করোনাভাইরাস নিয়ে যখন সারা বিশ্ব জর্জরিত, তখন রাজনীতি নিয়ে আলোচনা বধিরের কানের কাছে পুঁথি পাঠের মতো মনে হয়। তবু মানুষের নিত্যকর্মের মধ্যে রাজনীতিও একটি। মৃত্যুশয্যায় শুয়েও রাজনীতি ছাড়ছেন না এমন অনেক মানুষের নাম আমার জানা। এই দেখুন, বিএনপির মহাসচিব মৃত্যুদূত করোনাভাইরাস নিয়েও রাজনীতি করতে চান। তিনি অবশ্য মৃত্যুশয্যায় শায়িত কেউ নন। কিন্তু করোনাভাইরাসের প্রকোপের দিনে তিনিও তো এই রোগে (খোদা না করুন) আক্রান্ত হতে পারেন। তিনি সেই ভয় উপেক্ষা করে করোনা নিয়ে রাজনীতি করছেন। শুক্রবার (২৭ মার্চ) কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।
নিবন্ধে আরও জানা যায়, সম্প্রতি মির্জা ফখরুল করোনাভাইরাস মোকাবেলায় ব্যর্থতার জন্য সরকারের তীব্র সমালোচনা করেছেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের আবার করোনার মতো ভয়াবহ জনশত্রুকে নিয়ে রাজনীতি না করার জন্য সবার কাছে আবেদন জানিয়েছেন। তিনি এই আবেদন জানালে কী হবে, তাঁকে নিয়ে তাঁর দলের মধ্যেও একটি গোষ্ঠী নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির চেষ্টা চালাচ্ছে বলে জানা গেছে।
এই গোষ্ঠী দেশ, জাতি ও মানবতার এই চরম বিপদের মুহূর্তের সুযোগ নিয়ে ওবায়দুল কাদেরকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদ থেকে সরাতে চান। সেই উদ্দেশ্যে তাঁরা ওবায়দুল কাদেরের বিরুদ্ধে নানা ধরনের বানোয়াট প্রচারণা চালাচ্ছেন। মাত্র কিছু দিন আগে ওবায়দুল কাদের নিশ্চিত মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে উঠেছেন। দুর্বলতা না সারতেই দল পরিচালনার কঠিন দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন। নেত্রী শেখ হাসিনা তাঁকে সর্বপ্রকার সাহায্য-সহযোগিতা দিচ্ছেন। কাদের নেত্রীর আস্থাভাজন সাধারণ সম্পাদক। বর্তমানে দেশ এবং সরকার এক মহা আপৎকালীন সময় পার করছে। এ সময় ব্যক্তিস্বার্থে যাঁরা দলের ঐক্যের ক্ষতি করছেন, তাঁরা জাতির এবং দেশেরও ক্ষতি সাধন করছেন। তাঁদের এই স্বার্থসিদ্ধির রাজনীতি থেকে মানবতার স্বার্থে নিবৃত্ত হওয়ার অনুরোধ জানাই।
মানব সভ্যতার যে মহাশত্রু আজ আমাদের দ্বারেও এসে উপস্থিত হয়েছে, তাকে রোখার জন্য ওবায়দুল কাদের রাজনীতি পরিহার করে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে যুদ্ধে নামার যে আবেদন জানিয়েছেন, সেই একই আবেদন জানিয়েছেন জাতিসংঘের মহাসচিব। তিনি বিশ্বের সর্বত্র যুদ্ধ বন্ধ করে (সম্ভবত মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকা ও ইসরায়েলের যুদ্ধ) মানব জাতিকে একযোগে করোনাভাইরাস বা কভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে সম্মিলিতভাবে প্রতিরোধে নামার আহ্বান জানিয়েছেন। লন্ডনের একটি কাগজ পরিহাস করে লিখেছে, এবার এই ডাকে ট্রাম্প এবং নেতানিয়াহুরও সাড়া না দিয়ে উপায় নেই। ডেথ দ্য লেভেলার কবিতাটি যাঁরা পড়েছেন, তাঁরা জানেন, করোনাভাইরাস মৃত্যুর মতোই বড় এক লেভেলার। তার কাছে রাজা-প্রজার কোনো ভেদ নেই।
