই করে দ্রুত পরীক্ষায় এনে কোয়ারেন্টিনে আনা যেমন অবশ্য করণীয়, তেমনি আক্রান্তের সংস্পর্শে আসা প্রত্যেক ব্যক্তি, বস্তুসহ তার পরিপার্শ্বের একটি মূল্যায়ন প্রয়োজন। সংস্পর্শে আসা মানুষদের পরীক্ষাসহ তাদের আইসোলেশন এবং তাদের পারিপার্শ্বিক ডিজইনফেকশন প্রক্রিয়া অতি অপরিহার্য।

এ ক্ষেত্রে স্মরণ রাখা প্রয়োজন, ৬০ শতাংশ অ্যালকোহলের মতো সাবান ও ক্লোরিন দ্রবণ এ ভাইরাস মেরে ফেলতে পারে। তবে মনে রাখতে হবে, প্রতিটি ফোমাইটকে বা রোগীর সংস্পর্শে আসা বস্তুকে ৪ মিনিট ওই দ্রবণের সঙ্গে সংযুক্ত রাখতে হবে। ব্যবহৃত কাপড়গুলো সাবান দিয়ে সিদ্ধ করে ভাইরাসগুলো মেরে ফেলা যেতে পারে।

দরজার হাতল, পানির কলের নব, টয়লেট এবং গণপরিবহনের আসন ও হাতলগুলো ডিজইনফেক্ট করা অতি জরুরি। এর জন্য মাস্ক, ফিউমিগেশন; কোনো কোনো ক্ষেত্রে ইউভি রেডিয়েশন বা কোমল এক্স-রে কার্যকর হতে পারে।

তামার পাতের শিল্ড লাগানো হিটার ভাইরাস কমাতে সাহায্য করে- এটা আমি ২০০২-এ সার্স নিয়ে কাজ করার সময় দেখেছি। তাপমাত্রা ৬০-৭০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড হলে ভাইরাসের মৃত্যু হবে। ৪৪ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে এটি নির্জীব হবে এবং সংখ্যায় কমবে।

সব মিলিয়ে ব্যাপক সংক্রমণ রোধে সব ধরনের গণজমায়েত নিষিদ্ধ করা উচিত এখনই। সমাবেশ, গণপাঠদান থেকে শুরু করে নামাজের জামাত সবকিছুই নিষেধাজ্ঞার আওতায় আনতে হবে এখনই। সারা বিশ্বে যে সোশ্যাল ডিসট্যান্স ও আইসোলেশনের কথা বলা হয়েছে তা এখনই, আজ থেকেই দেশে কার্যকর করা উচিত।

এই ভাইরাসের জিনোমিক সিকোয়েন্সিংয়ের আলোকে কিছু ওষুধের কথাও ভাবা প্রয়োজন। জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র ও চীন যে কেউই এ ওষুধের ভ্যাকসিন তৈরি করুন না কেন, ৬ মাসের আগে এমন ভ্যাকসিন হাতে আসার সম্ভাবনা একেবারে নেই।

এ পরিপ্রেক্ষিতে সার্স ও ফ্লু চিকিৎসায় যে ওষুধগুলো ব্যবহার করা হয়েছে তার কিছু ওষুধ করোনা আক্রান্ত ব্যক্তিদের ওপর ব্যবহার করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে চীনের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের পরামর্শমতো ফ্যাভিপিরাভির দিয়ে রোগাক্রান্তদের চিকিৎসা শুরু করে প্রতিরোধ বৃদ্ধির জন্য বিটাকাপ্পা ইনহিবিটরগুলো, বিশেষ করে সেলিনিয়াম ও জিঙ্কের ব্যাপক ব্যবহার প্রয়োজন।

জিঙ্ক ডায়রিয়া ও নিউমোনিয়ায় মৃত্যুহার কমিয়ে আনে। এ ক্ষেত্রে হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন, যা আমি এইডস প্রতিরোধ সিডিসিকে একসময় ব্যবহার করতে বলেছিলাম, যা কিনা রিউমটয়েড আর্থ্রাইটিস রোগে ইমিউন মডুলেটের হিসেবে ব্যবহার করা হয়, তা করোনাভাইরাস সংক্রমণে প্রয়োগ করতে বলছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।

বয়স বিবেচনা করে নির্বাচিত ক্ষেত্রে চোখের রেটিনার সমস্যাটি বিবেচনায় এনে এটি ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে ঢালাওভাবে ব্যবহার করা কখনও নয়। যে বয়োবৃদ্ধ ব্যক্তি বাতরোগে ভুগছেন অথবা ইমিউনোডিফেসিয়েন্সিতে ভুগছেন, তাদের জন্য ইন্টারফেরন ও হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন কিছু কাজে আসতে পারে। এ সংক্রান্ত সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা বিবেচনায় আনা প্রয়োজন।

সার্বিকভাবে আইসোলেশন ও টেস্টের কোনো বিকল্প নেই। করোনা টেস্ট কিট হাতে না আসা পর্যন্ত ইনফ্লুয়েঞ্জার টেস্ট করে এক্সক্লুশন পদ্ধতিতে সিদ্ধান্তের কাছে আসা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে ইনফ্লুয়েঞ্জার ওষুধগুলো এবং কিছু ভাইরিসাইডাল কাজে আসতে পারে। আমাদের হাতে এমন কিছু ওষুধ রয়েছে।

ব্যাপকভাবে ফ্লু ভ্যাকসিন দেয়া প্রয়োজন। এটি ফ্লুজনিত মৃত্যু কমিয়ে আনবে। চিকিৎসক, নার্স ও জনগণের ব্যবহারের জন্য মাস্ক ও টোটাল প্রটেকশন পিপিই নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

