অ্যাসাইনমেন্ট সংগ্রহ ও জমা দেবার জন্য নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এক রকম খোলা-ই ছিল। দল বেঁধে শিক্ষার্থীরা অ্যাসাইনমেন্ট সংগ্রহ করতে প্রতিষ্ঠানে এসেছে। একইভাবে জমা দিতেও এসেছে। এরপর স্কুলের বেতন পরিশোধ করতে তারা প্রতিষ্ঠানে আসা যাওয়া করেছে। অ্যাসাইনমেন্ট দেয়া-নেয়া এবং তারপর বেতন আদায় করতে শিক্ষকগণ প্রতিদিন স্কুলে এসেছেন। এখন ভর্তি ও অন্যান্য কাজের জন্য প্রতিদিন আসছেন। অভিভাবকদের অ্যাসাইনমেন্ট সংগ্রহ ও জমা দেবার কথা ছিল। কোথাও তারা তা করেছেন বলে শুনিনি। সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীরাই সেটি করেছে।
শহর এলাকায় কিছু অভিভাবক তা করলেও গ্রামে শতভাগ শিক্ষার্থী এই কাজটি করেছে। অ্যাসাইনমেন্টের পর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হবে বলে মনে করা হয়েছিল। আমারও সে রকম মনে হয়েছে। এখন তা না করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটি আরেক দফা বৃদ্ধি করা হয়েছে। নতুন বছরটি নব উদ্যমে শুরু হবার সম্ভাবনা নেই। বছরের প্রথম দিনে বই উৎসবের আমেজে এবার নেচে উঠবে না শিশু-কিশোর শিক্ষার্থীরা। অবস্থা দৃষ্টে মনে হয়, আমাদের দেশে করোনার প্রতিষেধক ক্রমাগত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটি বৃদ্ধি করা ছাড়া কিছু নয়। তা না হলে সবকিছু যেখানে আগের মত চলছে, সেখানে এ ক্ষেত্রে এর ব্যত্যয় কেন ? করোনাকালে অনেকদিন থেকে কওমি মাদরাসা খোলা আছে। এ কারণে মাদরাসার ছাত্ররা কোথাও সংক্রমিত না হয়ে থাকলে অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন বন্ধ করে ফেলে রাখার কোন মানে নেই। অ্যাসাইনমেন্ট দেয়া-নেয়া এবং বেতন দিতে এসে শিক্ষার্থীরা হৈ হুল্লোড় করেছে।
আনন্দ-উচ্ছ্বাসে মেতেছে। দীর্ঘদিন পর প্রিয় ক্যাম্পাসে সহপাঠীকে কাছে পেয়ে ঝাপটা মেরে ধরেছে। জোর করে বুকে জড়িয়েছে। গায়ে গায়ে লেগে শ্রেণিকক্ষে বসেছে। শিক্ষকগণ স্বাস্থ্যবিধি মানতে বলেছেন। শারীরিক দুরত্ব বজায় রাখতে পরামর্শ দিয়েছেন। মাস্ক পরে আসতে বলেছেন। তাড়াহুড়ো করে পুরনো অ্যাসাইনমেন্ট জমা রেখে নতুন অ্যাসাইনমেন্ট দিয়ে দ্রুত চলে যেতে বলেছেন। তবু তারা নিজের মত করে এসেছে। নিজের মত করে বাড়ি ফিরেছে। আনন্দ উল্লাসে শ্রেণিকক্ষে ও ক্যাম্পাসে সময় কাটিয়েছে।
এ রকম ছয় সপ্তাহ ধরে বিভিন্ন দিন শিক্ষাঙ্গন মুখরিত থেকেছে। আল্লাহর রহমতে কোথাও নতুন করে করোনা সংক্রমিত হবার খবর পাওয়া যায়নি। এটিকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেবার রিহার্সেল ধরে নিয়ে নতুন বছরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেবার সিদ্ধান্ত নেয়া যেত। আমরা সেদিকে না গিয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে আছি। এটি শিক্ষার জন্য কল্যাণকর নয়। করোনাকালীন সময়ে ছুটি বৃদ্ধির নির্দেশনা সময় মত পেতে অসুবিধা হয়নি। অন্য কোন নির্দেশনা নেই। এক প্রকার নির্দেশনা ছাড়াই শিক্ষকেরা অনন্যোপায় হয়ে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করেছিলেন। নভেম্বর মাসে অ্যাসাইনমেন্ট আসার পর তা আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে যায়। অনলাইন ক্লাস চালিয়ে যাবার নির্দেশনা ও পৃষ্ঠপোষকতা থাকলে এ বিষয়ে অনেক দূর