পুরোপুরি মেধার ভিত্তিতে নেওয়া ৪০তম বিসিএসে নারীরা পিছিয়েছেন। জেলা কোটাও না থাকায় নাটোর, ভোলা, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি থেকে প্রশাসন ক্যাডারে কেউ সুপারিশ পাননি। একই কারণে ঢাকা জেলা থেকে সর্বোচ্চ ২৪ প্রার্থী চূড়ান্ত সুপারিশে জায়গা করে নিয়েছেন। ৪০তম বিসিএসের ফল বিশ্লেষণ করে এমন চিত্র পাওয়া গেছে।
পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) চেয়ারম্যান মো. সোহরাব হোসাইন বলেন, ‘পিএসসি সাংবিধানিক সংস্থা হলেও সরকারের নীতি অনুসরণ করে। জনবল বাছাইয়ের জন্য সরকার যে সিদ্ধান্ত নেয় আমরা সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী উপযুক্ত ব্যক্তিকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করি। সরকারের সিদ্ধান্তের বাইরে পিএসসির যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে মেধার ভিত্তিতে বিসিএস আয়োজনের। পিএসসি তাই করেছে। মেধার ভিত্তিতে নেওয়া ৪০তম বিসিএসে যদি নারীরা পিছিয়ে থাকে, তাহলে লেখাপড়ার মাধ্যমেই তা পূরণ করতে হবে। কঠোর পরিশ্রম করে তাদের আগের জায়গায় যেতে হবে।’ বুধবার (২৯ জুন) দেশ রুপান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন আশরাফুল হক।
প্রতিবেদনে আরও জানা যায়,গত ৩০ মার্চ পিএসসি ৪০তম বিসিএসে ১ হাজার ৯৬৩ জনের চূড়ান্ত সুপারিশের তালিকা প্রকাশ করে। এর মধ্যে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বিসিএস) প্রশাসন ক্যাডারে ২৪৫ জন সুপারিশ পেয়েছে। সব ক্যাডারের প্রার্থীদের তথ্যের সত্যতা যাচাই (পুলিশ ভেরিফিকেশন) শুরু হয়েছে।
জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী মো. ফরহাদ হোসেন বলেন, ‘সত্যতা যাচাইয়ের প্রতিবেদন হাতে এলেই চূড়ান্ত নিয়োগ দেবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। আমরা দ্রুততম সময়ের মধ্যেই এ নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ করতে চাচ্ছি।’ফল বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, প্রশাসন ক্যাডারের ২৪৫ জনের মধ্যে নারী ৫৯ জন এবং পুরুষ ১৮৬ জন। অর্থাৎ ১০০ জনের মধ্যে ২৪ জন নারী সুপারিশ পেয়েছেন। পুরুষ একজনের বিপরীতে নারী শূন্য দশমিক ৩২।
৪০তম বিসিএস হচ্ছে সাধারণ বিসিএস। এর আগে সর্বশেষ সাধারণ বিসিএস ছিল ৩৮তম। ২০২১ সালের ২৭ জানুযারি জারি করা ৩৮তম বিসিএসের নিয়োগ প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী প্রশাসন ক্যাডারে নারী কর্মকর্তা ২৭ দশমিক ৪৩ শতাংশ। ওই বিসিএসে নারী ও পুরুষের অনুপাত ছিল শূন্য দশমিক ৩৮ঃ১।
দুই সাধারণ বিসিএস তুলনা করলে দেখা যাচ্ছে, কোটাযুক্ত বিসিএসের তুলনায় কোটামুক্ত বিসিএসে নারীরা পিছিয়েছেন ৩ দশমিক ৪৩ শতাংশ। যদিও কোটামুক্ত বিসিএসে প্রথম হয়েছেন একজন নারী। তিনি হচ্ছেন যশোর জেলার জান্নাতুল ফেরদৌস। তিনি একজন প্রকৌশলী। তার প্রথম হওয়ার পর কারিগরি বিষয়ে পড়াশোনা করে সাধারণ বিষয়ের শিক্ষার্থীদের সাথে প্রতিযোগিতা করে বিসিএস প্রশাসন ক্যাডার হওয়া নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে। জান্নাতুল ফেরদৌস রাজধানীর এ কে হাই স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাস করেন। উচ্চ মাধ্যমিকে হলিক্রসে ভর্তি হলেও তিনি সেখান থেকে শেষ করতে পারেননি। যাত্রাবাড়ী থেকে ফার্মগেট হলিক্রস কলেজে যাওয়ার সেই সময়ে যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভারের কাজ চলছিল। তাই বাসা থেকে যাওয়া কষ্টকর ছিল। এতে কলেজ বদল করে তিনি যাত্রাবাড়ীর দনিয়া কলেজে ভর্তি হন। জিপিএ ৫ পেয়ে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন। পরে খুলনা প্রকৌশল বিশ^বিদ্যালয়ে (কুয়েট) মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি হন। ২০১৭ সালে বিএসসি ইন ইনঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন। বর্তমানে তিনি ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (আইবিএ) থেকে এমবিএ করছেন।
