করোনাকালেও থেমে নেই মামুনের পথচলা। গাঁয়ের মেঠোপথ ধরে বাড়ি বাড়ি ঘুরে মানুষের মাঝে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দেয়ার দায়িত্ব যেন আরও বেড়ে গেছে। করোনা সংক্রমণ থেকে রেহাই পেতে ঘরে স্বেচ্ছাবন্দীদের কাছে খুব সহজেই পৌঁছে দিচ্ছেন কাঙ্ক্ষিত বই। শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে নানান বয়সের পাঠকও বেড়েছে আগের তুলনায় অনেক। তারা ঘরে বসে পেতে চাইছেন বিভিন্ন ধরনের পছন্দের বই। শনিবার (২৬ সেপ্টেম্বর) জনকণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন শংকর লাল দাশ।
প্রতিবেদনে আরও জানা যায়, মামুন তাদের হাতে শুধু সে সব বই শুধু তুলে দিচ্ছেন না, দিচ্ছেন জ্ঞানের অপরিসীম ভান্ডারও। করোনা মহামারীর এ সময়ে দেশের অনেক ক্ষুদ্র ব্যবসা মার খেয়েছে। কিন্তু মামুনের বইয়ের চাহিদা এতটুকুও কমেনি। বরং বেড়েছে। অবসরে বহু মানুষ বইকেই অন্যতম সঙ্গী করে নিয়েছে। তাইতো বেড়েছে তার আয় রোজগারও। তাই বলে মামুন করোনা মহামারীকে পুঁজি করতে চাইছেন না। বলছেন-আবার সব স্বাভাবিক হয়ে ফিরে আসুক। দূর হয়ে যাক এ মহামারী।
বইয়ের মাধ্যমে জ্ঞানের আলো ছড়ানোর এ কাজ মামুনের এক দু’দিনের নয়। দীর্ঘ প্রায় তিন দশকের। দুই হাত আর কাঁধে ব্যাগ ভর্তি বইয়ের বোঝা নিয়ে ঘুরে বেড়ান এ গাঁ থেকে সে গাঁয়ে। সীতানাথ বসাকের আদর্শলিপি থেকে শুরু করে গল্প, কবিতা, উপন্যাস, ছড়া। সবই আছে তার ঝুলিতে। আছে একালের সেরা লেখকদের বই। এমনকি প্রাচীন আমলের ইতিহাসও। একটা সময়ে তার বইয়ের ক্রেতাদের বড় অংশ ছিল স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসার ছাত্রছাত্রী। কিন্তু করোনাকালে সে দৃশ্যপট অনেকটা পাল্টে গেছে। নিয়মিত পাঠকের তালিকায় এখন যোগ হয়েছে নানা শ্রেণী পেশা ও বয়সের মানুষ।
আলো ছাড়ানো এ মানুষটির পুরো নাম আবদুল্লাহ মোহাম্মদ মামুন। বয়স ৬০ বছর পেরিয়ে গেছে। পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার মদনপুরা গ্রামে জন্ম হলেও এখন গলাচিপার ফুলখালী গ্রামে স্থায়ী ভাবে বাস করেন। ১৯৭৪ সালে এইচএসসি পাস করেছেন। কয়েক বছর কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করেছেন। হঠাৎ পরিবারের সৎ ভাইদের সঙ্গে সম্পত্তি নিয়ে মামলা-মোকদ্দমায় জড়িয়ে পড়েন। তাতে সহায় সম্পদ চাকরি সব হারান। একদিন ভোলায় বেড়াতে গিয়ে একজন বই ফেরিওয়ালার সাক্ষাত পান। তার কাছ থেকে ব্যবসার খুঁটিনাটি শিখে নেন। এরপরই জড়িয়ে পড়েন বইয়ের মাধ্যমে আলো ছড়ানোর কাজে। ঢাকার বাংলাবাজার থেকে পাইকারি বই কেনেন। আর এ গাঁয়ে- সে গাঁয়ে ঘুরে তা বিক্রি করেন।
