করোনার প্রভাবে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত শিক্ষার্থীরা - দৈনিকশিক্ষা

করোনার প্রভাবে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত শিক্ষার্থীরা

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

করোনায় সারা বিশ্ব যখন বিপর্যস্ত, তখন দেশে শিক্ষার্থীদের মানসিক অবস্থা নিয়ে আমরা কতটুকু ভাবছি। অর্থনীতিকে সচল রাখতে সরকার প্রায় সব কিছু খুলে দিলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সংগত কারণে বন্ধ রেখেছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় এবং খোলার অনিশ্চয়তায় মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হচ্ছে আমাদের শিক্ষার্থীরা। গ্রামের শিশুরা অনেকটাই স্বাভাবিক জীবন যাপন করলেও শহরের গৃহবন্দি অবস্থায় অনেক শিশুর মানসিক ও অভ্যাসগত পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে, যা বিভিন্ন জরিপে উঠে এসেছে। মঙ্গলবার (১ ডিসেম্বর) কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত উপসম্পাদকীয়তে এ তথ্য জানা যায়।

উপসম্পাদকীয়তে আরও জানা যায় সবচেয়ে খারাপ অবস্থা পার করছে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্মুক্ত পরিবেশে যেভাবে সময় কাটাত, পড়াশোনার পাশাপাশি বিভিন্ন চাকরির জন্য প্রস্তুতি নিত ও পরীক্ষা দিতে পারত, টিউশনি করে দুটি পয়সা পেত, তাতে হঠাৎ পরিবর্তন এবং তা দীর্ঘায়িত হওয়ায় মানসিক ও আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ক্যারিয়ারের ভাবনায় অনেকে অস্থির সময় পার করছে। অনেকে আবার আর্থিক দৈন্যের মুখোমুখি হয়েছে।

শিক্ষার্থীরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাদের কষ্ট ও ভাবনাগুলো শেয়ার করছে। পরিবারের অসচ্ছলতা দেখে অনেক শিক্ষার্থী মা-বাবার কাছে হাতখরচটুকু চাইতে পারছে না। না পারছে কোনো কিছু করতে, না পারছে সইতে, ফলে অনেকটাই ডিপ্রেশনে ভুগছে তারা। করোনার চেয়ে এই অবস্থাকে তারা বেশি আতঙ্ক মনে করছে। লকডাউন-পরবর্তী সময় তারা কিভাবে গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করবে? করোনা-পরবর্তী পরিস্থিতি কি আবার স্বাভাবিক হবে! এগুলো নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভেসে আসছে নানা দুশ্চিন্তা। যেখানে এসব শিক্ষার্থী দিন গুনত পাস করে পরিবারকে সাপোর্ট দেবে, ভবিষ্যৎ গড়ে তুলবে, সেখানে হতাশা তাদের তাড়া দিয়ে বেড়াচ্ছে।

করোনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ দীর্ঘায়িত হলে প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যকর কোনো পরিকল্পনা আছে কি না তা-ও স্পষ্ট নয় শিক্ষার্থীদের কাছে। শিক্ষার্থীরা অনিশ্চয়তা ও মানসিক বিপর্যস্ততার মধ্যে আর থাকতে চায় না। এমন অবস্থায় কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া, বিশেষ করে অনার্স ও মাস্টার্স শেষ বর্ষের শিক্ষার্থীরা আর সহ্য করতে না পেরে অনেকে বাসা থেকে বেরিয়ে এসেছে। চাকরি ও মানসিক প্রশান্তির জন্য বাড়ি ছেড়ে অন্য জায়গায় গ্রুপ করে থাকছে। মানসিক কষ্ট ও অনিরাপত্তার কথা মাথায় নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী জায়গায় মেস করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চাকরির প্রস্তুতি ও গবেষণার কাজ করছে। এতে অনেকের ল্যাপটপ চুরি ও ছিনতাইরের মতো ঘটনা ঘটছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধ থাকায় আবাসিক হলে তাদের জায়গা দিতে পারছে না কর্তৃপক্ষ। সব মিলিয়ে আমাদের শিক্ষার্থীরা চরম দুর্দিন পার করছে।

আবার অনলাইন কার্যক্রম চালু হলেও অনেকের সঠিকভাবে ক্লাস বুঝতে না পারা, মনোযোগ না থাকা, ডাটা কেনার সামর্থ্য না থাকা এবং ইন্টারনেটের গতির সমস্যা থাকায় তা কার্যকর হচ্ছে না বলে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর অনেকেই মত দেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। অধিকন্তু গ্রামে যারা বাস করে তারা অনলাইন ক্লাস করার তেমন সুযোগই পাচ্ছে না।

শিক্ষার্থীরা মনে করছে, করোনাকে সঙ্গে নিয়েই তাদের পথ চলতে হবে। জীবন গড়তে হবে। গড়তে হবে ভবিষ্যৎ। 

তবে উপায় কী? করোনাকাল যদি দীর্ঘায়িত হয়, পরিস্থিতি যদি আগের অবস্থায় ফিরে না আসে, তাহলে কী হবে? একদিন না একদিন তো প্রতিষ্ঠান খুলে দিতে হবে। করোনা বা অন্যান্য মহামারির কথা মাথায় রেখে আমরা কি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে সেভাবে প্রস্তুত করছি বা করতে পারছি? আমরা কি শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তনের কথা ভাবছি। এসব প্রশ্ন থেকেই যায়।

