করোনার কারণে গত বিশ মাস শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ছিল অবিচ্ছিন্ন নীরবতা। পরিস্থিতির উন্নতি হলে গত ১২ সেপ্টেম্বর সীমিত আকারে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হয়। প্রাণ ফিরে আসে শিক্ষাঙ্গন এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে। সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে এসএসসি পরীক্ষাও শুরু হয়েছে ১৪ নভেম্বর থেকে। দেশে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার আলাদা একটি গুরুত্ব রয়েছে। এটি শিক্ষার্থীদের জীবনে প্রথম পাবলিক পরীক্ষা। পরে প্রাথমিক সমাপনী এবং জুনিয়র সার্টিফিকেট পরীক্ষা যুক্ত হলেও এসএসসি পরীক্ষাকেই মূল পাবলিক পরীক্ষা মনে করা হয়। এই পরীক্ষাকে বিবেচনা করা হয় উচ্চ শিক্ষার প্রাথমিক সোপান হিসেবে। পরীক্ষার আগে শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের মধ্যে একটি আলাদা অনুভূতি কাজ করে। শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের পদচারণায় পরীক্ষা কেন্দ্রগুলোতে থাকে উৎসবমুখর পরিবেশ। এবার পরীক্ষার সময় কিংবা বিষয় সংখ্যা বিবেচনার চেয়ে করোনায় শিক্ষার্থীদের শিক্ষা জীবনে যে স্থবিরতা সৃষ্টি হয়েছিল, তা ভেঙে বের হওয়াই ছিল মূল উদ্দেশ্য।
২০২০ খ্রিষ্টাব্দের তুলনায় ২০২১ খ্রিষ্টাব্দে মোট পরীক্ষার্থী বেড়েছে ১ লাখ ৭৯ হাজার ৩৩৪ জন। এই বৃদ্ধির হার ৮ দশমিক ৭৬ শতাংশ। মোট শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বেড়েছে ১৫১টি আর কেন্দ্র বেড়েছে ১৬৭টি। এবার সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে শুধু তিনটি নৈর্বাচনিক বিষয়ে পরীক্ষা হচ্ছে। পরীক্ষার সময় দেড় ঘণ্টা। দেশে বেশ কয়েক বছর ধরে ফেব্রুয়ারিতে এসএসসি পরীক্ষা শুরু হতো। ২০২০ খ্রিষ্টাব্দে করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরুর আগেই এসএসসি পরীক্ষা শেষ হয়। করোনা ভাইরাসের কারণে দেড় বছর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় এবার নয় মাস পিছিয়ে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা নেয়া হচ্ছে। এবার পরীক্ষা দিচ্ছে ২২ লাখ ২৭ হাজার ১১৩ জন, গতবছর এই সংখ্যা ছিল ২০ লাখ ৪৭ হাজার ৭৭৯ জন। ২৮ নভেম্বরের মধ্যে শেষ হবে এসএসসি ও দাখিলের ব্যবহারিক পরীক্ষা। পরীক্ষা শেষ হওয়ার ত্রিশ দিনের মধ্যে ফল প্রকাশ করা হবে বলে জানিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তার অর্থ হচ্ছে ২০২১ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বরের মধ্যেই ফল প্রকাশিত হবে।
এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় নিয়মিত পরীক্ষার্থী হিসেবে অংশ নিচ্ছে ১৬ লাখ ৭০ হাজার ৩৮০ জন শিক্ষার্থী। তবে তাদের সঙ্গে নবম শ্রেণিতে নিবন্ধন করেছিল ১৯ লাখ ৪৮ হাজার ৫৬ জন। বাকি ২ লাখ ৭৭ হাজার ৬৭৬ জন বিভিন্ন কারণে পরীক্ষা দিচ্ছে না। অর্থাৎ এ পরীক্ষার জন্য নিবন্ধন করা শিক্ষার্থীর প্রায় ১৬ শতাংশই ঝরে পড়েছে। প্রতিবছর পরীক্ষা সামনে রেখে সব স্কুল ও মাদ্রাসায় নির্বাচনী পরীক্ষা নেয়া হয়। সাধারণত এ পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণদের পরীক্ষা দেয়ার জন্য ফর্ম পূরণের সুযোগ দেয়া হয় না। কিন্তু এ বছর নির্বাচনী পরীক্ষা হয়নি। তারপরও বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী বসছে না পরীক্ষায়। ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দের এসএসসি পরীক্ষায় নিয়মিত হিসাবে অংশ নিয়েছে ১৬ লাখ ৭০ হাজার ৩৮০ শিক্ষার্থী। আর তখন নবম শ্রেণিতে নিবন্ধন করেছিল ২২ লাখ ৮৭ হাজার ৩২৩ জন। অর্থাৎ বাকি ৫ লাখ ৪৭ হাজার ৩৮৬ জন বিভিন্ন কারণে পরীক্ষা দেয়নি। এটা নিবন্ধন করা শিক্ষার্থীর তুলনায় ২৪ শতাংশ ছিল। পরীক্ষা শুরুর পূর্বে সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষামন্ত্রী যে তথ্য প্রকাশ করেন, তাতে দেখা যায় গত বছরের তুলনায় এবার পরীক্ষার্থী বেড়েছে ১ লাখ ৭৯ হাজার ৩৩৪ জন। এটি আর একটি ঝামেলা ও উদ্বেগের বিষয়। পাবলিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণের পূর্বে টেস্ট বা প্রিটেস্ট পরীক্ষা নেয়া হয় প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে। সেখান থেকে অনেক শিক্ষার্থীদের বাদ দিয়ে যারা বোর্ড পরীক্ষায় নিশ্চিত পাস করতে তাদের পরীক্ষায় পাঠানো হয়। এটিও তো খুব একটি ভাল বিষয় নয়।
শিখন-শেখানোর চেয়ে পরীক্ষার মূল্য কিংবা গুরুত্বই যেন বেশি।প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী নয়টি শিক্ষাবোর্ডের মধ্যে সবচেয় বেশি ঝরে পড়েছে মাদ্রাসায়। মাদ্রাসা বোর্ডে ৩ লাখ ২১ হাজার ৭৭৯ জন রেজিস্ট্রেশন করলেও পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে ২ লাখ ৫১ হাজার ৫৬০ জন। বাদ যাচ্ছে ৭০ হাজার ২১৯ জন। এটা শতকরা হিসেবে ২১ দশমিক ৮২। সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের মধ্যে শীর্ষে আছে কুমিল্লা। বোর্ডটিতে ২ লাখ ৩৪ হাজার ৩৯২ জন রেজিস্ট্রেশন করলেও অংশ নিচ্ছে ১ লাখ ৯৮ হাজার ৮৯৪ জন। পরীক্ষা দিচ্ছেন ৩৫ হাজার ৪৯৮ জন অর্থাৎ ১৫ দশমিক ১৪ শতাংশ। সিলেট বোর্ডে এই হার ১৩ দশমিক ৯৪ শতাংশ। তৃতীয় স্থানে আছে যশোর বোর্ড যেখানে ১৩ দশমিক ৩২ শতাংশ শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে। চট্টগ্রাম বোর্ডে ১২.৬৯ শতাংশ, ঢাকা বোর্ডে ১২.৬৫ শতাংশ, বরিশাল ১২.২৭ এবং দিনাজপুর বোর্ডে ১০.৩৫ শতাংশ ঝরে পড়েছে। সাধারণ ৮টি বোর্ডে ঝরে পড়ার হার ১২.৭৫ শতাংশ আর সব মিলে ১৪.২৬ শতাংশ।পরীক্ষার পূর্বে একটি জাতীয় দৈনিকে একটি খবর ছাপা হয়েছে। দেশের ৯টি জেলায় করোনাকালের সংকটে সাড়ে সাত হাজার বাল্যবিবাহ সংঘটিত হয়েছে। দেশের ৬৪টি জেলা ও নগর-শহরাঞ্চলে বস্তি এলাকায় এসব মিলিয়ে সারা দেশের বাল্যবিবাহ পরিস্থিতি কী ভয়াবহ. তা সহজেই অনুমান করা যায়। ইউনিসেফের তথ্যমতে, চলতি দশকের মধ্যে আরও এক কোটি কিশোরীর বাল্যবিয়ের নিদারুণ ঝুঁকিতে বাংলাদেশ। ইউনিসেফ তথ্যমতে, বাংলাদেশ এখন বিশ্বের বাল্যবিয়েপীড়িত রাষ্ট্রসমূহের প্রথম ১০টির মধ্যে অষ্টম অবস্থানে রয়েছে। ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে এ পর্যন্ত পাঁচ দশকে এ দেশে বাল্যবিয়ে হয়েছে প্রায় ৩ কোটি ৮০ লাখ। আগামী এক দশক ধরে চলা বাল্যাবিবাহের শিকার হতে পারে প্রায় এক কোটি বাংলাদেশি কিশোরী। করোনাকালে দীর্ঘদিন দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের ওপর এর বিরূপ প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। দেশের প্রান্তিক এলাকার প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থী উপস্থিতির হার নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। এ বছরের জানুয়ারিতে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) প্রকাশিত এক জরিপে বলা হয়, করোনা পরিস্থিতির আগে দেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ২০.৫ শতাংশ। করোনাকালে এই হার বেড়ে হয়েছে ৪২ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি বেড়েছে অতি দারিদ্র্য। তিন গুণ বেড়ে এটি হয়েছে ২৮.৫ শতাংশ। ২০২০ খ্রিষ্টাব্দের ২ নভেম্বর থেকে ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত জরিপটি চালানো হয়। দারিদ্র্য বেড়ে যাওয়া আর স্কুলে শিক্ষার্থী না আসার মধ্যে একটি কো রিলেশন বিদ্যমান।