এগিয়ে যাওয়া যেত। এখন অ্যাসাইনমেন্ট শেষ হয়েছে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া না গেলে অনলাইন শ্রেণি কার্যক্রম ও নতুন করে অ্যাসাইনমেন্ট দেয়া যেতে পারে। অন্তত সপ্তাহে একটি কিংবা দু'টি বিষয়ের একটি করে অ্যাসাইনমেন্ট দিলেও মন্দ হয় না। শিক্ষার্থীরা অ্যাসাইনমেন্ট করতে গিয়ে পাঠ্য বই এক দুইবার নাড়াচড়া করলেও কিছুটা উপকার পেতে পারে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা পাঠ্যবই ছাড়া অন্য কোথাও যাতে এটি রেডিমেইড পেয়ে না যায়, সে বিষয়ে কর্তৃপক্ষকে দায় দায়িত্ব নিতে হবে। তা না হলে যেই লাউ সেই কদু হবে। অ্যাসাইনমেন্ট দিয়ে শিক্ষার্থীদের অন্তত পাঠ্য বইয়ের সান্নিধ্যে রাখা যেতে পারে।
করোনার একটি পর্যায়ে আমরা অনলাইন শিক্ষার দিকে ঝুঁকেছি। অ্যাসাইনমেন্ট আসার পর অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমে ভাটা পড়েছে। এই কার্যক্রমে পারদর্শি হয়ে উঠতে না উঠতে সেটি আপাতত বন্ধ হয়ে আছে। আমাদের শিক্ষায় এই একটি সমস্যা যে, কোন পদ্ধতিতে শিক্ষকগণ পারদর্শি হতে না হতে সেটি বন্ধ করে দেয়া হয়। নতুন পদ্ধতি চলে আসে। আমাদের শিক্ষাক্রমের বেলায়ও সেটি হয়ে থাকে। কোন একটি শিক্ষাক্রমে শিক্ষকদের পারদর্শিতা অর্জিত হতে না হতে সেটি বদলে ফেলা হয়। সুফল পাওয়ার যখন সময় আসে, তখন তা পরিবর্তিত হয়ে যায়। ২০২৩ সালে দেশে নতুন শিক্ষা ব্যবস্থা চালু হতে যাচ্ছে। দেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নতুন শিক্ষাক্রম যুগোপযোগি হবে কীনা, কে জানে? ইউরোপ আমেরিকার আদলে চিন্তা করলে হবে না। আমাদের আগে সেই পরিবেশটি তৈরি করতে হবে। শিক্ষাক্রমের আগে শিক্ষকদের পারফেক্ট করে তুলতে হবে। প্রশিক্ষিত করতে হবে। প্রশিক্ষণের নামে টাকা অপচয় বন্ধ করতে হবে। শিক্ষকদের এক হাজার টাকা বাড়ি ভাড়া আর পাঁচশত টাকা চিকিৎসা ভাতা দিয়ে বিশ্ব মানের শিক্ষা আশা করা কঠিন। অনুরুপ, তাদের জীবন মান উন্নত না করে কেবল শিক্ষাক্রম রদবদল করে ভাল কিছু আশা করা সঠিক নয়।
আমেরিকার নব নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন একজন সাবেক শিক্ষককে তার মন্ত্রিসভায় শিক্ষামন্ত্রী মনোনীত করে রেখেছেন। তাঁর স্ত্রী আমেরিকার ফার্স্টলেডিও একজন শিক্ষক। হোয়াইট হাউসে উঠার পরও তিনি শিক্ষকতা চালিয়ে যাবার ইচ্ছে ব্যক্ত করেছেন। তাদের শিক্ষার মান এমনিতেই অনেক ওপরে। এখন সেটি সবার ওপরে পৌঁছে যাবার অবারিত সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। আমাদের এখানে আজ পর্যন্ত কোন শিক্ষক শিক্ষামন্ত্রী হয়েছেন বলে জানা নেই। আমরা যদি একজন শিক্ষক কিংবা শিক্ষাবিদকে শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে পেতাম, তবে আমাদের শিক্ষার দৈন্যদশা কিছুটা হলেও কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হতো।