এবার আসি বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুলের করোনা নিয়ে রাজনীতি করার কথায়। তিনি হয়তো ভেবেছেন সরকারের বিরুদ্ধে প্রচার চালানোর কোনো ইস্যু যখন নেই, তখন করোনা যত ডেডলি ভাইরাস হোক তাকে নিয়ে একটু রাজনীতি করলে আপত্তি কী? তখনো তিনি হয়তো জানতেন না, এই জনশত্রু তাঁদের কী মিত্রের কাজ করবে। আড়াই বছরের বেশি সময় আন্দোলনের হুমকি দিয়ে, ঐক্যফ্রন্ট করে নির্বাচনে অংশ নিয়ে, দেশে-বিদেশে গুরুতর অসুস্থতার গুজব ছড়িয়ে যে দলনেত্রীর জামিনে মুক্তি আদায়ে মির্জা সাহেবদের চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে, ‘যুবরাজ’ তারেক লন্ডনে বসে যে চক্রান্ত চালিয়ে সফল হননি, করোনাভাইরাস এক লহমায় সেই খালেদা জিয়ার জামিনে মুক্তি সম্ভব করে দিয়েছে। এবার মির্জা ফখরুল, মওদুদ সাহেবদের কি উচিত নয়, সংবাদ সম্মেলন ডেকে করোনাভাইরাসকে ধন্যবাদ জানানো!
করোনার এই করুণার কাছে বিএনপি-জামায়াতের চিরজীবন কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। অনেকেরই সন্দেহ নেই, করোনার ভয়াবহ প্রকোপে উচ্চ আদালতের মাননীয় বিচারপতিদের এই জামিন দান বিবেচনা করতে হয়েছে। বেগম জিয়ার গুরুতর অসুস্থতার অনেকটা বানোয়াট আবেদন তাঁরা সম্ভবত বিবেচনা করেননি। করোনাভাইরাস জেলে বন্দি খালেদা জিয়াকে আক্রান্ত করতে পারে, সম্ভবত এই বিবেচনাতেই তাঁর এই আকস্মিকভাবে ছয় মাসের জন্য জামিনে মুক্তি লাভ।
তবে তাঁকে এই জামিন দেওয়া হলেও মুক্তিলাভের এই ছয় মাস তাঁকে ঘরে থাকতে হবে। বাইরে বেরোতে পারবেন না। এই আদেশটা খালেদা জিয়ার জন্য মঙ্গলজনক। বিশ্বের উন্নত-অনুন্নত সব দেশের মানুষকে রোগ সংক্রমণ থেকে বাঁচানোর জন্য আইসোলেশনে থাকা বা স্বেচ্ছায় গৃহবন্দি থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এই আইসোলেশন বেগম জিয়ার জন্য দরকার। অবশ্য তিনি ঘরে বসেও রাজনীতি করতে পারেন। তাঁর দলীয় নেতা ও কর্মীরা নেত্রীকে অতি ভক্তি দেখাতে, রাজনৈতিক উপদেশ গ্রহণের জন্য তাঁর চারপাশে এসে ভিড় জমাতে পারেন। এটা যদি হয় তাহলে দলের নেতাকর্মীরাই তাদের নেত্রীর গুরুতর অমঙ্গলের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারেন। মির্জা ফখরুল, মওদুদ সাহেবদের কাছে এটা আমার সতর্কবাণী, নেত্রীর ভালো চাইলে চারপাশে গিয়ে তাঁর জীবন বিপন্ন না করে দলীয় রাজনীতি মুলতবি রেখে যেন মানবতার এই ভয়াবহ শত্রু কভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে তাঁরা সম্মিলিত সংগ্রামে নামেন।