এসব বিষয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সঠিক তথ্য ও ব্যবস্থাপনার জন্য সহযোগিতা করতে হবে। সরকারকে কার্যকর সমাধান দিতে হবে। প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে কোর্সে পরিবর্তন আনা বা কমানো, সেমিস্টারের পরিবর্তন, অনলাইন ও অফলাইন ক্লাস ও পরীক্ষা চালু রাখা, মূল্যায়ন পদ্ধতির পরিবর্তনসহ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সর্বোপরি শিক্ষার্থীদের সার্টিফিকেট প্রদান অব্যাহত রাখতে হবে এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সবাই মিলে কাজ করতে হবে। উচ্চশিক্ষাকে সীমিত করে কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষার্থীদের মনোনিবেশ করতে জোরালো উদ্যোগ নিতে হবে। আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টিতে তরুণ প্রজন্মকে উজ্জীবিত করতে হবে।

শিক্ষার্থীদের অভ্যাসগত পরিবর্তনের খারাপ দিকগুলো নিয়ে আমাদের এখনই ভাবতে হবে। করোনায় মানসিক স্বাস্থ্য ও মনস্তাত্ত্বিক বিষয়ে ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা পেতে আমাদের পজিটিভ পরিবর্তনগুলোকে কাজে লাগাতে পারি। মনোবিজ্ঞানীদের মতে, একজন শিক্ষার্থী কিভাবে এগুলো মোকাবেলা করবে এবং কিভাবে সে সোশ্যাল মিডিয়া থেকে নিজেকে দূরে রাখতে পারে, এ বিষয়ে পরিবার ও প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ করতে পারে। করোনা আমাদের পরিবার ও সমাজের সঙ্গে যে একটা রিলেশন ডেভেলপ করার সুযোগ করে দিয়েছে, তা আমরা কাজে লাগাতে পারি। পরিবারের কাছে থেকে পরিবারের কাজগুলো আমরা করতে পারি। প্রাত্যহিক রুটিন করে সময় কাজে লাগাতে পারি। নিয়মিত ঘুম থেকে ওঠা, নিয়মিত কাজ করা, দৈনদিন রুটিন অনুযায়ী ব্যায়াম বা শারীরিক পরিচর্যা—তাদের মধ্যে মানসিক যে চাপ তা থেকে কিছুটা হলেও প্রশান্তি দিতে পারে। সোশ্যাল মিডিয়ায় তারা কতটুকু সময় দেবে, এটাও তাদের নিয়মের ওপর পড়বে। এগুলো তাদের ইচ্ছার ওপর বহাল থাকবে। পাশাপাশি সময়মতো খাবার খাওয়া, পড়াশোনা করা—এগুলো শিক্ষার্থীদের মধ্যে মানসিক অবসাদ গড়ে তুলবে বলে অনেকেই মনে করেন।

শিক্ষার্থীদের মধ্যে যখন দুশ্চিন্তা গ্রাস করে, তখন সেই শিক্ষার্থী কিভাবে নিজেকে পজিটিভ রাখতে পারে? যেগুলো দুশ্চিন্তা বাড়াতে পারে, সেগুলো থেকে যথাসম্ভব বিরত থাকা উচিত বলে মনে করেন মনোবিজ্ঞানীরা। সোশ্যাল মিডিয়ায় বেশি সময় ব্যয় করার ফলে কভিড-১৯ ও তার পরবর্তী বিরূপ ও বিভ্রান্তিকর অনেক তথ্য পেয়ে থাকে শিক্ষার্থীরা। এতে তাদের মানসিক চাপ বেড়ে যাচ্ছে, তারা ভয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হচ্ছে।

শিক্ষার্থীদের মতে, বই পড়া, নাটক ও মুভি দেখা, ব্যায়াম করাসহ নানাভাবে তারা মনকে শান্ত রাখার চেষ্টা করে। সব কিছু করার পরও তার মানসিক যে একটা ক্রিয়া সেটা রয়ে যায়। তাদের দুশ্চিন্তা একটাই, ক্যারিয়ার ও স্বাভাবিক জীবনযাপন।

যাই হোক, এই করোনায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মনে করছে শেষ বর্ষের শিক্ষার্থীরা। এরই মধ্যে তারা গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে চাকরিজীবনে প্রবেশ করার সুযোগ পেত; কিন্তু করোনার কারণে তা হচ্ছে না। বিশ্ববিদ্যালয় ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিষয়টি খতিয়ে দেখবে আশা করি। যেকোনোভাবে, যেকোনো সিস্টেমে তাদের মূল্যায়ন করে সার্টিফিকেট দেওয়ার ব্যবস্থা করলে তাদের যে মানসিক চাপ সেটি হয়তো কেটে যাবে। সব কিছু স্বাভাবিক হয়ে জীবন চলার পথ আবারও সুন্দর হবে, এই প্রত্যাশা আমাদের সবার।

লেখক : ড. মো. সহিদুজ্জামান, অধ্যাপক ও গবেষক, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

স্কুল-কলেজ খুলছে রোববার, ক্লাস চলবে শনিবারও - dainik shiksha স্কুল-কলেজ খুলছে রোববার, ক্লাস চলবে শনিবারও নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল - dainik shiksha ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি - dainik shiksha সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ - dainik shiksha বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি - dainik shiksha সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা - dainik shiksha ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস - dainik shiksha এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0071890354156494