ফল বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, ঢাকার ২৪ প্রার্থীর পরই রয়েছে কুমিল্লা, এ জেলায় ১৫ প্রার্থী চূড়ান্ত সুপারিশ পেয়েছেন। তৃতীয় সর্বোচ্চ প্রার্থী ৯ জন রংপুরের। বরিশাল, গাজীপুর, দিনাজপুর ও পাবনার ৮ জন করে চূড়ান্ত সুপারিশে জায়গা করে নিয়েছেন। নোয়াখালী ও গোপালগঞ্জের প্রার্থী আছেন ৭ জন করে। ৬ জন করে আছেন শরীয়তপুর, টাঙ্গাইল, মাদারীপুর ও কুড়িগ্রামের। চূড়ান্ত তালিকায় ৫ জন করে চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা ও ময়মনসিংহের, ৪ জন করে চাঁদপুর, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, সাতক্ষীরা, কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, পিরোজপুর, সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নীলফামারী, নেত্রকোনার প্রার্থী রয়েছে। ৩ জন করে নড়াইল, চুয়াডাঙ্গা, বরগুনা, সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, নরসিংদী ও রাজবাড়ীর, ২ জন করে ফেনী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কক্সবাজার, জয়পুরহাট, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, যশোর, মেহেরপুর, মাগুরা, ঝালকাঠি, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, ফরিদপুর, লালমনিরহাট, গাইবান্ধা ও ঠাকুরগাঁও প্রার্থী চূড়ান্ত সুপারিশ পেয়েছেন। আর রাঙ্গামাটি, লক্ষ্মীপুর, নওগাঁ, বাগেরহাট, পটুয়াখালী, মানিকগঞ্জ, পঞ্চগড়, শেরপুর, জামালপুরের ১ জন করে প্রার্থী নিয়োগ পাচ্ছেন।
দেশের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে সুবিধা দেওয়ার জন্য বিশে্বর প্রায় সব দেশেই কোটা সুবিধা দেওয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখার জন্য সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ৩০ শতাংশ কোটা চালু করে। পরে এ কোটা সুবিধা দেওয়া হয় মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান ও নাতি-নাতনিদের। এই সুযোগে প্রথম শ্রেণির সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবারের সদস্যদের অবস্থান সুসংহত হয়।
মুক্তিযোদ্ধা কোটার পাশাপাশি দেওয়া হয় জেলা কোটা। প্রথম শ্রেণির চাকরিতে দেশের সব জেলার জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য এ কোটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। শিক্ষায় এগিয়ে থাকার জন্য যেকোনো ধরনের সরকারি চাকরিতে একসময় কুমিল্লার প্রাধান্য ছিল। চট্টগ্রাম ও বরিশালেরও দাপট ছিল। জনসংখ্যা হিসেবে ১০ শতাংশ জেলা কোটা চালু করায় দেশের সব জেলা থেকে চাকরির সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল।
নারীদের এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য সরকার নারী কোটা চালু করে। একসময় নারীরা প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় পিছিয়ে থাকত। দেশ গঠনে তাদের ভূমিকা রাখার সুযোগ করে দিতে ১০ শতাংশ নারী কোটা চালু করা হয়। এই সুযোগে নারীদের সংখ্যা বাড়ে প্রশাসনসহ গুরুত্বপূর্ণ পেশাগুলোতে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী পিছিয়ে পড়া এক জনগোষ্ঠী। তাদের এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য ৫ শতাংশ কোটা ব্যবস্থা চালু করা হয়। এ কোটা সুবিধার কারণে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর অনেকে সরকারি চাকরিতে আসার সুযোগ পায়। যদিও লেখাপড়ায় পিছিয়ে থাকার কারণে তারা তাদের জন্য বরাদ্দ করা কোটা সুবিধার পুরোটা ব্যবহার করতে পারেননি। বেশিরভাগ বিসিএসেই ৩ শতাংশের বেশি পদ তারা পেত না।
২০১৮ সালের আগস্টে ৪০তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে পিএসসি। এর আগে কোটা সংস্কারের দাবিতে প্রথমে পাবলিক বিশ^বিদ্যালয়গুলোতে পরে সারা দেশে আন্দোলন শুরু করে শিক্ষার্থীরা। এক পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন সর্বাত্মক রূপ নেয়। রাজধানী ঢাকাসহ বড় শহরগুলো অচল করে দেওয়া হয়। দিনের পর দিন ঢাকার রাজপথ, রেলপথ অবরোধ করে রাখে শিক্ষার্থীরা। পরিস্থিতি বুঝতে পেরে সরকার সচিব কমিটি গঠন করে। এ কমিটি কোটা বিলুপ্তির সুপারিশ করে। অথচ শিক্ষার্থীরা কোটা সংস্কারের দাবি করেছিল। তারা কখনোই পুরো কোটা বিলুপ্তির কথা বলেননি। কিন্তু সরকারের নীতিনির্ধারকরা কোটা পদ্ধতিই তুলে দেন।
বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র সংরক্ষণ পরিষদের ব্যানারে যে পাঁচটি বিষয়ে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন হয়েছিল সেগুলো হচ্ছে কোটাব্যবস্থা ১০ শতাংশে নামিয়ে আনা। কোটায় যোগ্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে মেধাতালিকা থেকে শূন্য পদে নিয়োগ দেওয়া। সরকারি চাকরিতে সবার জন্য অভিন্ন বয়সসীমা নির্ধারণ করা। কারণ মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের ক্ষেত্রে চাকরির আবেদনের বয়সসীমা ৩২ হলেও সাধারণ শিক্ষার্থীদের জন্য ৩০। কিছু ক্ষেত্রে সাধারণ শিক্ষার্থীরা চাকরিতে আবেদনই করতে পারতেন না। শুধু কোটায় অন্তর্ভুক্তরা আবেদন করতেন। এই অবস্থায় দাবি ছিল কোটায় কোনো ধরনের বিশেষ পরীক্ষা নেওয়া যাবে না। চাকরির নিয়োগ পরীক্ষায় একাধিকবার কোটার সুবিধা ব্যবহার না করারও দাবি ছিল আন্দোলনকারীদের।
বাংলাদেশে প্রচলিত কোটাব্যবস্থা নিয়ে সমালোচনা শুধু শিক্ষার্থী বা চাকরি-প্রার্থীদের মাঝেই ছিল, তেমনটি নয়। বিশেষজ্ঞদেরও মতামত ছিল কোটা সংস্কারের পক্ষে। এমনকি পিএসসির সুপারিশও ছিল। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের আগেই চাকরিতে থাকাকালে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আকবর আলি খান প্রথম শ্রেণির সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা পুনর্মূল্যায়নের সুপারিশ করেছিলেন। তিনি জেলা কোটা ১০ শতাংশ বহাল রাখার পক্ষে ছিলেন। কিন্তু কোনো সরকারই এসব সুপারিশ আমলে নেয়নি।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কোটা বাতিল করে ৪০তম বিসিএসের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হলে রেকর্ডসংখ্যক প্রার্থী প্রিলিমিনারিতে আবেদন করেন। ৪ লাখ ১২ হাজার ৫৩২ প্রার্থী ৪০তম বিসিএসের প্রিলিমিনারিতে আবেদন করেছিলেন। এর মধ্যে পরীক্ষা দেন ৩ লাখ ২৭ হাজার পরীক্ষার্থী। প্রিলিমিনারিতে উত্তীর্ণ হন ২০ হাজার ২৭৭ জন। ২০২১ সালের ২৭ জানুয়ারি ৪০তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার ফল প্রকাশ করে পিএসসি। এতে ১০ হাজার ৯৬৪ জন পাস করেন। নিয়োগ হয়েছে ১ হাজার ৯০৩ জন।
কোটা প্রথা বিলুপ্ত করার সময় পিএসসির চেযারম্যান ছিলেন ড. মোহাম্মদ সাদিক। তার সময়েই ৪০তম বিসিএসের বেশিরভাগ প্রক্রিয়া শেষ হয়। কোটা তুলে নেওয়ার পর বিসিএসে নারীরা পিছিয়েছেন এবং নাটোর, ভোলা, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি থেকে প্রশাসন ক্যাডারে কেউ নেই জানানোর পর ড. সাদিক এক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘কোনো কিছু নিয়েই বাড়াবাড়ি করতে নেই। বাড়াবাড়ির পরিণাম ভালো হয় না। যাই হোক নারীরা পিছিয়ে থাকলে লেখাপড়া করে এখন তাদের সামনে আসতে হবে। আর যেসব জেলা থেকে একজনও কর্মকর্তা নেই সেসব জেলার শিক্ষার্থীদের ভালো লেখাপড়া করে সামনে এগিয়ে আসার কোনো বিকল্প নেই। জেলা কোটা না থাকায় সামনের দিনগুলোতে আরও কিছু সমস্যাা দেখা দেবে।’
জনপ্রশাসনের একজন অতিরিক্ত সচিব নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ৩৮তম এবং ৪০তম বিসিএস পর্যালোচনা করলে গাণিতিক দিক থেকে নারীরা পিছিয়েছে বলেই মনে হয়। কিন্তু নারীরা কি আসলেই পিছিয়েছে? ৩৮তম বিসিএসে নারী কর্মকর্তা ২৭ দশমিক ৩৪ শতাংশ হলে সেখান থেকে কোটার ১০ শতাংশ বাদ দিলে মেধারভিত্তিতে নারী কর্মকর্তা ছিলেন ১৭ দশমিক ৩৪ শতাংশ। ৪০ বিসিএসে ২৪ শতাংশ নারী হলে প্রকৃতপক্ষে নারীরা পিছায়নি। সামগ্রিক দিক বিবেচনা করলে নারীরা যথেষ্ট এগিয়ে রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে অহেতুক বিতর্ক সৃষ্টি না করার জন্য তিনি পরামর্শ দেন।