এর অভাবে ২০ জন আক্রান্তের চিকিৎসায় ৭ জন চিকিৎসক করোনা দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে বলে জানা গেছে। এতে ডাক্তারের ঝুঁকির হার ১:৩। এটি অনেক বড় ঝুঁকি। এ ঋণ কীভাবে পরিশোধিত হবে! ডাক্তাদের প্রতি মানবিক হওয়া অতি প্রয়োজন।

এসব ক্ষেত্রে মনে রাখা উচিত প্রচলিত মাস্ক, যার ভেতরের ফুটোগুলো ২ মাইক্রোনের বেশি বা যেগুলো এন-৯৫ নয়, তার ব্যবহার কোনো সুফল বয়ে আনবে না। এটি পরিধানের পদ্ধতি রয়েছে। মাস্কের সঙ্গে সঙ্গে গ্লাভস ও চোখে চশমা পরা প্রয়োজন।

ডাক্তারদের প্রটেকটিভ গাউন, টুপি, জুতা, চশমা অত্যাবশ্যক। প্রতিটি হাসপাতালসহ রোগীর আস্তানা, গণসমাবেশের স্থানগুলো এবং বিমানসহ সব যানবাহন ব্যাপকভাবে ফিউমিগেশন করা প্রয়োজন এবং কিছুক্ষণ পরপর জীবাণুনাশক দিয়ে মুছে ফেলা জরুরি। গণসমাবেশের স্থানগুলোয় ডিসইনফেকটিংয়ের চেম্বার তৈরি করা যেতে পারে।

হাসপাতাল, ডাক্তাদের চেম্বার ও করোনার ছোঁয়া পাওয়া স্থানগুলোয় তামার শিল্ডযুক্ত হিটার ও ইউভি লাইটের সহায়তায় ভাইরাসের জন্য অসহনীয় পরিবেশ তৈরি করা প্রয়োজন। কেমিক্যালস ও ফিউমিগেশন তো আপন স্থানে রয়েছে।

বাড়িঘর, পরিধেয় বস্ত্র ও বিছানাগুলো কড়া রোদে দেয়া প্রয়োজন; যা কিছু ধৌত করা সম্ভব তা সাবান দিয়ে ধুয়ে ফেলা প্রয়োজন। ক্লোরিন দ্রবণ না পেলে ১ চামচ ব্লিচিং পাউডার, ১ লিটার সাবান ও ফিটকিরি দ্রবণে মিশিয়ে তা ডিজইনফেকশন কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে এটি ত্বকের জন্য নয়। এসব কাজে গ্লাভস পরতে হবে।

করোনা শনাক্তে কিট তৈরি করে গণস্বাস্থ্য ১৫ দিনের মধ্যে তা হাজির করবে- এটি একটি সুখবর। ব্যাপক টেস্টের জন্য কিট হাজির করা সরকারের আশু দায়িত্ব। অধিকতর আক্রান্ত দেশ থেকে ফেরত আসা সব ফ্লাইট বন্ধ করে দিয়ে এ পর্যন্ত আসা বিদেশ ফেরত এবং তাদের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করা প্রয়োজন এখনই।

সর্বোপরি আতঙ্ক, অজ্ঞতা, নির্বোধ বাচালতা পরিহার করে এ মহাদুর্যোগের নানামুখী আঘাত, জীবন ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি এবং আর্থিক দুর্যোগ বিবেচনায় এনে তা মোকাবেলায় সব শক্তি ও মেধা প্রয়োগ করতে হবে। আসুন চীনের উহান প্রতিরোধ মডেলটি আমরা অনুসরণ করি।

ডা. এম এ হাসান : ইমার্জিং ডিজিজ ও অ্যাজমা বিশেষজ্ঞ। ২০০২ সালে সার্স ও এইডস রোধে হংকং সরকার এবং এনআইএআইডির সহায়ক গবেষক ছিলেন।

উপবৃত্তির জন্য সব অ্যাকাউন্ট নগদে রূপান্তরের নির্দেশ - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সব অ্যাকাউন্ট নগদে রূপান্তরের নির্দেশ কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা - dainik shiksha সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা জাতীয়করণ আন্দোলনের শিক্ষক নেতা শেখ কাওছার আলীর বরখাস্ত অনুমোদন - dainik shiksha জাতীয়করণ আন্দোলনের শিক্ষক নেতা শেখ কাওছার আলীর বরখাস্ত অনুমোদন ১৭তম ৩৫-প্লাস শিক্ষক নিবন্ধিতদের বিষয়ে চেম্বার আদালত যা করলো - dainik shiksha ১৭তম ৩৫-প্লাস শিক্ষক নিবন্ধিতদের বিষয়ে চেম্বার আদালত যা করলো দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে তিন স্তরে সনদ বিক্রি করতেন শামসুজ্জামান, দুদকের দুই কর্মকর্তার সম্পৃক্ততা - dainik shiksha তিন স্তরে সনদ বিক্রি করতেন শামসুজ্জামান, দুদকের দুই কর্মকর্তার সম্পৃক্ততা স্মার্ট বাংলাদেশ নির্মাণ ও ‘বিশ্ব বই দিবস’ - dainik shiksha স্মার্ট বাংলাদেশ নির্মাণ ও ‘বিশ্ব বই দিবস’ শিক্ষার মান পতনে ডক্টরেট লেখা বন্ধ জার্মান পাসপোর্টে - dainik shiksha শিক্ষার মান পতনে ডক্টরেট লেখা বন্ধ জার্মান পাসপোর্টে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.010485887527466