আরো একটি প্রসঙ্গে আসি। সম্প্রতি ঢাকা-১০, বাগেরহাট-৪ ও গাইবান্ধা-৩ আসনে জাতীয় সংসদের উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে বিশেষ করে করোনা মহামারির পদচারণের শুরুতে এই উপনির্বাচন স্থগিত রাখা উচিত ছিল। বিএনপি কোনো সংগত দাবি জানালেও তা অগ্রাহ্য করতে হবে এই মনোভাব ভালো নয়, গণতান্ত্রিকও নয়, এই উপনির্বাচন অনুষ্ঠান যে কতটা অনুচিত ছিল তার প্রমাণ ঢাকা-১০ কেন্দ্রে বিপুল হারে ভোটদাতাদের অনুপস্থিতি। এই কেন্দ্রে ভোটদাতার সংখ্যা তিন লাখ ২১ হাজার ২৭৫। আওয়ামী লীগ প্রার্থী জয়ী হয়েছেন মাত্র ১৫ হাজার ভোট পেয়ে। বিএনপি প্রার্থী পেয়েছেন আট শর মতো ভোট। ১৫ ভোট পেয়েছেন এমন প্রার্থীও এই কেন্দ্রে আছেন। বাগেরহাট-৪ ও গাইবান্ধা-৩ আসনে উপস্থিত ভোটদাতাদের সংখ্যা ভালো। কিন্তু আশানুরূপ নয়।
নির্বাচন কমিশনের উচিত ছিল বিশ্ব পরিস্থিতি এবং দেশের অবস্থা বিবেচনা করে আগেই এই তিন কেন্দ্রসহ অন্যান্য নির্বাচন (যেমন: চট্টগ্রামের মেয়র নির্বাচন) ও উপনির্বাচন মুলতবি রাখা। কিন্তু পরবর্তী নির্বাচন তারা স্থগিত করেছে প্রথম তিনটি উপনির্বাচনের অবস্থা দেখার পর। নির্বাচন কমিশনের কাছে মানুষ নিরপেক্ষতা, দক্ষতা ও দায়িত্বশীলতা আশা করে। সাম্প্রতিক উপনির্বাচনগুলোতে সেই দায়িত্বশীলতা নির্বাচন কমিশন দেখাতে পারেনি। এটা তাদের জন্য এবং দেশের জন্যও দুর্ভাগ্যজনক।
নির্বাচন কমিশনের এই সাম্প্রতিক ভ্রান্তি বিএনপিকে কমিশনের অশোভন সমালোচনা করার সুযোগ এনে দিয়েছে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল এই সুযোগ গ্রহণে দেরি করেননি। তিনি যে তিনটি কেন্দ্রে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, তা বাতিল করে আবার নির্বাচন করার দাবি জানিয়েছেন এবং বলেছেন, নির্বাচন কমিশন ক্লাউনে পরিণত হয়েছে। প্রথম কথা, দেশে করোনাভাইরাসের এই দ্রুত বিস্তারের সময় তিনটি কেন্দ্রে উপনির্বাচন আবার অনুষ্ঠান কি বাস্তবতাসম্মত? যে কারণে উপনির্বাচনে ভোটদাতারা আসেননি। সেই কারণটি তো এখনো বিদ্যমান। অর্থাৎ করোনার বিস্তার। মির্জা ফখরুল দায়িত্বশীল রাজনীতিক হলে তিনটি কেন্দ্রের অনুষ্ঠিত উপনির্বাচন বাতিল করার দাবি জানালেও বেশ পরে সময় ও সুযোগমতো তা অনুষ্ঠানের দাবি জানাতেন। এই মহামারির সময়টা কি নির্বাচন বা উপনির্বাচন অনুষ্ঠানের অনুকূল? দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের নেতা হয়েও মির্জা ফখরুল এটুকু বিবেচনা বুদ্ধির পরিচয় দেখাতে পারলেন না?