আমাদের যারা শিক্ষামন্ত্রী হয়েছেন, তারা সকলেই শিক্ষাবান্ধব মানুষ। শিক্ষার উন্নয়নে বিভিন্নভাবে চেষ্টা করেছেন। আমরা তাদের অশ্রদ্ধা করি না। বর্তমান শিক্ষামন্ত্রি মহোদয়ও নানা ভাবে চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। আগের শিক্ষামন্ত্রী মহোদয় শিক্ষকদের বেতন এক লক্ষ টাকা করার কথা বলেছিলেন। স্বতন্ত্র্য বেতন স্কেলের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। কিন্তু শিক্ষক পরিচয় দিতে লজ্জাবোধ করা বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তারা সেটার বিরোধীতা করে বারোটা বাজিয়েছেন। ফলে শিক্ষকদের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মধ্যে বিস্তর ফারাক রয়ে গেছে। সেটি আমাদের ভীষণভাবে ভাবিয়ে তোলে। তারা শিক্ষকদের জন্য কতটুকু করতে পেরেছেন কিংবা করেছেন, সে নিয়ে ভাববার অবকাশ থেকে যায়। শিক্ষকদের বাড়ি ভাড়া দুই শ' টাকা থেকে এক হাজার টাকা করে পাঁচগুণ বৃদ্ধি করার দম্ভ যখন কোন মন্ত্রির মুখে শুনতে পাই, তখন শিক্ষা ও শিক্ষক নিয়ে তাদের আন্তরিকতার বিষয়ে প্রশ্ন ওঠে। একশ' টাকার চিকিৎসা ভাতা পাঁচশ' টাকা করে পাঁচগুণ বৃদ্ধি করার অহংকার শিক্ষকদের কতটুকু স্বস্তি দিতে পেরেছে, কে জানে? একজন শিক্ষা বান্ধব মন্ত্রির চিন্তা চেতনায় দেশের শিক্ষা ও শিক্ষক সমাজ বিশ্ব মানে উন্নীত হওয়া কঠিন কাজ নয়।
আসল কথা এই, আমাদের দেশে রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছে শিক্ষক সমাজ তেমন একটা সমাদৃত নন। শিক্ষার প্রতি তাদের তেমন দৃষ্টি আছে বলে মনে হয় না। রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য কেউ কেউ শিক্ষকদের সময় সুযোগে এক আধটু সম্মান করেন বটে। সেটিও একেবারে মেকি। প্রয়োজন শেষে শিক্ষকের ধারে কাছেও ঘেঁষেন না। আমাদের সমাজ ব্যবস্থাটা এখন এমন হয়েছে যে, শিক্ষকেরা এক ধরণের অবহেলিত শ্রেণি বলে পরিগণিত হচ্ছেন। সরকারি একজন পিয়ন কিংবা সরকারি কর্মকর্তার গাড়ির ড্রাইভারকেও অনেকে শিক্ষকের চেয়ে সম্মানের চোখে দেখে। অফিস আদালতে একজন শিক্ষকের চেয়ে রাজনৈতিক কর্মীর মর্যাদা বেশি। ক্ষমতাসীন দলের লোক হলে কথা নেই। ওসি কিংবা টিএনওরা পর্যন্ত শিক্ষকদের চেয়ে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান-মেম্বারদের বেশি কদর করেন। শিক্ষকেরা জায়গায় জায়গায় উপেক্ষিত ও অপাংক্তেয়। সাধারণ লোকজন শিক্ষকদের সম্মান করেন বটে। কিন্তু মনে প্রাণে এতটুকু গুরুত্ব দেন না। সঙ্গত কারণে তাই শিক্ষক সমাজ অনেক ক্ষেত্রে হীনমন্যতায় (Inferiority complex) ভোগে থাকেন। এ জন্য শিক্ষার আজ এই দৈন্য দশা।
বিশ্বের মধ্যে শিক্ষার মানে আমাদের অবস্থান এতই নীচে যে, এ নিয়ে বিশ্ব দরবারে মুখ দেখানো লজ্জার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ায় আমাদের স্থান সবার নীচে। যে পাকিস্তানকে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করে সবকিছুতে হারিয়েছি, শিক্ষায় আজ তারাই আমাদের হারিয়ে দিয়েছে। লজ্জায় মরি মরি অবস্থা। কোথায় গিয়ে মুখ লুকাই, সে জায়গাটিও নেই। এ নিয়ে গভীরভাবে ভাববার সময় এসেছে। শিক্ষা ও শিক্ষকদের প্রতি যথাযথ নজর না দিলে আমাদের তলিয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। শিক্ষার মানের এই দৈন্যদশা কাটিয়ে উঠার উপায় খুঁজে বের করতে হবে। শিক্ষার মানোন্নয়নে বছরে শত শত কোটি টাকা খরচ করা হয়। সেই টাকাগুলো কোথায় যায় ? অবকাঠামো নির্মাণ, শিক্ষক প্রশিক্ষণ, উপবৃত্তি, বিনামুল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ ইত্যাদি খাতে প্রতি বছর বরাদ্দের পরিমাণ বাড়তে থাকে।
