করোনার জন্য প্রস্তুতি : মুহম্মদ জাফর ইকবাল - দৈনিকশিক্ষা

করোনার জন্য প্রস্তুতি : মুহম্মদ জাফর ইকবাল

মুহম্মদ জাফর ইকবাল |

বেশ কিছুদিন থেকেই আমরা করোনাভাইরাসের কথা বলে আসছিলাম। আমি বিষয়টাকে কতটুকু গুরুত্ব দেব বুঝতে পারছিলাম না। সাংবাদিকরা এক-দু'বার আমাকে করোনাভাইরাস নিয়ে কী করা উচিত, সেটা জিজ্ঞেস করেছেন। আমি যথেষ্ট বিনয় সহকারে বলেছি- আমি এই বিষয়ের বিশেষজ্ঞ নই; কিছু একটা বলে ফেলা উচিত হবে না। জনস্বাস্থ্য নিয়ে যারা কাজ করেন, তারা কী বলেন সেটাই আমাদের শোনা উচিত।

এ রকম সময়ে আমার কাছে একটা গ্রাফ এসে পৌঁছেছে। এটা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের সংখ্যার একটা প্লট। বিভিন্ন দেশের তথ্য দেওয়া আছে এবং আমি অবাক হয়ে দেখলাম, সব দেশের রোগী বেড়ে যাওয়ার হার হুবহু এক। শুধু তাই নয়, ইতালির সঙ্গে তুলনা করে দেখানো হয়েছে পৃথিবীর কোন দেশ ইতালি থেকে কত দিন পিছিয়ে আছে এবং সেই দেশগুলোর অবস্থা কত দিনের ভেতর ইতালির মতো ভয়াবহ হয়ে যাবে। আমি একটু বিস্ময় নিয়ে আবিস্কার করেছি, সত্যি সত্যি তা-ই ঘটতে শুরু করেছে। একটুখানি চিন্তা করার পর বুঝতে পেরেছি- আসলেই তো এটাই ঘটার কথা। করোনাভাইরাসটি অসম্ভব ছোঁয়াচে এবং তথ্য অনুযায়ী, আনুমানিক গড়ে ছয় দিনের ভেতর করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে যেতে পারে। এভাবে বেড়ে যাওয়ার হারটার নাম 'এক্সপোনেনশিয়াল', বাংলায় 'জ্যামিতিক হার'। বিজ্ঞান করতে গিয়ে এই গাণিতিক প্রক্রিয়াটি আমাকে অসংখ্যবার ব্যবহার করতে হয়েছে; কিন্তু মজার ব্যাপার, সবসময়ই এটা ব্যবহার করা হয়েছে কমে যাওয়ার জন্য। যখনই গাণিতিক সমাধানে এভাবে বেড়ে যাওয়ার সমাধান এসেছে, আমরা যুক্তি দিয়েছি- এটি বাস্তব সমাধান নয় এবং সেই সমাধানটিকে আক্ষরিক অর্থে ছুড়ে ফেলে দিয়েছি। এই প্রথমবার আমি বাস্তব জীবনে একটা উদাহরণ দেখতে পাচ্ছি, যেটা ছুড়ে ফেলে দেওয়া যাচ্ছে না এবং আমাদের মেনে নিতে হচ্ছে।

এক্সপোনেনশিয়াল কিংবা জ্যামিতিক হারে বেড়ে যাওয়া একটি খুবই বিপজ্জনক বিষয়। প্রথমে যখন করোনাভাইরাসের সংক্রমণ হয়, তখন আলাদা বা বিচ্ছিন্নভাবে এক-দুটি রোগী পাওয়া যায়। তাদের যদি ঠিকভাবে কোয়ারেন্টাইন করে সারিয়ে তুলে নেওয়া যায়, তাহলে করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণের মাঝে থাকে। একবার যদি কোনোভাবে এটা এক্সপোনেনশিয়াল বা জ্যামিতিক হারে বাড়তে থাকে, তখন সেটাকে থামানোর কোনো উপায় নেই। শুধু চীন সেটা করতে পেরেছে, ইউরোপের কোনো দেশ পারেনি। সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান, হংকং- এই দেশগুলো খুবই বুদ্ধিমানের মতো সময়মতো কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে করোনাভাইরাসকে জ্যামিতিক হারে বাড়তে দেয়নি। সারা পৃথিবীতে এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন দায়িত্বহীন দেশ হিসেবে পরিচিত হয়েছে। আমরা এখন আমাদের চোখের সামনে এই দুটি দেশকে সময়মতো সঠিক সিদ্ধান্ত না নেওয়ার ফল ভোগ করতে দেখব।

করোনাভাইরাস এখন আর একটি নির্দিষ্ট দেশের সমস্যা নয়। এখন এটি সারা পৃথিবীর সমস্যা। সব দেশের করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীদের সংখ্যা প্রতিদিনই তথ্যভাণ্ডারে জমা হচ্ছে এবং সবাই সেটা দেখতে পাচ্ছে। তবে একজন সত্যি সত্যি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে কিনা, সেটা জানতে হলে একটা জটিল এবং খরচসাপেক্ষ পরীক্ষা করতে হয় (খবরের কাগজে দেখেছি, আমাদের দেশে এই পরীক্ষা করার উপযোগী কিট রয়েছে মাত্র হাজারখানেক)। কাজেই এ দেশে এখন খুব ব্যাপকভাবে পরীক্ষা করা সম্ভব বলে মনে হয় না। তাই এ দেশের জন্য আমরা যে সংখ্যাটি দেখছি, তার বাইরেও করোনাভাইরাস আক্রান্ত কেউ আছে কিনা, সেটা নিয়েও একটু দুর্ভাবনা থেকে যায়। এই দুর্ভাবনাটা বিশেষ করে শুরু হয়েছে, যখন আমরা দেখতে পাচ্ছি করোনাভাইরাসের উপসর্গ থাকা রোগী হাসপাতাল থেকে পালিয়ে যাচ্ছে কিংবা বিদেশ থেকে আসা যাত্রীরা বিক্ষোভ করে কোয়ারেন্টাইন কেন্দ্র থেকে বের হয়ে যাচ্ছে। এই অবিবেচক মানুষ এবং তাদের আত্মীয়স্বজন দেশের কোনো একটি প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিস্টেম্ফারকের মতো করোনাভাইরাসের রোগী জমা করে যাচ্ছেন কিনা, সেটি কে বলবে? এ ধরনের সবার অজান্তে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন স্টেটে। যখন সবাই ধরে নিয়েছে সেখানে মাত্র অল্প কয়েকজন করোনা আক্রান্ত রোগী, তখন সেখানে কয়েক হাজার মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে বসে আছে। হঠাৎ করে অনেক মানুষ মারা যেতে শুরু করেছে।

আমি এই বিষয়ের বিশেষজ্ঞ নই; তবে গণিত, বিজ্ঞান বা পরিসংখ্যান দিয়ে দেখানো সংখ্যা বিশ্নেষণ করতে পারি এবং সেটাই করার চেষ্টা করছি। গত কয়েকদিন এ বিষয়টি নিয়ে লেখাপড়া করে মোটামুটি নিশ্চিত হয়েছি যে, 'আমাদের কিছুই হবে না, সবকিছু নিয়ন্ত্রণের মাঝে আছে এবং সবকিছু নিয়ন্ত্রণের মাঝে থাকবে'- এটা ধরে নেওয়া মোটেও ঠিক নয়। আমাদের দেশ গরম ও জলীয় বাষ্প বেশি; তাই এ দেশে করোনাভাইরাস টিকতে পারে না- সেটা ভেবে নিশ্চিন্তে থাকাও মনে হয় ঠিক হবে না। কারণ মালয়েশিয়ার তাপমাত্রা এবং জলীয় বাষ্পের পরিমাণ আমাদের দেশের মতোই; কিন্তু সেখানেও করোনাভাইরাস ছড়িয়ে যাচ্ছে। কাজেই আমাদের প্রস্তুতি নিতে হবে। সময়মতো সাহসী এবং সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরাও 'হ্যান্ড স্যানিটাইজার' তৈরি করছে, সেটা চমৎকার একটা ব্যাপার। একজন মানুষ বিদেশ থেকে এসে কোয়ারেন্টাইনে সময় না কাটিয়ে বাড়িতে চলে এসেছে, সে জন্য গ্রামের মানুষ তার বাড়ি ঘেরাও করে ফেলেছে- সেটাও একটা ভালো লক্ষণ। বোঝা যাচ্ছে, মানুষ এ ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন। স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটিগুলোও সময়মতো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর অসংখ্য অনুষ্ঠান কোনোরকম ভাবাবেগ ছাড়াই মুহূর্তের মাঝে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, সেটি অনেক বড় দায়িত্বশীল একটি ঘটনা। এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীরা বিদেশ থেকে আসছে; তাই সব ফ্লাইটও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। যেহেতু এই পৃথিবীতেই অনেক দেশ করোনাভাইরাসের সংক্রমণ সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে, তাই চাইলে আমরাও নিশ্চয়ই পারব। একটা ঘূর্ণিঝড়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশ তছনছ হয়ে যায়; কিন্তু আমরা ঠিকই সেটা সামলে উঠে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে যাই। তবে 'আমরা কিছুই করব না, নিজে নিজেই সবকিছু নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে'- সেটা কেউ যেন বিশ্বাস না করে। সামনের কয়েক সপ্তাহ খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা সময়, এ সময়ে জাতি হিসেবে কতটুকু দায়িত্বশীল- তার একটা প্রমাণ আমরা পেয়ে যাব।