গত প্রায় তিন দশক ধরে মামুনের জীবন যেন বাঁধানো বইয়ের মতো অনেকটাই ছকে বাঁধা পড়েছে। বলেন, এক সময়ে প্রতিদিন সাত সকালে বইয়ের বোঝা নিয়ে স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসার উদ্দেশে বেরিয়ে পড়তাম। ক্লাসের ফাঁকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গেটে দাঁড়িয়ে বেচাবিক্রি করতাম। কিন্তু এখন সে রুটিন বদলে গেছে। করোনাকালে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। তাই সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত বাসস্ট্যান্ড কিংবা লঞ্চঘাট। পথচারী, বাসযাত্রীদের হাতে তুলে দেই রকমারি বই। বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত ঘুরে বেড়াই শহর-গাঁ গ্রামের বাড়ি বাড়ি। তিনি আরও বলেন, করোনার এ সময়ে পাঠক সংখ্যা অনেক বেড়েছে। মানুষ ঘরে স্বেচ্ছাবন্দী থাকছে। অবসরে অনেকেই হাতে তুলে নিচ্ছে নানান ধরনের বই। তবে আদর্শলিপি ও শিশুতোষ বই বেশি বিক্রি হচ্ছে। অভিভাবকরা শিশুদের ঘরে বসে সে সব পড়াচ্ছেন। পাশাপাশি বেড়েছে গল্প-উপন্যাসের পাঠক। তৈরি হয়েছে ইতিহাসেরও পাঠক।
কেমন বেচাবিক্রি কিংবা আয়? জিজ্ঞেস করতেই একগাল হেসে মামুন বলেন, মন্দ নয়। আগে দৈনিক সাত-আটশ’ টাকার বই বিক্রি হতো। এখন তা বেড়ে প্রায় দ্বিগুণে পৌঁছেছে। কোন কোন বইয়ে থাকছে অর্ধেকটাই লাভ। আরও বলেন, বই বিক্রি করেই ছেলেমেয়েদের মোটামুটি দাঁড় করাতে পেরেছি। বড় ছেলে মোজাহিদুল বিজিবিতে সৈনিকের চাকরি করেন। ছোট ছেলে মোস্তাফিজুর মৎস্য বিষয়ে ডিপ্লোমা করেছেন। একমাত্র মেয়ে মরিয়ম মালা ক্লাস এবছর এসএসসি পাস করেছে।
বর্তমান প্রজন্ম পাঠ্য বইয়ের বাইরে অন্য কোন ধরনের বই কিংবা পত্রপত্রিকা পড়তে চায় না, এমন অভিমত উড়িয়ে দিয়ে দীর্ঘ অভিজ্ঞতার বয়ান দিয়ে আবদুল্লাহ মোহাম্মদ মামুন বলেন, এটি একেবারেই ভুল ধারণা। বরং দেশে শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। সব বয়সের মানুষের মধ্যে পাঠের ক্ষুধাও বেড়েছে। তাদের হাতে বিষয় উপযোগী বই তুলে দেয়া গেলে এখনও দেশে প্রচুর পাঠক রয়েছে। আবদুল্লাহ মোহাম্মদ মামুন নিজেও পাঠক। নিয়মিত দৈনিক কেনেন এবং পড়েন। বলেন, পত্রিকা পড়ার অভ্যাস গড়ে উঠেছে ছোটবেলা থেকে।
মামুন বলেন, বইয়ের ব্যবসায় লাভের পাশাপাশি একটা আলাদা তৃপ্তি আছে। বই পড়ে মানুষ জ্ঞানে সমৃদ্ধ হয়। নিজেকে চিনতে-জানতে শেখে। এ পর্যন্ত কমপক্ষে ৩০ লাখ বই বিক্রি করেছি। মনে প্রাণে বিশ্বাস করি-এরমধ্যে দিয়ে বহু মানুষের ভেতরে আলো জ্বালাতে পেরেছি। করোনাকালে এ তৃপ্তি আরও বেড়েছে। তাইতো শারীরিক সীমাবদ্ধতা নিয়েও ঘুরে বেড়াই। যতদিন বেঁচে থাকব, ততদিনই বইয়ের জগতে ডুবে থাকতে চাই।