কুষ্টিয়ার ঐতিহ্যবাহী ইসলামিয়া কলেজে ২০১০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে অধ্যক্ষের দায়িত্বে আছেন নওয়াব আলী। তার বিরুদ্ধে গুরুতর নানা অভিযোগ উঠেছে। নিয়োগ-বাণিজ্য থেকে শুরু করে ভুয়া বিল-ভাউচারের মাধ্যমে কলেজ ফান্ডের টাকা লুটপাট করে চলেছেন তিনি।
সংশ্নিষ্টরা বলেছেন, জালিয়াত হিসেবে প্রমাণিত হয়েও কলেজ পরিচালনা পর্ষদসহ প্রভাবশালীদের ম্যানেজ করে অধ্যক্ষের পদ আঁকড়ে রেখেছেন নওয়াব আলী। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করতে পরিচালনা পর্ষদকে নির্দেশ দিলেও তা করা হয়নি। এসব কারণে গভীর সংকটে পড়তে বসেছে কলেজটি।
এনএস রোডে অবস্থিত কলেজের নিজস্ব মার্কেট ও দোকান রয়েছে তিন শতাধিক। সেখান থেকে প্রতি মাসে বিপুল টাকা কলেজের ফান্ডে জমা হয়। সে কারণে এ প্রতিষ্ঠানের ওপর নজর থাকে সবার।
কলেজ পরিচালনা পর্ষদের সদস্য বিএনপির সাবেক নেতা হাফিজুর রহমান হেলাল বলেন, নওয়াব আলীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের অন্ত নেই। পর্ষদ সভায় আলোচনা হলেও কোনো সভাপতিই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেননি।
নওয়াব আলীর বিরুদ্ধে তৎকালীন পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি ও সংসদ সদস্য রশীদুজ্জামান দুদুর স্বাক্ষর জাল করে অধ্যক্ষের পদ বাগিয়ে নেওয়ার অভিযোগ ওঠে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তদন্তে অভিযোগের সত্যতা মিললে ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দে তার সরকারি বেতন বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়। একই সঙ্গে আয়কর ও ভ্যাট বাবদ প্রায় ১৫ লাখ টাকা কলেজের কোষাগারে জমা দিতে বলা হয়। এ ছাড়া ফৌজদারি মামলা করতে পরিচালনা পর্ষদকে নির্দেশ দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও মাউশি। পাশাপাশি শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতার বিলসহ কাগজপত্রে তিনি স্বাক্ষর করতে পারবেন না বলেও জানিয়ে দেওয়া হয়। সে নির্দেশ বাস্তবায়ন করেনি পরিচালনা পর্ষদ। পরে আরও ৯ বার মন্ত্রণালয় চিঠি দিলেও পর্ষদের তৎকালীন সভাপতি শামসুর রহমান বাবু মামলা করেননি। এতে অসন্তুষ্ট হয়ে বাবুকে সভাপতির পদ থেকে সরিয়ে দেয় মাউশি।
শিক্ষকদের অনেকে অভিযোগ করেন, নওয়াব আলী পরিচালনা পর্ষদের সঙ্গে যোগসাজশে টাকার বিনিময়ে অতিরিক্ত শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছেন। তারা এমপিওভুক্তি না পাওয়ায় মানবেতর জীবনযাপন করছেন। সংকট সমাধানে তারা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়সহ সংশ্নিষ্ট দপ্তরে আবেদন দিলেও তা আমলেই নেওয়া হয়নি।
কলেজের প্রশাসনিক শাখা সূত্র জানায়, এ প্রতিষ্ঠানে উচ্চ মাধ্যমিক, ডিগ্রি, অনার্স ও উন্মুক্ত শাখা মিলে প্রায় আট হাজার শিক্ষার্থী লেখাপড়া করে। প্রতি বছর তাদের মাসিক বেতন ও পরীক্ষার ফরম পূরণ থেকে আয় হয় কমপক্ষে ছয় কোটি টাকা। বছরের পর বছর অডিট না হওয়ায় সেই টাকার হিসাব নেই। প্রতি বছর যে টাকা আয় হয়, তার বড় একটি অংশ ব্যাংকে জমা না দিয়ে নিজের কাছে রাখেন অধ্যক্ষ।
এদিকে লেনদেনে স্বচ্ছতা আনতে উপাধ্যক্ষ সাবিনা ইয়াসমিন শিওরক্যাশ ব্যবহার শুরু করলেও নওয়াব আলী তা বন্ধ করে দেন। এ ছাড়া অধ্যক্ষ দোকানের পজিশন বিক্রি করে পুরো টাকা কলেজ ফান্ডে জমা দেননি বলেও অভিযোগ শিক্ষকদের। বিজ্ঞান, রবীন্দ্র কলাভবন সংস্কারসহ নানা খাতে ভুয়া বিল-ভাউচারে তিনি আড়াই কোটির বেশি টাকা উত্তোলন করেছেন। কলেজে রহিমা আফসার একাডেমিক ভবনের নির্মাণকাজ চলছে। নির্মাণকাজে ঠিকাদারকে অতিরিক্ত অর্থ দেওয়া হচ্ছে। সেখান থেকে অধ্যক্ষ কমিশন নেন।
অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে কলেজের প্রায় তিন কোটি ৫০ লাখ টাকার এফডিআর ভেঙে তা নয়ছয় করারও অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া অনিয়ম-দুর্নীতির প্রতিবাদ করায় উপাধ্যক্ষ সাবিনার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ এনে দীর্ঘদিন ধরে সাসপেন্ড করে রেখেছেন তিনি। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তদন্ত শেষে উপাধ্যক্ষের বিরুদ্ধে সব অভিযোগ খারিজ করে স্বপদে বহালের নির্দেশ দিলেও তা বাস্তবায়ন করা হয়নি।
সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, নওয়াব আলীর লুটপাটের প্রতিবাদ করেছিলাম। কলেজ ফান্ডের হিসাবে স্বচ্ছতা আনার চেষ্টা করেছিলাম। এসব কারণেই আমাকে অবৈধভাবে বরখাস্ত করে রাখা হয়েছে। আমাকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হলেও তা মানা হচ্ছে না। কলেজটিকে শেষ করে দেওয়া হচ্ছে। দেখার কেউ নেই।
পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আবুল হোসেন গাজী বলেন, দীর্ঘদিন অধ্যক্ষের বেতন বন্ধ থাকলেও কলেজের অর্থ লুটপাট করে আয়েশি জীবন যাপন করছেন।
ব্যবসায় ব্যবস্থাপনা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক শহিদুল ইসলাম জোয়ার্দার বলেন, কলেজের ৩০০ দোকান বিক্রিসহ বিভিন্ন খাত থেকে কয়েক কোটি টাকা লুটপাট করেছেন অধ্যক্ষ। অতিরিক্ত শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। অথচ তারা বেতন পাচ্ছেন না।
অধ্যক্ষ নওয়াব আলীর সঙ্গে ফোনে কথা বলা হলে তিনি কোনো অভিযোগেরই সদুত্তর দিতে পারেননি। এসব বিষয়ে কথা বলার জন্য সময় চান। পরে প্রতিবেদন না করার জন্যও তিনি বিভিন্ন মাধ্যমে চাপ দেন। আবারও বক্তব্য জানতে কলেজে তার কার্যালয়ে যাওয়া হয়। এর পরও অভিযোগগুলো নিয়ে তিনি কথা বলেননি।
জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও কলেজ পরিচালনা পর্ষদের সাবেক সভাপতি আজগর আলী বলেন, একজন অবৈধ অধ্যক্ষ কলেজটিকে পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করে দিচ্ছেন। এখনই তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।
সদ্য বিদায়ী জেলা প্রশাসক ও কলেজ পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি আসলাম হোসেন বলেন, অনেক বিষয় অধ্যক্ষ লুকিয়ে রাখেন। তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর জবাবদিহি নিশ্চিত করার ব্যাপারে নানা পদক্ষেপ নিয়েছিলেন।