এসব খাত থেকে টাকা হাতিয়ে নেবার অবারিত সুযোগ আছে। অবকাঠামো তৈরিতে যে টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়, কোথাও কোথাও এর অর্ধেকের বেশি রুই-কাতলাদের পেটে যায়। একটি বিষয় আমার বোধগম্য হয় না যে, কোথাও স্কুল-কলেজের ভবন তৈরি করতে হলে রাজনৈতিক নেতৃত্বের সুপারিশ অপরিহার্য হবে কেন ? স্থানীয় সংসদ সদস্যের কৃপা লাভ করতে ব্যর্থ হলে অবকাঠামোর উন্নয়নে আশা করা ঠিক নয়। কোন কোন সংসদ সদস্য তার আশীর্বাদপুষ্ট একজনকে এসব কাজে সর্বময় ক্ষমতা দিয়ে দেন। সেই লোক এমপি'র দাপট খাটিয়ে তার ইচ্ছেমত স্থানে ভবন বরাদ্দ দেয়। শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতরের প্রকৌশলিরা এসব লোকের কাছে অসহায় থাকেন। তারা চাইলেও যেসব জায়গায় ভবন নির্মাণ অপরিহার্য, সেসব জায়গায় ভবন দিতে পারেন না। এই একটি উদাহরণ। এরকম আরো অনেক উদাহরণ দেয়া যেতে পারে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ এমনকি ইউনিয়ন পরিষদের বরাদ্দ পেতে রাজনৈতিক নেতৃত্বের সুপারিশ লাগে। শিক্ষা বিভাগের লোকজনের কিছু করার থাকে না। এজন্য আজকাল অনেক হেড মাস্টার কিংবা প্রিন্সিপালকে ইউনিয়ন ও থানা পর্যায়ের নেতা নেত্রীদের ধর্ণা দিতে দেখা যায়। এমপি কিংবা মন্ত্রির পেছনে পেছনে ঘুরতে হয়। উপজেলা ও জেলা পর্যায়ের শিক্ষা কর্মকর্তাগণ রাজনৈতিক ক্ষমতার কাছে নিতান্ত অসহায় বোধ করেন। স্বাধীনভাবে তারা কাজ করতে পারেন না। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষার প্রতিটি স্তর রাজনীতির থাবায় ক্ষত বিক্ষত। এটি কেবল বর্তমান সময়ের কথা নয়। শিক্ষায় রাজনৈতিক ক্ষমতার অশুভ হস্তক্ষেপ সেই সুদূর অতীতকাল থেকে চলে আসছে এবং এখনো আছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পর্যন্ত নিয়োগে রাজনৈতিক সুপারিশের গুরুত্ব সর্বাধিক।
মেধার আজকাল কোন দাম নেই। তাই মেধাবীরা শিক্ষকতা পেশা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। মেধাবীদের শিক্ষকতায় ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেই। শিক্ষায় জ্ঞান ও গবেষণার চর্চা নেই। উচ্চ শিক্ষায় গবেষণার আলাদা মর্যাদা নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে গবেষণা কর্মের চেয়ে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার বিষয়টি যাচাই করে দেখা হয়। একশ'টি গবেষণা থাকলেও রাজনৈতিক পরিচয় না থাকলে বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য পদে নিয়োগ পাওয়া সম্ভব নয়। আমার জনৈক ছাত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ে তার ডিপার্টমেন্টে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়েও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হবার সুযোগ পায় নাই। থার্ড হয়েও কেউ কেউ শিক্ষক হবার সুযোগ পেয়ে যায়। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা বা রাজনৈতিক পরিচয় একটি বড় ফ্যাক্টর। এজন্য আমাদের শিক্ষা বলি আর জ্ঞান বলি, সব জায়গায় বন্ধ্যাত্ব। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে এক সময় প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলা হত। আজ সেটি বিশ্বের হাজারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে নিজের জায়গা করে নিতে পারে না। জ্ঞান গরিমায় আমাদের পিছিয়ে থাকার এর চেয়ে বড় উদাহরণ কী হতে পারে ?