মির্জা ফখরুল নির্বাচন কমিশনকে ‘ক্লাউন’ বলেছেন। একটি জাতীয় সংস্থার বিরুদ্ধে এই ধরনের ভাষা ব্যবহার কোনো রাজনৈতিক দলেরই উচিত নয়। নির্বাচন কমিশন তাদের দায়িত্ব পালনে দায়িত্ববোধের পরিচয় দিতে ব্যর্থ হতে পারে, কিন্তু তারা ‘ক্লাউন’ নয়। এই ক্লাউন আছে মির্জা ফখরুলের নিজের দলেই। একজন নন, একাধিক ক্লাউন। একজনের পরিচয় দিচ্ছি।
বিএনপির বর্তমান নেতৃত্বে মির্জা ফখরুলের পরেই রুহুল কবীর রিজভী সাহেবের স্থান। ‘যুবরাজ’ তারেকের নিজস্ব লোক হিসেবে দলে হয়তো তাঁর স্থান মির্জা ফখরুলেরও ওপরে। তিনি প্রায়ই দলের নীতিনির্ধারক বক্তব্যও দেন। কেউ কেউ বলেন, তিনি লন্ডন থেকে প্রেরিত ‘ওহির’ও বাহক। এই রিজভী সাহেব তাঁর নেত্রীর জামিনে মুক্তি লাভে আনন্দে গদগদ হয়ে যা বলেছেন তা নিজ কানে না শুনলে বিশ্বাস করতে পারতাম না। সোশ্যাল মিডিয়ার সৌজন্যে তাঁর বক্তব্য নিজ কানে শোনার এবং তাঁকে জনসমক্ষে বক্তৃতাদানরত অবস্থায় দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে।
জনসমক্ষে দাঁড়িয়ে তিনি তাঁর নেত্রীর মুক্তি হয়েছে বলতে গিয়ে বলেছেন, তাঁর মৃত্যু হয়েছে। মৃত্যু হয়েছে বলেই আবার তোতলাতে তোতলাতে বলেছেন মুক্তি হয়েছে।
তিন-তিনবার এই ভুলটি তিনি করেছেন। খালেদা জিয়ার মৃত্যু তাঁর অতি বড় শত্রুও এখন কামনা করে না। কিন্তু রিজভী তিন-তিনবার তাঁর মৃত্যু হয়েছে বলা সত্ত্বেও তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেননি। শুধু ক্লাউনের মতো তোতলাতে তোতলাতে মৃত্যু বলার সঙ্গে সঙ্গে আবার মুক্তি কথাটি উচ্চারণ করেছেন। কারো বিশ্বাস না হলে সোশ্যাল মিডিয়ায় ধারণ করা তাঁর ছবি দেখতে পারেন, বক্তব্য শুনতে পারেন।
এ ধরনের একই ভুল করেছিলেন লন্ডনে তারেক রহমানের এক সভায় বিএনপির আরেক ক্লাউন। জিয়াউর রহমানের জন্মদিনের সভায় এই স্থানীয় বিএনপি নেতা বক্তৃতা করতে গিয়ে তাঁদের প্রিয় নেতাকে দেশপ্রেমিক বলতে গিয়ে বারবার বলেছেন দেশদ্রোহী। কয়েক বছর আগের কথা। এটাও সোশ্যাল মিডিয়ায় ধারণ করা আছে। বক্তার মুখ থেকে এমন সত্যটা কী করে বেরিয়ে এসেছিল, সেটাই ছিল বিচার্য।
করোনাভাইরাস বিশ্বের সব দেশের সঙ্গে বাংলাদেশেও মহামারির মতো দেখা দিয়েছে। খালেদা জিয়ার মতো সারা বিশ্বের মানুষই এখন গৃহবন্দি। এই গৃহবন্দি অবস্থা থেকে সারা বিশ্বকে বাঁচাতে হলে একাত্ম-মানবতার সম্মিলিত যুদ্ধ দরকার। নইলে এই মহাবিপর্যয় থেকে বিশ্ব মানবতা রক্ষা পাবে কি না সন্দেহ। এই মহামারি নিয়ে রাজনীতি করা শুধু অন্যায় নয়, চরম অপরাধ। তা হবে বিশ্ব মানবতার সঙ্গে শত্রুতা করা।
লেখক : আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী।