একটি দৈনিকে প্রকাশিত করোনায় আক্রান্ত বাবার মৃত্যুতে ছেলের মর্মস্পর্শী বর্ণনাটি পড়লাম। খুবই কষ্টকর ও এক দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে গিয়েছিলেন ছেলেটি ও তাঁর পরিবার। তাঁর এবং পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সহানুভূতি প্রকাশ করছি। পাশাপাশি তাঁকে ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের অশেষ ধন্যবাদ জানাচ্ছি যে, দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতির মধ্যে পড়েও শেষ পর্যন্ত রূঢ় হলেও কঠিন বাস্তবতাকেও তারা মেনে নিয়েছেন। বাবার করোনায় আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিন্ত হওয়ার পর তাঁরা হোম কোয়ারেন্টাইনে চলে গেছেন। বাস্তবিকই এর কোনো বিকল্প ছিল না। বিজ্ঞান এমনটাই প্রত্যাশা করে। কখনও কখনও আবেগের চেয়ে মস্তিস্ককে অধিক মূল্য দিতে হয়। দিতে হয় নিজের, পরিবার, সমাজ ও দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর জন্য। আপনারা যে এ কাজটি করেছেন, সে জন্য বুকে কষ্ট নিয়ে হলেও আপনাদের মোবারকবাদ জনাই। শুক্রবার (২৭ মার্চ) সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।
নিবন্ধে আরও জানা যায়, সবারই অবশ্য এ দৃষ্টান্তটি ভালো করে বোঝা দরকার এবং প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে তা অনুসরণ করা আবশ্যক। যদিও এর যে ব্যত্যয় ঘটছে, তেমনটি যেমন প্রত্যক্ষ করছি, তেমনি সংবাদপত্র কিংবা টেলিভিশনে কারও কারও সাক্ষাৎকারে এটি প্রচারিত হতেও দেখছি। সদ্য অস্ট্রেলিয়া থেকে দেশে ফিরে আসা একজন বিজ্ঞানের অধ্যাপককে মসজিদে নামাজ পড়তে দেখে আমি খুব অবাক হয়েছি। বিষয়টি মসজিদ কমিটির সভাপতিকে অবহিত করা হয় এবং ইমাম সাহেবের সঙ্গেও আলাপ করা হয়। অবস্থার উন্নতি হয়েছে কিনা জানি না। বিজ্ঞান জানা আর বিজ্ঞানমনস্কতা যে এক জিনিস নয়- নিজের চোখের সামনে তা আবারও প্রত্যক্ষ করলাম।
টেলিভিশনে দেখলাম ও শুনলাম একজন দর্শকের মোবাইল ফোনে কথোপকথন। দর্শক জানাচ্ছেন, সদ্য বিদেশফেরত তার এক গ্রামবাসীকে হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকার জন্য এয়ারপোর্ট থেকে বলা হলেও তিনি তা অগ্রাহ্য করে যত্রতত্র যাচ্ছেন। যারতার সঙ্গে হাত মেলাচ্ছেন। ব্যাপারটি দেখে দর্শক একজন আইন প্রয়োগকারীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। তিনি দর্শকের কাছে তার মোবাইল নম্বর চেয়েছেন। তার মোবাইল নম্বর দর্শকের জানা নেই। এটি জানানো না হলে আইন প্রয়োগকারী এ বিষয়ে তার কিছু করার নেই বলে জানালেন। ব্যাপারটি এখানেই থেমে যাওয়ার কথা। তবে তিনি যদি সত্যি সত্যি ভাইরাসটির বাহক হয়ে থাকেন, তাহলে তার দেহ থেকে ভাইরাস অন্য লোকের দেহে সংক্রমিত হওয়া কিন্তু থামেনি। আর সেটাই যদি ঘটে আর তা জানাজানি হয়ে যায়, তখন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকজন নিঃসন্দেহে ছোটাছুটি করবেন। ততদিনে পানি বহুদূর গড়িয়ে যাবে। যেমন নিজে আক্রান্ত হননি সে রকম বিদেশফেরত আত্মীয় ভদ্রলোক ভাইরাসটির বাহক হিসেবে কাজ করেছেন। আর শুরুতে আলোচিত ছেলেটির চরম দুর্ভাগ্যের কারণ হয়েছেন।
হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকা বলি আর আইসোলেশনে থাকা বলি; সরকারি নির্দেশ না মানলে বিপদ ক্রমশ বাড়বেই। সে বিপদ কাউকে ছেড়ে কথা বলবে, তেমন নয়। করোনা তো নয়ই; কোনো ভাইরাসই ধনী-দরিদ্র বোঝে না; হিন্দু-মুসলিম বোঝে না; বর্ণবৈষম্য বোঝে না; রাজা-প্রজাও বোঝে না। সংক্রমিত হলে যাদের প্রতিরোধ ক্ষমতা ভালো, সময়মতো সঠিক চিকিৎসা যারা নিতে পারছে তারা বেঁচে যাচ্ছে। অন্যরা জীবনের মায়া ত্যাগ করছে। বলা বাহুল্য, অধিকাংশ আক্রান্ত ব্যক্তিই সেরে উঠছেন। বৃদ্ধরা কঠিন সমস্যায় পড়ছেন বটে, যুবক আর তরুণরা শঙ্কামুক্ত; তা তো নয়। ফলে সবারই সাবধান হতে হবে।
ভাইরাস আসলে কী- সে প্রশ্ন আসতেই পারে। সবাই তা জানেন, ব্যাপারটি বাস্তবে তা নয়। বিজ্ঞানীদের কেউ বলেন, এটি ঠিক জীব নয়। কারণ সাধারণভাবে যেসব বৈশিষ্ট্য থাকলে কোনো বস্তুকে জীব বলা যায়, ঠিক তা এর মধ্যে নেই। জীবদেহের বাইরে যখন পড়ে থাকে এরা; কোনো নিরেট পাথর বা মাটির ঢেলার ওপর; তখন ভারি নির্জীব এরা। যতদিন বাঁচে সেখানে তখন আর কেনো খাবারদাবারের প্রয়োজন হয় না এদের। দিনের পর দিন অনেকটা নিষ্প্রাণ পড়ে থাকে। কখনও কখনও এরা জীবের অধিক জীব হয়ে ওঠে। একবার জীবদেহে ঢুকে গিয়ে যদি এর সংখ্যা বৃদ্ধির কাজটি শুরু করতে পারে, আর এর স্বভাবটি যদি মানবঘাতী হয়, তাহলেই ঘটে যত বিপত্তি। তার মানে, জীবন ও মৃত্যুর মাঝামাঝি এক জীবকণিকা হলো ভাইরাস। এক চরম রহস্যময় এক জীবকণিকা। এ রকমই এক জীবকণিকা হলো করোনাভাইরাস। জীবদেহে সংখ্যা বৃদ্ধি করতে পারার স্বভাবটির কারণেই জীববিজ্ঞানে এর অবস্থান।
এক করম ভীতির মধ্যে দিন কাটাচ্ছে বহু মানুষ। অবস্থা যত ভয়ংকরই হোক, ভীত হয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে থাকার কোনো সুযোগ নেই। সাহস এবং অবশ্যই বিজ্ঞানমনস্কতার সঙ্গে একে মোকাবিলা করতে হবে। অতি আবশ্যক না হলে এড়িয়ে যেতে হবে জনসমাগম। হাঁচি-কাশি থেকে নিজেকে রক্ষা করতে হবে; বাঁচাতে হবে অন্যদেরও। টাকা-পয়সার মাধ্যমেও ছড়াতে পারে এই ভাইরাস। সাবান কিংবা স্যানিটাইজার দিয়ে ভালো করে হাত ধুয়ে ফেলতে হবে। বাচ্চা ও বয়স্কদের টাকা-পয়সা ধরতে না দেওয়াই ভালো। মুখ দিয়ে কামড় দিয়ে টাকা ধরা যাবে না কোনোভাবেই। রোগের লক্ষণ দেখা দিলে অবশ্য তা জানাতে হবে সংশ্নিষ্ট চিকিৎসাকেন্দ্রকে। সেসব কেন্দ্রের টেলিফোন বা মোবাইল নম্বর প্রায় সারাক্ষণই দেখানো হচ্ছে টেলিভিশনে।
হাসপাতালগুলোর প্রস্তুতির যা খবর পাচ্ছি, সেটি খুব সন্তোষজনক বলা যাবে না। প্রতিদিন প্রস্তুতির দৈন্যের প্রতিবেদন টেলিভিশন ও সংবাদপত্রে দেখতে পাচ্ছি। ব্যাপক সংখ্যক লোকের চিকিৎসাসেবা প্রদান খুব যে সহজ হবে, তা যে নয়; সেটি অনুমান করা চলে। চিকিৎসকদের প্রয়োজনীয় যা সহায়তা প্রয়োজন, সেটি দিতে কার্পণ্য বা বিলম্ব কোনোটাই করা যাবে না। ব্যাপারটি অবশ্যই লোক দেখানোর নয়; বাঁচা-মরার। চিকিৎসাসামগ্রী বলি, প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ বলি, কিট বলি; সবই দিতে হবে তাদের চটজলদি। ব্যবস্থা যে নেওয়া হচ্ছে না, তা বলা যাবে না, তবে অপর্যাপ্ত। সক্ষমতার ঘাটতিও খানিক রয়েছে আমাদের, সেটাও বুঝতে হবে।
পৃথিবীর দেশে দেশে কী হচ্ছে, সেটি আমাদের জানতে হবে। ভয় পেয়ে যাওয়ার জন্য নয় অবশ্যই; সচেতন হওয়ার জন্য। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য। অন্যেরা কী কী ব্যবস্থা নিচ্ছে, সেটাও জানতে হবে। এটি একটি মহামারি। একে একার পক্ষে সরকারই শুধু মোকাবিলা করতে পারবে, তা নয়। সবার বিজ্ঞানমনস্ক আচরণ আর সংবেদনশীল কর্মকাণ্ডই পারে দিনে দিনে এর গতি রোধ করতে। ভুল করার কোনো সুযোগ নেই। রাগ-অভিমানের সময় তো এটা নয়ই। এটা ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ির সময়ও নয়; সময় নয় কথামালার রাজনীতিরও। সমস্যাটাকে বুঝতে হবে এটা যত বড়, তার চেয়ে এক ফোঁটা কম করেও নয়। সামান্য ভুল সিদ্ধান্ত ও অসচেতন কর্মকাণ্ড আমাদের ভয়ানক পরিণতির দিকে ঠেলে দিতে পারে। সবাই মিলে এই ঘাতক সংক্রামক ভাইরাস ঠেকাতে হবে। সবারই এর ভয়াবহতার গুরুত্ব অনুধাবন করে সেভাবেই কাজটি করতে হবে। জয়ী হওয়া ছাড়া আমাদের বিকল্প নেই। প্রয়োজন সচেতনতা, বিজ্ঞানমনস্ক আচরণ, ধৈর্য ও সহনশীলতা।
লেখক : ড. মো. শহীদুর রশীদ ভূঁইয়া, সভাপতি, বাংলাদেশ বায়োলজি অলিম্পিয়াড কমিটি ও অধ্যাপক, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়