করোনার মহাসঙ্কটে থমকে আছে গোটা দুনিয়া। আক্রান্ত এবং মৃত্যুর হার এখনও কোন আশার আলো দেখাতে ব্যর্থ হচ্ছে। তবে সুস্থতার হার আশাব্যঞ্জক। এমন চিত্র বাংলাদেশসহ সারা পৃথিবীর অবরুদ্ধতার বেড়াজালে শিথিলতা দৃশ্যমান হলেও সংক্রমণের উর্ধগতিতে বিশ্ব দিশেহারা। নিরাময়ের যথার্থ ওষুধ এবং প্রতিষেধক ব্যতিরেকে বহুল সংক্রমিত এই ব্যাধিকে সামলানোও কঠিন হয়ে পড়েছে। বয়স্ক মানুষ যারা অন্যান্য জটিল রোগে ইতোমধ্যে আক্রান্ত তাঁদের করোনা ঝুঁকি সর্বাধিক এমনকি প্রাণঘাতীও বটে। সারাবিশ্বের চিকিৎসক, বিশেষজ্ঞ ও বিজ্ঞানীরা নিত্য জোর গবেষণা কর্ম অব্যাহত রেখেছেন এই রোগকে নিয়ন্ত্রণে আনতে। মঙ্গলবার (৮ সেপ্টেম্বর) জনকণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।
নিবন্ধে আরও জানা যায়, বাংলাদেশ দীর্ঘ ৬ মাস ক্রান্তিকাল পার করে এখন ক্লান্ত-অবসন্ন। তবুও থেমে থাকার সুযোগ আর নেই। সমস্ত শঙ্কা, শঙ্কুল পরিস্থিতি মোকাবেলা করে অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখা এই মুহূর্তে সময়ের দাবি। সরকারসহ সংশ্লিষ্টরা শুধু উদ্বিগ্নই নয় তার চেয়েও বেশি দুঃসহ যাত্রাপথ পাড়ি দিতে সর্বদা সচেষ্ট। পরিশ্রমী মানুষেরা তাদের শ্রম সাহস আর কর্মক্ষম উদ্যমে সম্মুখ সমর পার করতে এগিয়ে যাচ্ছে। কোন এক সময় অকুল সাগরেও পথ খুঁজে পাওয়া যাবে নতুন সম্ভাবনায়। কিন্তু শিক্ষার মতো অতি প্রাসঙ্গিক খাতটির বিপন্ন অবস্থা কাটানো শুধু সময়ের ব্যাপার নয় অগণিত শিক্ষার্থীর ভাবী জীবনের আলোকিত অধ্যায়টিও আটকা পড়ে আছে। সেই ১৭ মার্চ থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের লাগাতার ছুটির ঘোষণা চলতি মাসে শেষ হবে কিনা সেটাও ভাবা কঠিন। প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের জীবনে যে স্থবিরতার কালো থাবা বসেছে সেখান থেকে কবে মুক্তি পাবে তা ধারণারও অতীত। আর উচ্চ শিক্ষা তার সম্ভাবনাময় জ্ঞান চর্চা থেকে বিচ্যুত করে অবসরে, গৃহবন্দী অবস্থায় দুঃসহ সময় পার করছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া এক অসম্ভবের পর্যায়ে। ক্ষুদে শিক্ষার্থীরা আদৌ সামাজিক দূরত্ব মেনে জীবাণুনাশক অবস্থাকে কতখানি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে তা এখনও বিবেচনাধীন।
মাধ্যমিক বোর্ড পরীক্ষা করোনার মধ্যেই শেষ করা গেলেও আর কোন উত্তরণ পর্বের কার্যক্রম শুরুই করা যায়নি। আবার দেরিতে হলেও মাধ্যমিক ফলাফল অনলাইন আর মোবাইলে পেশ করা হলেও ভর্তি নিয়ে পড়ে এক বেহালদশায়। প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের সংসদ টিভি এবং বেতারের মাধ্যমে পাঠদান কর্মসূচী শুরু হলেও তা যে সর্বজনীন হয়নি সেটাও দৃষ্টিকটুভাবে প্রত্যক্ষ হয়েছে। মূল সমস্যা কিন্তু শুধু শিক্ষার্থীদের নিয়ে নয় বরং শিক্ষকরাও এই নতুন ধরনের পাঠক্রমের সঙ্গে আগে পরিচিত ছিল না। যদিও উন্নত দেশগুলোতে অনলাইনভিত্তিক কার্যক্রমের ধারায় শিক্ষক ও শিক্ষার্থী উভয়েই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে।
এই কথা সহজেই অনুমেয় নতুন কোন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অস্থির সময়ের তাৎক্ষণিক উপস্থাপনের কোন বিষয় হতে পারে না। এর জন্য ধারাবাহিক প্রক্রিয়া, প্রশিক্ষণ ছাড়াও উন্নত মানের যান্ত্রিক ব্যবস্থার সংযোজনও অত্যাবশ্যক। এসবের অনুপস্থিতিতে এই অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম যা হওয়ার তাই হয়েছে। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ইন্টারনেট সেবার অপ্রতুলতায় অনেকেই এই পাঠদান কর্মসূচী থেকে বিচ্ছিন্ন থেকেছে। গ্রামাঞ্চলে অনেকের বাসায় টিভি থাকলেও সংসদ টিভি আসে না যান্ত্রিক কলাকৌশলের অভাবে। আবার হতদরিদ্র অনেকের ঘরে টিভি পর্যন্ত নেই। এর আগে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম সমতাভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণে বাংলাদেশকে বিশ্বের ৪৭তম এবং দক্ষিণ এশিয়ায় শীর্ষে নিয়ে এসেছে। তার মধ্যে চমকৃত হওয়ার ব্যাপারটি সমতাভিত্তিক প্রাথমিক শিক্ষায় বাংলাদেশ বিশ্বের ১ নম্বরে।
অর্থাৎ ক্ষুদে প্রজন্মকে শিক্ষা ক্ষেত্রে নিরবচ্ছিন্ন করতে সরকার প্রণোদিত অনেক কর্মপরিকল্পনায় শিক্ষার এই সূচকে বাংলাদেশ বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেয়। আর করোনা দুর্যোগে সেই প্রাইমারী শিক্ষায় নেমে এসেছে অবর্ণনীয় দুঃসময়। কারণ কোমলমতি শিশুরা কোনভাবেই টিভি কিংবা বেতারে শিক্ষা গ্রহণে কখনও অভ্যস্ত ছিল না। পাঠদান পদ্ধতিও একেবারে নতুন। শিক্ষকরা অনভিজ্ঞ কর্মযোগে তেমন পারদর্শিতা দেখাতেও পারেননি। সেটা যত না তাদের ব্যর্থতা তার চেয়েও বেশি সময়োপযোগী নতুন পাঠদানের যথার্থ প্রশিক্ষণের অভাব। যা কোনভাবেই ছোট ছোট শিক্ষার্থীর নজর কাড়তে পারেনি। যারা কিছুমাত্র আগ্রহী হয়েছে তারাও তাদের মনোযোগ নিবদ্ধ করতে ব্যর্থ হয়। এমন তথ্য উঠে আসে ব্র্যাকের এক জরিপে। ইউনিসেফের জরিপে উঠে আসে আরও ভয়াবহতা।
বৃহত্তর এশিয়ার ওপর যে পর্যবেক্ষণ খাঁড়া করা হয় তাতে নগ্নভাবে স্পষ্ট হয়েছে শিক্ষা কার্যক্রম থেকে ঝরে পড়া শিশুরা কায়িক শ্রমে নিয়োজিত হচ্ছে। কারণ করোনা দুর্যোগে অনেক মানুষ নিঃসহায় অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে। তারা তাদের শিশুদের শ্রম বিনিয়োগ করতে বাধ্য করছে। ইউনিসেফ সতর্কবাণীও করেছে দারিদ্র্য যে হারে বাড়ে তার ৪ গুণ বৃদ্ধি পায় শিশুশ্রম। মাঝখানে বাংলাদেশে শিশু শিক্ষায় ঝরে পড়ার হার শূন্যে নেমে এসেছিল। সরকারী হরেক রকম সাহায্য সহযোগিতায়। কন্যা শিশু সন্তানদের জীবন করোনাকালে আরও দুর্বিষহ অবস্থায় ঠেকেছে। যে দেশে বাল্যবিয়ে রোধ করা সম্ভব হয়নি সেখানে আরও নৃশংসভাবে বাল্যবিয়ের প্রকোপ বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে ব্রাক তার জরিপে সম্ভাবনার নির্দেশনাও দিয়েছে। গ্রামগঞ্জে, প্রত্যন্ত অঞ্চলে উপবৃত্তির সংখ্যা এবং পরিমাণ দুটোই বাড়াতে হবে। হতদরিদ্র পিতার সন্তানদের কন্যা-পুত্র যাই হোক না কেন অর্থযোগে নতুনভাবে সংযুক্ত করতে না পারলে পরিস্থিতি আরও বিপন্ন হবে। টিভি এবং বেতারের শিক্ষা কর্মযোগ থেকে বিযুক্ত এসব শিক্ষার্থী আরও পরিকল্পিত উপায়ে দক্ষ ব্যবস্থাপনায় তাদের পাঠদানে নিবিষ্ট করা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের একান্ত দায়বদ্ধতা। তা না হলে ক্ষুদে প্রজন্ম শিক্ষার মতো আলোকিত জগত থেকে ছিটকে পড়তে বাধ্য হবে। জুনিয়র থেকে মাধ্যমিক শিক্ষার্থীর অবস্থাও কোনভাবেই শঙ্কামুক্ত নয়, স্কুলের নিয়মিত ক্লাস ছাড়াও কোন ধরনের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হতে পারেনি।
সামনে প্রতিটি শ্রেণীর সমাপনী পরীক্ষার দিন ঘনিয়ে আসছে। নবেম্বরের মধ্যে এসব পরীক্ষা সম্পন্ন করার নির্দেশনা থাকলেও সেটা সম্ভব হবে কিনা তা বলা মুশকিল। ছয় মাস পার করে সাত মাসে পদার্পণ করল শিক্ষার্থীরা ঘরবন্দী অবস্থায়। অবহেলায়, অবসরে অপ্রয়োজনীয় সময় কাটানো ছাড়া তাদের এই মুহূর্তে কি করার থাকতে পারে তেমন নির্দেশনাও বিবেচনায় থাকা বাঞ্ছনীয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং বোর্ড এখন অবধি কোন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেয়নি। শুধু কি করা হতে পারে তার একটি অনিশ্চিত পথরেখা দিয়েছে মাত্র। অসম্ভবের সর্বশেষ পর্যায়ে পৌঁছলে চূড়ান্ত হিসেবে অটো প্রমোশনের কথাও ভাবা হয়েছে। তবে পরবর্তী ক্লাসে আগের সিলেবাসের পুনরাবৃত্তি প্রাসঙ্গিক বলেও ধারণা দেয়া হয়েছে। সবকিছু নির্ভর করছে সময়ের ওপর। সময় গড়িয়ে যাচ্ছে নদীর স্রোতের মতো। সঙ্গত কারণে দুঃসময় অতিক্রান্ত করতে গিয়ে শিক্ষার্থীদের মূল্যবান জীবন কাটানোও অসম্ভবের পর্যায়ে।
ইতোমধ্যে শিক্ষা বোর্ড আরও একটি নির্দেশনা দিয়েছে পিএসসি এবং জেএসসি পরীক্ষা প্রতিষ্ঠানেই শিক্ষকদের দ্বারা মূল্যায়ন পদ্ধতিতে চূড়ান্ত করতে। সেটাও কতখানি নিশ্চিত তাও সময়ের হাতে। তার ওপর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়াটাও সমীচীন নয়। কারণ উন্নত বিশ্বে এমন কার্যক্রম শুরু বন্ধ করে দেয়া হয় সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায়। ফলে বাংলাদেশ এ ব্যাপারে কোন ঝুঁকি নিলে সময়ের প্রজন্মকে বিপন্ন করা হবে। তার চেয়েও বেশি শিক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ কর্মযোগকে এভাবে হেলায় ফেলায় বছর পার করে দেয়া সেও এক বিপদকালীন সময়। ক্ষতি পোষানোর পুরো দায়ভাগ বর্তাবে উদীয়মান শিশু-কিশোরদের ওপর। বিচক্ষণ, বিজ্ঞ এবং অভিজ্ঞ শিক্ষাবিদ ও বিশিষ্টজনরা এ ব্যাপারে তাঁদের গুরুত্বপূর্ণ অভিমত ব্যক্ত করলে তিন কোটি প্রাইমারী থেকে মাধ্যমিক শিক্ষার্থীরা কিছুটা স্বস্তির পথ খুঁজে পেতে পারে।
কারণ সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীরা নিজেরাও যে অলস সময় পার করে খুব ভাল আছে তা বলা যাবে না। তারা দুঃসহ ক্রান্তিকাল অতিক্রম করতে গিয়ে মানসিকভাবেও বিপর্যস্ত। সময়মতো স্কুলে যাওয়া, নিয়মিত ক্লাসে উপস্থিত থেকে পাঠ্যক্রমে নিজেকে সংযুক্ত করার সুনির্দিষ্ট শৃঙ্খলার ব্যত্যয় তাদের ভাবী জীবনকে কোথায় নিয়ে যাবে? যারা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশের আগামীর ভবিষ্যত। তার ওপর শুরু হয়েছে শিক্ষক-অভিভাবকের মধ্যে কোচিং ফি নিয়ে বাগ্্বিত-া। যেখানে কোন কোচিং ক্লাসই হয়নি সেখানে বকেয়াও দাবি করেছেন শিক্ষকরা। এ নিয়ে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশও মানা হচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। আর উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা তো অবরুদ্ধতার কঠিন বাতাবরণে। তা ছাড়া উচ্চ শিক্ষার সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সবেমাত্র তাদের সেশনজট কাটিয়ে উঠেছে। সেখানে নতুন করে কোন দীর্ঘসূত্রতার জালে আটকা পড়বে সেটাও বোধহয় সময়ই নির্ধারণ করবে।
লেখক : নাজনীন বেগম, সাংবাদিক