করোনা মহামারির কারণে গত বছরের ১৮ মার্চ থেকে দেড় বছরের বেশি সময় বন্ধ ছিল সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এই সময়ে অনেক শিক্ষার্থী অনিয়মিত পড়ালেখা করেছে, কেউ কেউ আবার পড়ালেখাই করেনি। এমন শিক্ষার্থীরাই আছে শিখন ঘাটতির (লার্নিং লস) ঝুঁকিতে। প্রাথমিকের ২২ শতাংশ এবং মাধ্যমিকের ৩০ শতাংশ শিক্ষার্থী রয়েছে শিখন ঘাটতির ঝুঁকিতে।
পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) এক গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে। গতকাল সোমবার ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে ওই গবেষণার তথ্য প্রকাশ করা হয়।
চলতি বছরের মার্চ থেকে আগস্ট পর্যন্ত শিশুদের শিক্ষাজীবনে কী কী পরিবর্তন এসেছে, তা জানতে গবেষণাটি করে সংস্থা দুটি। তিন হাজার ৭৪২ জন অভিভাবকের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়।
গবেষণায় বলা হয়, গ্রাম এবং শহরের বস্তি এলাকায় চলতি বছরের মার্চ থেকে আগস্ট পর্যন্ত প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে শিখন ঘাটতির ঝুঁকি বেড়েছে। শিখন ঘাটতির এই প্রবণতা মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বেশি। মার্চে তাদের মধ্যে এই ঝুঁকি ২৬ শতাংশ থাকলেও আগস্টে বেড়ে দাঁড়ায় ৩৪ শতাংশ।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. ছিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘এই গবেষণা অত্যন্ত সময়োপযোগী। তবে আমার ধারণা, শিখন ঘাটতিতে থাকা শিক্ষার্থীর সংখ্যা আরো বেশি হবে। আমি বলব, গত বছর অটো প্রমোশন দেওয়া ঠিক হয়নি। সেশন বাড়িয়ে পরিকল্পিতভাবে যে কনটেন্টগুলো দরকার, তা শিখিয়ে ঘাটতি পূরণ করা যেত। এ বছরও শিক্ষাবর্ষ বাড়িয়ে কিছুটা হলেও শিখন ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব। অর্থাৎ শিক্ষার্থীদের জন্য যে কনটেন্টগুলো দরকার, তা শিখিয়েই শিক্ষার্থীদের ওপরের ক্লাসে ওঠাতে হবে।’
পিপিআরসি ও বিআইজিডির গবেষণায় বলা হয়, দূরশিক্ষণের মূল উপায় হলো টেলিভিশনে রেকর্ড করা ক্লাস, অনলাইন ও সরাসরি অনলাইন ক্লাস। তবে এসব ক্লাসে থাকার সুযোগ খুব কম শিক্ষার্থীরই হয়েছে। প্রাথমিকের ৫৬ শতাংশ এবং মাধ্যমিকের ৬৫ শতাংশ শিক্ষার্থী মার্চে গৃহশিক্ষকের কাছে পড়লেও কিংবা কোচিং করলেও
আগস্টে সেই হার কমে দাঁড়ায় যথাক্রমে ৪৮ শতাংশ এবং ৪৩ শতাংশ। অবশ্য আগস্টে সরাসরি যোগাযোগ করে বা সরাসরি যোগাযোগ না করে এই দুই পদ্ধতির মিশ্রণে অ্যাসাইনমেন্ট করার বিষয়টি গ্রহণযোগ্যতা পায়। আগস্টে ১৮ শতাংশ প্রাথমিক এবং ৩৮ শতাংশ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা এই সুবিধা পেয়েছে। স্কুল বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শিক্ষকদের যোগাযোগ না থাকলেও অ্যাসাইনমেন্ট জমা দেওয়ার সময় যোগাযোগ হতো।
মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর বলছে, তাদের ৯২ শতাংশ শিক্ষার্থী অ্যাসাইনমেন্ট জমা দিয়েছে। আর প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের তথ্য মতে, ওয়ার্কশিট (অ্যাসাইনমেন্ট) জমা দেওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় শতভাগ।
বিআইডিজির গবেষক সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা মূলত গ্রাম এবং শহরের বস্তি এলাকায় কাজ করেছি। সেখানকার অভিভাবকদের আমরা জিজ্ঞেস করেছি। প্রতি সপ্তাহে যেহেতু সব শিক্ষার্থীর অ্যাসাইনমেন্ট জমা দিতে হয় না, এ জন্য তথ্যে কিছুটা গরমিল হতে পারে। এ ছাড়া আমাদের জরিপের কিছুটা সময় লকডাউনের মধ্যে পড়েছে। তখন অ্যাসাইনমেন্ট বন্ধও থাকতে পারে। তবে বড় স্কুলগুলোর শিক্ষার্থীদের সঙ্গে গ্রাম বা বস্তি এলাকার শিক্ষার্থীদের মেলালে চলবে না।’
গবেষণায় দেখা গেছে, শিখন ঘাটতির এই সমস্যার পেছনে আর্থ-সামাজিক অসমতার একটি ভূমিকা রয়েছে। গবেষণায় প্রথমে একজন শিক্ষার্থীর শিখন ঘাটতির সঙ্গে তার মায়ের শিক্ষাগত যোগ্যতার সম্পর্ক দেখা হয়। যেমন—যে মায়েরা কখনো স্কুলে যাননি, তাঁদের সন্তানরা শিক্ষিত মায়েদের সন্তানদের তুলনায় বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। দ্বিতীয়ত, যেসব শিক্ষার্থী করোনা মহামারির আগে গৃহশিক্ষক কিংবা কোচিং সুবিধা পেয়েছে, তাদের বেশির ভাগ মহামারি চলাকালেও সেই সুযোগ পেয়েছে। তৃতীয়ত, গ্রামে ৪৪ শতাংশ পরিবারে এবং শহরের বস্তিতে ৩৬ শতাংশ পরিবারে অনলাইন শিক্ষা গ্রহণের জন্য যে উপকরণ দরকার, তার ব্যবস্থা নেই। চতুর্থত, ৮ শতাংশের বেশি স্কুলগামী শিক্ষার্থী উভয় সময়েই উপার্জনের জন্য কাজ করেছে। দেশের শিক্ষায় যে বৈষম্য তা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে মহামারি।
মহামারির কারণে স্কুল বন্ধ থাকায় শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যেও বিরূপ প্রভাব পড়েছে। চলতি বছরের আগস্ট মাসে ১৫ শতাংশের বেশি পরিবার জানিয়েছে, মহামারির শুরু থেকেই স্কুল ও কলেজগামী শিক্ষার্থীরা মানসিক চাপে ভুগছে। মা-বাবারা জানিয়েছেন, স্কুল বন্ধ থাকাকালে সন্তানদের আচরণ তুলনামূলক বেশি অসহনশীল ও খিটমিটে ছিল। এই হার মার্চের ৩৬ শতাংশ থেকে বেড়ে আগস্টে দাঁড়ায় ৪২ শতাংশে।
সংবাদ সম্মেলনে পিপিআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, করোনায় আর্থিক ঝুঁকি এবং স্বাস্থ্যঝুঁকির মতো মানবসম্পদের সংকটও গুরুত্বপূর্ণ। পুনর্বাসন ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ছাড়া শুধু স্কুল খুললে শিখন ঘাটতি এবং ঝরে পড়ার ঝুঁকি মোকাবেলা করা যাবে না।
বিআইজিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ইমরান মতিন বলেন, শিক্ষা খাতে জরুরি অবস্থা মোকাবেলায় নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবন করা দরকার। একই সঙ্গে এ খাতে যে সমস্যা দেখা দিয়েছে তার বাস্তবায়নযোগ্য সমাধানও প্রয়োজন।