শিক্ষার মানোন্নয়নে শিক্ষক ও শিক্ষাক্রম দুটো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মেধাবী শিক্ষক ও যুগোপযোগি শিক্ষাক্রম ছাড়া বিশ্বমানের শিক্ষা কল্পনা করা কঠিন। আমাদের শিক্ষা ক্ষেত্রে এ দু'টো বিষয় বরাবর উপেক্ষিত হয়ে আসছে। মেধাবীদের শিক্ষকতা পেশায় আকৃষ্ট করার উদ্যোগ নেই। বরং যা যা করলে মেধাবীরা শিক্ষকতা পেশা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবেন, তার সবই করতে এক শ্রেণির লোকজনকে অতি উৎসাহি ভুমিকা পালন করতে দেখা যায়। এরা এক শ্রেণির আমলা বিশেষ, যারা শিক্ষকদের কেন জানি চক্ষুশূল ভেবে থাকেন। অথচ তারা শিক্ষকদের হাত ধরে আজকের অবস্থানে এসেছেন। কৃতজ্ঞতার জন্য না হউক, দেশের জন্য তাদের শিক্ষকদের প্রতি উদার মনোভাব প্রদর্শন করা উচিত ছিল। মেধাবীদের শিক্ষকতা পেশায় ছুটে আসার পথটি তারা প্রশস্ত করে দিতে পারতেন।
আজ মেধাবী প্রজন্মটি শিক্ষকতায় না এসে পুলিশে কিংবা প্রশাসনে যেতে আগ্রহি। এর কারণ খুঁজে বের করা জরুরি হয়ে পড়েছে। যে সব কাজ অপেক্ষাকৃত কম মেধাবীদের দিয়ে চালিয়ে নেয়া যায়, সে সব ক্ষেত্রে অধিকতর মেধাবীরা চলে যাচ্ছে। আর শিক্ষকতার মতো মহান পেশা যেটি মেধাবী ছাড়া অন্যদের দিয়ে পরিচালনা করা কঠিন, সেখানে মেধাবীদের অনুপ্রবেশ এক রকম বন্ধ রয়েছে। এ কারণে আমাদের শিক্ষা ও জ্ঞান উভয়টির মান অনেকের পিছনে পড়ে আছে। উপযুক্ত শিক্ষাক্রম তথা সঠিক শিক্ষা ব্যবস্থার অভাবে আমাদের জ্ঞানের চর্চা একেবারে কম। শিক্ষকদের মর্যাদার জায়গায় নিয়ে যেতে না পারায় আমরা জ্ঞান বিজ্ঞানে অন্য সবার থেকে পিছিয়ে। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তির প্রাক্ষালে ঐতিহাসিক মুজিববর্ষে আমরা জ্ঞান বিজ্ঞানে এগিয়ে যাবার শপথ নেই। শিক্ষা ব্যবস্থা ও শিক্ষকদের জীবন মান উন্নয়নে যা যা করার, আসুন সবই করি।
লেখক : অধ্যক্ষ, চরিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, কানাইঘাট, সিলেট।