সারা পৃথিবী যখন একটা বিপদের সম্মুখীন, তখন আমরা নিরাপদে থাকব; সেটা কেউ আশা করে না। তবে এই ভাইরাসে শতকরা ৮০ জনের উপসর্গ হয় খুবই সামান্য। বিশেষ করে অল্প বয়সী শিশুদের বিশেষ কোনো সমস্যা হয়েছে বলে শোনা যায়নি। কাজেই আতঙ্কের কোনো বিষয় নেই; তবে অবশ্যই সতর্কতা এবং প্রস্তুতির বিষয় আছে। প্রস্তুতিটির কথা সবাই জানে, সেটি হচ্ছে- সামাজিকভাবে নিজেকে পুরোপুরি আলাদা করে ফেলা।

আমরা জানি, ইউরোপের দেশগুলোয় করোনাভাইরাস ভয়াবহভাবে ছড়িয়ে পড়ছে। সেখানকার একজন গবেষকের লেখার একটি অংশ এ রকম : 'করোনাভাইরাস তোমার দিকে এগিয়ে আসছে। এটি ছুটে আসছে এক্সপোনেনশিয়াল গতিতে। প্রথমে ধীরে ধীরে, তারপর হঠাৎ করে। এটি আর মাত্র কয়েকদিনের ব্যাপার কিংবা বড়জোর কয়েক সপ্তাহের। যখন এটি আসবে তখন তোমার হাসপাতাল, ক্লিনিক থমকে যাবে। তোমার দেশের মানুষের তখন চিকিৎসা হবে হাসপাতালের মেঝেতে, করিডোরে। অতি পরিশ্রমে ক্লান্ত এবং বিধ্বস্ত হয়ে যাবে ডাক্তার-নার্স। অনেকে মারা যাবে। তাদের তখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে, কাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য অক্সিজেন দেবে আর কাকে মারা যেতে দেবে। এই ভয়াবহ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের একটিমাত্র উপায়, সেটা হচ্ছে- আজকেই নিজেদের সামাজিকভাবে আলাদা করে ফেলা। আগামীকাল থেকে নয়। আজকেই। তার অর্থ হচ্ছে, যত বেশি মানুষকে সম্ভব ঘরের ভেতর রাখা। এখন থেকেই!'

আমরা চাই, আমাদের অবস্থা যেন ইউরোপের মতো না হয়। আমরা যেন এই বিপর্যয় ঠিকভাবে কাটিয়ে উঠতে পারি।

১৮ মার্চ ২০২০

লেখক: মুহম্মদ জাফর ইকবাল, সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ।

ভিকারুননিসায় ৩৬ ছাত্রী ভর্তিতে অভিনব জালিয়াতি - dainik shiksha ভিকারুননিসায় ৩৬ ছাত্রী ভর্তিতে অভিনব জালিয়াতি ‘চার আনা’ উৎসব ভাতা: প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সমীপে - dainik shiksha ‘চার আনা’ উৎসব ভাতা: প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সমীপে মাকে ভরণপোষণ না দেয়ায় শিক্ষক গ্রেফতার - dainik shiksha মাকে ভরণপোষণ না দেয়ায় শিক্ষক গ্রেফতার ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন - dainik shiksha ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে - dainik shiksha জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা - dainik shiksha রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0034580230712891