শিক্ষাখাতের সংশ্লিষ্ট নানা গবেষণায় দেখা যায়, স্বাভাবিক সময়েই প্রতি বছর প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করার আগে প্রায় ১৭ শতাংশ ও মাধ্যমিক শিক্ষা শেষ করার আগে ৩৭ শতাংশ শিক্ষার্থী ঝরে পড়ে। এর পেছনে অন্যতম কারণ দারিদ্র্য ও বাল্যবিয়ে। বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য বলছে দেশে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় পৌণে তিন কোটি এবং দেশে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় সাড়ে চার কোটি। এরই মধ্যে এই বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীর শিক্ষা জীবন ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেভ দ্য চিলড্রেনের এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, মহামারির কারণে বিশ্বে ৯৭ লাখ শিশুর হয়তো আর ক্লাসে ফেরা হবে না। যাদের অনেকে বাল্যবিয়ের শিকার হবে। জাতিসংঘের শিশু তহবিল ইউনিসেফ জুলাইয়ে এক গবেষণায় জানায়, কোভিড-১৯ এর কারণে বিশ্বব্যাপী অন্তত চার কোটি শিশু স্কুল শুরুর আগে প্রারম্ভিক শৈশবকালীন শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছে। আর্থিক সমস্যায় জর্জরিত পরিবারগুলোর মেয়েদের দ্রুত বিয়ে দেয়ার প্রবণতা বেড়েছে লক্ষণীয় হারে। পাশাপাশি পরিবারের চাহিদা মেটাতে হিমশিম খেয়ে শিশুদের দিয়ে কায়িক পরিশ্রম করাতে বাধ্য হচ্ছে অনেক পরিবার। এখন প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঝরে পড়া এবং বিদ্যালয়বিমুখ শিক্ষার্থীদের ফিরিয়ে আনতে বিভিন্ন সহশিক্ষামুলক কার্যক্রমে হাতে নেওয়া উচিত।
শুধু নৈর্বাচনিক তিনটি বিষয়ের পরীক্ষা হচ্ছে। তারপরও পরীক্ষার প্রথম দিনেই ১৮ হাজার ৮২০ জন অনুপস্থিত ছিল। দ্বিতীয় দিন অনুপস্থিত ছিল ২৩ হাজার ৫৫৩। এ ছাড়া অসদুপায় অবলম্বন করায় এদিন তিন পরীক্ষার্থীকে বহিষ্কার করা হয়েছে। আনন্দের মধ্যে আমাদের শিক্ষার বেদনাদায়ক দিক হচ্ছে এগুলো। পরীক্ষাগুলো হচ্ছে দেড় ঘণ্টার কিন্তু প্রশ্নপত্রে লেখা ২ ঘণ্টা ৩০ মিনিট। এ বিষয়ে বোর্ড কর্তৃপক্ষ বলছে, এসব প্রশ্নপত্র ছাপা হয় আগেই। কিন্তু করোনা সংক্রমণ বিবেচনায় দেড় ঘণ্টা পরীক্ষা নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। দৃষ্টিহীন, সেরিব্রাল পালসিজনিক প্রতিবন্ধকতা ও হাত না থাকা বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিক্ষার্থীরা শ্রুতিলেখক সাথে নিয়ে চলতি বছরের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারছে। এ ধরনের পরীক্ষার্থীদের ও শ্রবণ প্রতিবন্ধকতায় আক্রান্ত বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন পরীক্ষার্থীদের জন্য অতিরিক্ত ১০ মিনিট সময় বৃদ্ধি করা হয়েছে। অর্টিজম, ডাইন সিনড্রোম, সেরিব্রাল পালসিজনিত প্রতিবন্ধকতায় আক্রান্ত পরীক্ষার্থীদের জন্য অতিরিক্ত ২০ মিনিট সময় বাড়ানোসহ শিক্ষক অভিভাবক বা সাহায্যকারীর বিশেষ সহায়তায় পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ দেয়া হয়েছে। এগুলো হচ্ছে মানবিক দিক যার প্রতিফলন এ পরীক্ষায়ও দেখা যাচ্ছে। এভাবেই শত বাধা-বিপত্তির মধ্যেও মানুষের জীবন থেমে থাকে না। এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবে।
লেখক : প্রেসিডেন্ট, ইংলিশ টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইট্যাব)